পঞ্চানন মল্লিক
নিবন্ধ
তারুণ্যের সেকাল-একাল
প্রবীণ বা বৃদ্ধরা হলেন অথর্ব বা আধ মরা আর নবীন বা তরুণরা হলেন ক্ষিপ্রমাণ, সচল, কর্মঠ, উদ্যোমী। তারা উদ্যোমতা, চঞ্চলতা এবং চলৎশক্তির প্রতীক। তাই বৃদ্ধদের দেখভাল করার দায়িত্ব তরুণদের ওপরই বর্তায়। বর্তমান প্রেক্ষাপট যেন তার অনেকটা উল্টো। এখনকার তরুণ সমাজকে দেখলে মনে হয় উল্টে ঘা মেরে বুঝি তাদের আদব-কায়দা শেখাতে হবে। তরুণদের আক্রান্ত করে বা নবীন-প্রবীণের দ্বন্দ্বকে উসকে দিতে এ কথা বলছি, তা নয়। আজকাল আশপাশে যা দেখছি সেই দেখা থেকে, সেই অভিজ্ঞতা থেকে এ কথা বলা। কদিন আগে এক কলেজ অধ্যক্ষের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তার এক প্রাক্তন ছাত্র আমার বন্ধু। একটি ছোট্ট দোকানে বসে আমরা চা-বিস্কুট খাচ্ছিলাম। সেখানে হঠাৎ উপস্থিত হলেন অধ্যক্ষ সাহেব। তাকে দেখামাত্রই আমার বন্ধুটি তার বসা চেয়ারটি ছেড়ে দিয়ে স্যারকে বসতে বললেন। দোকানে আর চেয়ার না থাকায় আমার বন্ধুটি দাঁড়িয়েই রইলেন। তখন কৃতজ্ঞচিত্রে অধ্যক্ষ সাহেব তার ছাত্রের প্রশংসা করে বলতে লাগলেন, ‘তোমরা আমার কলেজের প্রথম ব্যাচ ছিলে। তোমরা এখন অনেক বড় চাকরি করো। তার পরও আমাকে দেখলে এভাবে সম্মান দেও অথচ আজকাল যারা পাস করে বেরোচ্ছে তারা আমাদের দেখলে একটু কথাও পর্যন্ত বলে না। পাশ কাটিয়ে চলে যায়।’ আমার মনে হয়, এমন কথা এখন অনেক শিক্ষকই কম-বেশি বলবেন। এক দিন যারা কষ্ট-ক্লেশ করে আমাদের জ্ঞানের আলো দান করেছেন, আমাদের জীবন গঠনে ভূমিকা রেখেছেন; সেই শিক্ষাগুরুদের দেখলে কেন আমরা এড়িয়ে যাব? কেন ন্যূনতম সৌজন্যমূলক কথাবার্তা বলব না? কেন শিক্ষকরা তরুণদের নিয়ে এমন আক্ষেপ করবেন? এটিই জিজ্ঞাসা।
সেকাল আর একালের তরুণের মধ্যে অনেক পার্থক্য লক্ষিত হচ্ছে। তখন তরুণরা বয়োজ্যেষ্ঠদের মান্য করার পাশাপাশি তাদের আদেশ-উপদেশ মেনে চলতেন। মুরব্বিদের দোয়া-আশীর্বাদ জীবনের পাথেয় বলে মনে করতেন। কোনো কাজে যার যার অবস্থানমতো ভূমিকা রাখতেন। প্রত্যেকের আচরণে ছিল গুরুজনদের মানার তাগিদ। এতে সামাজিক ঐক্য, শৃঙ্খলা, নিয়মনীতি বজায় রেখে চলা সবার জন্য সহজতর হতো। সামাজিক সুদৃঢ় বন্ধন, ভ্রাতৃত্ব, বন্ধুত্ব বজায় রাখার পাশাপাশি ভক্তি, শ্রদ্ধা, সরলতা, সুস্থ চিত্তবিনোদন ভাবনা তরুণদের মনে প্রবল ছিল। পাড়ার ছেলেরা গ্রামের এক জায়গায় মিলিত হয়ে খেলাধুলা করত। সামাজিক উৎসব, অনুষ্ঠানে দেশজ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য যাত্রা, নাটক, পালাগান, মারফতি গান ইত্যাদির চর্চা হতো ব্যাপক। প্রবীণদের পাশাপাশি তরুণরাও তাতে অংশ নিতেন। এসব যে তরুণদের মাঝ থেকে এখন একবারে উঠে গেছে, তা নয়। তবে শ্রদ্ধাসহকারে হৃদয়ের গভীর থেকে মেনে চলার প্রবণতা অনেকের মধ্যে কমে গেছে বলে লক্ষ করা যায়। এখন অনাকাক্সিক্ষত ও অপ্রত্যাশিতভাবে কেউ কেউ বিকৃত পথে পা বাড়াচ্ছেন। ইভটিজিং, পর্নোগ্রাফি, মাদকে আসক্তির প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে তরুণদের মধ্যে। আর খেলাধুলা, দেশীয় সাংস্কৃতির পরিবর্তে এখন চিত্তবিনোদনের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে ফেসবুক বা অন্যান্য সোস্যাল কমিউনিকেশন সিস্টেম, কম্পিউটারে গেম খেলা, প্রাচ্যের অনুকরণীয় সংগীত শোনা ইত্যাদি। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার যে আমাদের জন্য ভালো না, তা নয়। কিন্তু তার জন্য অন্য সবকিছু বিসর্জন দিতে হবে, এমনটি তো নয়। আমরা সময় ভাগ করে খেলাধুলার সময় খেলাধুলা, প্রযুক্তি ব্যবহারের সময় প্রযুক্তি ব্যবহার করব, এমনটি হওয়া উচিত। এর ব্যত্যয় আমাদের কাম্য নয়।
রবীন্দ্রনাথের ভাষায় তরুণরা যদি পরিবর্তন বা সংস্কারের প্রতীক হয়; তাহলে তাদেরও অনেক কিছু বুঝে চলতে হবে। সামাজিক পরিমন্ডল, চাকরিবাকরি, খেলাধুলা, রাজনীতি ইত্যাদিতে যারা অগ্রজ বা জ্যেষ্ঠ তাদের মেনে চলার প্রবণতা থাকতে হবে। কারণ মনে রাখতে হবে, এখন যারা প্রবীণ তারাও এক দিন তরুণ ছিল। অর্থাৎ প্রতিটি প্রবীণ ব্যক্তি মানে তরুণ+প্রবীণ। ঠিক একইভাবে আজ যারা তরুণ, কাল তারা প্রবীণ হবেন। আজ যদি প্রবীণদের না মানা হয়, তাহলে আগামীতে তারা যখন প্রবীণ হবেন, তখনকার তরুণরা কি তাদের মানবে? পৃথিবীর সব ধর্মেই গুরুজনদের মান্য করে চলার বিষয়ে তাগিদ দেওয়া হয়েছে। সুতরাং ধর্মীয় বিধিবিধান মেনে গুরুজনদের উপযুক্ত মর্যাদা দিয়ে মানবতার সার্বিক কল্যাণে ব্রতী হতে হবে। মনে রাখতে হবে, বকে যাওয়া তারুণ্যের ধর্ম নয়। বরং দেশ-জাতির প্রত্যাশা পূরণের জন্য আদর্শ মানুষ হয়ে গড়ে ওঠাই মূল লক্ষ্য হতে হবে। আমরা এমন তরুণ সমাজ প্রত্যাশা করি; যারা দেশ ও জাতিকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠ করে অগ্রগতি ও উন্নতির পথে আরো এগিয়ে নেবে।
অবশ্য সব কিছুতে তরুণদের একতরফা দোষারোপ করে লাভ নেই। এখন যারা প্রবীণ তারাও তাদের তরুণ বয়সে একটু-আধটু দোষত্রুটি যে করেননি, এমনটি বলা যাবে না। অনেকে বলেন, এটা বয়সের দোষ। তবে তখনকার দিনে তরুণরা যাই করুক না কেন, সেটা সীমার মধ্যে ছিল। এখন অনেক ক্ষেত্রে সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছেÑ এটাই শঙ্কার কারণ। আমাদের সন্তানদের ঠিকমতো মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তোলার দায়দায়িত্ব মূলত আমাদের। আমরা যদি তা না পারি, তাহলে ব্যর্থতার জন্য এক দিন আমাদেরই অপদস্ত হতে হবে। আমরা চাই না আমাদের সন্তানরা নিয়মনীতি, আদর্শ, আদব-কায়দা থেকে বিচ্যুত হয়ে কারো মনোকষ্টের কারণ হোক। তারুণ্যের শক্তি দুর্বার, তাই এ শক্তিকে শুভ কাজে লাগাতে হবে। আমরা যেন আমাদের তরুণ সমাজকে নিয়ে গর্ব করতে পারি। জাতি যেন তাদের মাঝে খুঁজে পায় ভবিষ্যতে পথচলার সঠিক দিকনির্দেশনা।
লেখক : কবি ও কলামিস্ট
"