ইয়াসমীন রীমা

  ১৭ আগস্ট, ২০১৯

মুক্তমত

পর্নোগ্রাফির ঝুঁকিতে শিশু-কিশোররা

নবম শ্রেণিতে পড়–য়া ছেলে আসিফ কাজের মেয়ে তাসলিমার সঙ্গে কথাবার্তার বলার ধরন কিংবা আচরণ করার বিষয়টি মোটেই ভালো লাগছে না বিলকিস বানুর। এইভাবে গায়ে ধরে কথা বলা কিংবা হাসিহাসি করার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে। ভীষণ সন্দিহান হয়ে পড়ছেন বেসরকারি সংস্থার নির্বাহী কর্মকর্তা বিলকিস বানু। পরিস্থিতি আয়ত্তে আনার অভিপ্রায়ে চৌদ্দ বছর বয়স্ক পরিচারিকা তাসলিমাকে চাকরি থেকে অব্যাহিত দিয়ে দেন। তাছাড়া আজকাল আসিফ তার কথাবার্তা খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না। পড়াশোনায়ও বেশ অমনোযোগী হয়ে যাচ্ছে। আগের মতো নিয়মিত কোচিং ক্লাসেও উপস্থিত থাকে না। স্কুলে গেলেও পুরো ক্লাস না করে ঘরে চলে আসে। এসে নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে রাখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ট্যাব চালিয়ে কীসব দেখে। কাউকে দেখতে পর্যন্ত দেয় না। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কিংবা নিষেধ করলে ক্ষেপে যায়। কোনো কোনো দিন অতি রাগ করে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেয়। কুমিল্লা নগরীর ঝাউতলা আবাসিক এলাকার বাসিন্দা বিলকিস বানু তার স্বামী অর্থাৎ আসিফের বাবা ব্যাংকার মনজুর হোসেনকে ব্যাপারটা অবহিত করেছেন। কিন্তু মনজুর হোসেন তার স্ত্রীর কথায় ততটা গুরুত্ব দিচ্ছেন না। অপরগতায় বিলকিস বানু তার ছোট বোন কুমিল্লা ইউনিভার্সির অনার্স ক্লাসের ছাত্রী পিয়ার শরণাপন্ন হন। আসিফের সঙ্গে খালা পিয়ার আবার বেশ বন্ধুত্ব, সব বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হয়। পিয়া মারফতে রহস্য উদ্ঘাটিত হয়। আসলে আসিফ পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হয়ে পড়েছে। সবার দৃষ্টিকে আড়াল করে সে ট্যাবে কিংবা তার নিজস্ব ঘরের ডেক্সটপ কম্পিউটারে পর্নোগ্রাফি দেখে প্রতিদিন। মানসিকভাবে অনিয়ন্ত্রিত হয়ে নোংরামির জগতে প্রবেশ করতে যাচ্ছে।

কেবল আসিফ নয় দেশব্যাপী বিশেষ করে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে পর্নোগ্রাফি দেখার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে রেডিও, টেলিভিশন, ইন্টারনেট, পত্রিকা, ম্যাগাজিন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন-মোবাইল, ফেসবুক, টুইটার, ব্লগ, ইউটিউবের মতো নানা গণমাধ্যগুলো শিশু-কিশোরদের দারুণভাবে প্রভাবিত করে। তাই ওই গণমাধ্যমগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে অভিভাবকরা যথেষ্ট সচেতন না হলে কোমলমতি শিশু-কিশোররা অপরাধে লিল্প হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে কুরুচিপূর্ণ যৌন আবেগে ভরপুর ম্যাগাজিন ও পত্রিকা কিশোর-কিশোরীদের মন-মানসিকতার ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। যৌনরসে সিক্ত সিনেমা বিজ্ঞাপন চিত্র, ফ্যাশন শো-এর নামে টেলিভিশনে ইউটিউবে প্রদর্শিত যৌন আবেদনময়ী অন্ষ্ঠুানমালা আবেগপ্রবণ কিশোর-কিশোরীদর মধ্যে প্রবল উত্তেজনা ও মানসিক চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে বিপথগামী করে তোলে।

ডিএমপির মুখপাত্র ও ডিবির যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, সারা দেশে প্রতিনিয়ত যেসব আত্মহত্যা, হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ কিংবা অপরাধের ঘটনা ঘটছে সেগুলোর তদন্ত করতে গিয়ে দেখা গেছে, দায়ী ব্যক্তি বা কিশোর-কিশোরীরা কোনো না কোনোভাবে সিনেমা, নাটক বা কোনো ভায়োলেন্সপূর্ণ চিত্র দেখে অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। সাম্প্রতিক অপরাধগুলোকে মনে হয় কোনো অপরাধধর্মী নাটক ও সিনেমার অনুকরণ। বিশেষ করে হত্যা, ধর্ষণ বা পূর্বপরিকল্পিত কোনো অপরাধ সংঘটনের ক্ষেত্রে অপরাধীরা এসব নাটক, সিনেমা বা উত্তেজনার্পূণ চলচ্চিত্র দেখে নানা কৌশল অবলম্বন করেছে।

পর্নোগ্রাফি থেকে শিশুদের নিরাপদে রাখতে দেশে উল্লেখযোগ্য কোনো ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি। সুনির্দিষ্ট আইন থাকলেও পর্নোগ্রাফি বন্ধে তার তেমন প্রয়োগ নেই। আর ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান এবং মোবাইল অপারেটেরগুলোরও বিষয়টিতে রয়েছে অমনোযোগ। বিশেষ করে মোবাইল ফোন সহজলভ্য ও অতিপ্রয়োজনীয় হয়ে ওঠায় অভিভাবকরাও এর অপব্যবহার রোধে সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখতে পারছেন না। বর্তমান অবস্থায় শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত শিশু-কিশোররা পর্নোগ্রাফির ঝুঁকিতে পড়েছে।

প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের মতামত, ভবিষৎ প্রজন্মকে নষ্ট হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষায় পর্নোগ্রাফি বন্ধে সরকার, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও সমাজের সবাইকে ভূমিকা নিতে হবে। চলতি বছরে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের এক জরিপে জানানো হয়েছে, সারা দেশে প্রায় ৩৮ দশমিক ৯০ শতাংশ স্কুলগামী শিশু-কিশোররা নিয়মিত পর্নোগ্রাফি দেখে। এর মধ্যে খোদ রাজধানী ঢাকাতে এর ৭৭ শতাংশ। বর্তমানে চারটি পদ্ধতিতে পর্নোগ্রাফি তৈরি হচ্ছে। এর মধ্যে বাণিজ্যিকভাবে তৈরি পর্নোগ্রাফির চেয়ে ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে তৈরি পর্নোগ্রাফি শিশুরা বেশি দেখছে। আর এসব ভিডিওতে ধারণকৃত ১৮ বছরের কম বয়সি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের। তারা একটি বেসরকারি ডিজিটাল টেলিভিশন চ্যানেল ঢাকার বেশ কয়েকটি স্কুলে জরিপ চালিয়ে দেখেছে শিক্ষার্থীদের ৮২ শতাংশ স্বীকার করেছে তারা সুযোগ পেলে মোবাইলে পর্নোগ্রাফি দেখে।

সাইবার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের বিশেষ পিপি নজরুল ইসলাম শামীম বলেন, শিশুরা এখন বিদেশি পর্নোগ্রাফির পাশাপাশি দেশি পর্নোগ্রাফি দেখতে পাচ্ছে সহজে। পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণে একটি ভালো আইন রয়েছে। ওই আইনে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে মামলা হয়। পর্নোগ্রাফি তৈরি, সরবরাহ, সংরক্ষণ ও অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যারা পর্নোগ্রাপি তৈরি ও সরবরাহ করে আইন অনুযায়ী তাদের শাস্তি বিধান করলে এই অশুভ তৎপরতা হ্রাস পাবে।

শিশুরাই ভবিষ্যৎ। শিশুরা না থাকলে মানব সভ্যতাই থাকবে না। প্রতিযোগিতামূলক এই সমাজে প্রেক্ষাপটে টিকে থাকতে হলে শিক্ষার পাশাপাশি প্রযুক্তি ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ তাই বলে অপব্যবহার করা চলবে না। কিশোর অপরাধ অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে সবসময় পরিবারকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে। কেননা পরিবার মানুষের আদি সংগঠন এবং সমাজ জীবনের মূলভিত্তি। সন্তানের স্বাভাবিক ও সুস্থ বিকাশের জন্য মা-বাবার মধ্যে সম্প্রীতিময় দাম্পত্য জীবন একান্ত অপরিহার্য। কিশোর অপরাধের ক্ষেত্রে সঙ্গদলের প্রভাব কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিশোর-কিশোরীরা এই বয়সে পরিবারের প্রভাবমুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে চলতে চায় এবং পাড়া-প্রতিবেশী খেলার সাথি ও সমবয়সিদের সঙ্গে মিলেমিশে। এদিকে অধিক নজরদারি করতে হবে পরিবারকেই। কেবল আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার ও বিভিন্ন মিডিয়ার প্রচারিত অনুষ্ঠানমালা অপরাধ বৃদ্ধি করছে তা নয়, এক্ষেত্রে পরিবারগুলোর একটি দায় আছে। সন্তানকে কোন বয়সে কী দেখাতে বা শেখাতে হবে তা আগে জানতে হবে। তা ছাড়া পরিবারের সঙ্গে সামাজিকভাবেও এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও গবেষক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close