অধ্যাপক আয়েশা পারভীন চৌধুরী

  ২০ আগস্ট, ২০১৯

মতামত

বঙ্গবন্ধু নিজেই ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন

১৫ আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি কলঙ্কময় দিন। এই দিনটিতে জাতি অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত হয়। পরবর্তীতে অন্ধকারের মধ্যেই অনেক বছর অতিবাহিত করে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর নোবেলজয়ী তৎকালীন পশ্চিম জার্মানির নেতা ইউলি ব্রানডিট বলেন, মুজিবকে হত্যার পর বাঙালিদের আর বিশ^াস করা যায় না। যে বাঙালি শেখ মুজিবকে হত্যা করতে পারে, তারা যেকোনো জঘন্য কাজ করতে পারে। সাহিত্যিক নীরদ সি চৌধুরী বাঙালিদের ‘বিশ^াসঘাতক’ হিসেবে বর্ণনা করে বলেছেন, বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ মুজিবকে হত্যার মধ্য দিয়ে বিশে^র মানুষের কাছে নিজেদের আত্মঘাতী চরিত্রই তুলে ধরেছেন। দ্য টাইমস অব লন্ডন-এর ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট সংখ্যায় বলা হয়, সব কিছু সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুকে সব সময় স্মরণ করা হবে। কারণ তাকে ছাড়া বাংলাদেশের বাস্তব কোনো অস্তিত্ব নেই। একই দিন লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের লাখ লাখ লোক শেখ মুজিবের জঘন্য হত্যাকান্ডকে অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করবে’।

১৫ আগস্টের বিয়োগান্ত ঘটনার ইঙ্গিত ছিল মাস পাঁচেক আগেই। অবমুক্ত করা মার্কিন দলিল গেঁটে দেখা যায়, ১৯৭৫ সালের ২৩ থেকে ২৪ মার্চের মধ্যে তৈরি পাঁচটি কূটনৈতিক তার বার্তার শিরোনামেই ‘বাংলাদেশ, অভ্যুত্থানের গুজব’ কথাটি ছিল। কিন্তু ২০ মার্চে মিসরের আসওয়ানে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের কাছে পাঠানো তার বার্তাটি নানা কারণে ব্যতিক্রম। সেটির শিরোনামে ‘সম্ভাব্য অভ্যুত্থান’ বলা হয়েছে। তবে এসব তার বার্তার বিবরণ অবমুক্ত করার আগেই মুছে দেওয়া হয়েছে। তাই ভেতরে কী লেখা ছিল, তা কখনো জানা যাবে কি না, সেটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। বিশ^াসঘাতকতা বেইমানি এবং কৃতঘœতা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বাঙালির রক্তের সঙ্গে মিশে আছে।

১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে মীরজাফর ও তার সহযোগীদের যুগের পর যুগ ঘৃণা করে আসছে ও করবে। পলাশীর আম্রকাননে যে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল সেই স্বাধীনতার সূর্য আবার ১৯৭১ সালে লাভ করেছি। কিন্তু বিশ^াসঘাতকরা এর বিরোধিতা করে এবং মেনে নিতে পারে নাই বলেই ১৯৭৫-এর হত্যাকান্ড ঘটায়। ইতিহাস থেকে জানা যায়, নেতাজি সুভাষ বসু, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও নেলসন ম্যান্ডেলা তিনজনই স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলেন, দেখিয়েছিলেন। এক অদৃশ্য সুতায় একে অপরের সঙ্গে বাঁধা। তারা তিনজনই পরাধীন জাতির মুক্তির স্বপ্নদ্রষ্টা। শুধু নিজ নিজ দেশ বা জাতির নয়, পৃথিবীর যেখানেই নিপীড়িত মানুষ স্বাধীনতার জন্য লড়ছেন, এই তিন নেতা তাদের জন্য আশার প্রতীক। এই তিন মহান ব্যক্তি জাতির মুক্তি অর্জনে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তদুপরি বঙ্গবন্ধুর সর্বোচ্চ ত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত আমাদের মহান স্বাধীনতাকে ধরে রাখতে শারীরিক ও মানসিকভাবে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তবেই প্রকৃত মুক্তি আসবে।

জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান বলেন, ১৯৭১ সালে সবাই বঙ্গবন্ধুর কাজ থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করেছিলেন। আগামী দিনেও তার কর্মময় জীবন ও আদর্শ থেকে মানুষ প্রেরণা লাভ করবে। আজকের দিনে বঙ্গবন্ধুকে জানার প্রয়োজন আছে। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের বঙ্গবন্ধুকে জানা খুব বেশি প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর থেকেই অর্থাৎ ১৯৭৫ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ একটি অধ্যায় অতিক্রম করেছে। বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের ওপর একেবারে নির্ভরশীল দুটি গ্রন্থ ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’। এগুলো নতুন প্রজন্মকে সঠিক ইতিহাস জানতে সাহায্য করবে। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম দুই দিকপাল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নজরুলকে অতিক্রম করে তিনি এ শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পরেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের পরিচয় পাওয়া যায় ১৯৭৩ সালের ৩০ মে তার লিখিত ডায়েরি পাঠের মাধ্যমে। তিনি লিখেছিলেন, ‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়ে আমি ভাবি। এতে বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত, তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। ওই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি ও অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’

বঙ্গবন্ধু আমাদের জন্য যে জীবন দর্শন ও আদর্শ রেখে গেছেন তা অমলিন। যুগ যুগ ধরে তা অমর হয়ে থাকবে তরুণ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উৎকর্ষতায়। আমাদের এককেন্দ্রিক নয়, সামষ্টিক চিন্তা মাথায় রাখতে হবে। সবার জন্য কাজ করা এবং সবাইকে সুখের অংশীদার করা প্রকৃত মানুষের কর্তব্য। একবিংশ শতাব্দীর তরুণ প্রজন্ম আগামী শতকের কান্ডারি। তাই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তি এবং সামগ্রিক উন্নয়নে এগিয়ে আসতে হবে। প্রতিহিংসা, হানাহানি ও দলীয় কোন্দল বাদ দিয়ে মানবিক মূল্যবোধ ও মুক্তবুদ্ধির চর্চা করতে হবে। রাজনৈতিক ও সামাজিক বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির বিবেক থেকে বিশ^বিবেকে পরিণত হয়েছেন। ইতিহাসের অংশ থেকে ইতিহাসপ্রণেতা। অতঃপর সমগ্র ইতিহাস। মনে রাখতে হবে, ইতিহাস বঙ্গবন্ধুকে সৃষ্টি করে নাই, বঙ্গবন্ধু নিজেই ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। তাই বিশ্ব ইতিহাস তিনি অমর হয়ে থাকবেন।

১৯২০ সালের ১৭ মার্চ শেখ লুৎফর রহমান ও সায়রা খাতুনের তৃতীয় সন্তান সেই ছোট খোকা কালের আবর্তে ধীরে ধীরে হয়ে উঠেন বাঙালির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান। বাঙালির অহংকার, স্বাধীনতার স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শৈশবের সেই ধুলোবালি মাখা সুন্দর দিনগুলোতেই তিনি চারপাশের নানা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেন। সেই শৈশব থেকেই তিনি জমিদার, তালুকদার ও মহাজনদের অত্যাচার, শোষণ ও পীড়নকে মেনে নিতে পারেননি। তাই তো অন্যায়ের প্রতিবাদ করে সবার নজর কাড়েন। সেই শৈশবেই আশপাশের দুঃখী মানুষের কল্যাণে এগিয়ে আসতেন। গরিব ছাত্রদের জন্য বাড়ি বাড়ি ঘুরে চাল সংগ্রহ, এক শীতে তারই সমবয়সি ১৩ বছরের এক কিশোরকে নিজের কাপড় দান করে, ১৩ বছর বয়সে স্বদেশী আন্দোলনের এক সমাবেশে পুলিশি লাঠিচার্জের বিরুদ্ধে পুলিশ ফাঁড়িতে শত শত ইট-পাটকেল নিক্ষেপ, ১৯৩৯ সালে অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হককে স্কুলের ছাদ সংস্কারের জোরালো দাবি সবার নজরে পড়ে। কিশোর ছাত্র খোকার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, সৎ-সাহস এবং স্পষ্টবাদিতায় মুগ্ধ হয়েছিল শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। ১৭ মার্চ জাতীয় শিশু দিবস উদযাপনের মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম বঙ্গবন্ধুর জীবন, কর্ম ও আদর্শ সম্পর্কে জানতে পারবে এবং দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আগামীতে জাতি গঠনে নিজেকে তৈরি করতে সক্ষম হবে। সুন্দর ভবিষ্যৎ তৈরির লক্ষ্যে, শিশুর প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে সবাই আরো সচেতন হবে। তাইতো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আসুন শিশুদের কল্যাণে আমরা আমাদের বর্তমানকে উৎসর্গ করি।’

বঙ্গবন্ধুর সরলতার সুযোগ নিয়ে সেনাবাহিনীতে কর্মরত কিছু বিপৎগামী সশস্ত্র লোক ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে তার চিরচেনা বাড়িতে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। আজ ধানমন্ডি ৩২ নম্বর শুধু শোকাবহ স্মৃতি নয়, সব ত্যাগ ও অর্জনের স্মৃতি। স্বাধীনতার প্রায় ৪৮ বছর চলছে। এখনো ইতিহাস নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত অনেকেই। কিন্তু ইতিহাস আপন গতিতে চলে। তাই ইতিহাসকে যতই অন্য খাতে প্রবাহিত করা হোক না কেন; ততই ইতিহাসের পাতাগুলো অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠছে। আমাদের যারা এখনো ৫০ পেরোয়নি, তাদেরও এ ধরনের মিথ্যা তথ্যগুলো দ্বিধাদ্বন্দ্বে ফেলে। আর প্রজন্মের পর প্রজন্মকে মিথ্যা ও বিকৃত ইতিহাস শিক্ষা দেওয়ার যে প্রচেষ্টা বিগত দিনগুলোতে চলছে নিশ্চয়ই এক দিন নতুন প্রজন্ম তার সঠিক উত্তর দেবে। তাই নতুন প্রজন্মকে নিয়ে একটি সুন্দর দেশ গড়ার লক্ষ্যে তাদের সঠিক ইতিহাস জানা দরকার। এ ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী বইটি একটি বড় উদাহরণ। জেলখানায় থেকে তিনি নিজ হাতে নিজের ও দেশের প্রতিটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন। তাছাড়া আমাদের দেশে অনেক গান, কবিতা, ছড়া, গল্প, উপন্যাস আছে। এগুলোর পটভূমি ও ঘটনাপ্রবাহ বাংলাদেশের অতীত ও বর্তমান নিয়ে রচিত। নতুন প্রজন্মকে এসব বই পড়তে আগ্রহী করে তুলতে হবে। ফলে তারাই তাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি নির্ভেজাল ইতিহাস উপহার দিতে পারবে। নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে এবং নিজেকে সঠিকভাবে পরিচালিত করতে, সঠিক ইতিহাস জানার ও চর্চা করার কোনো বিকল্প নেই।

লেখক : কলামিস্ট ও শিক্ষাবিদ

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close