আবু আফজাল সালেহ

  ১৭ আগস্ট, ২০১৯

পর্যালোচনা

হুমকির মুখে চামড়াশিল্প

তৈরি পোশাকশিল্পের পর আমাদের অর্থনীতিতে সম্ভাবনাময় সবচেয়ে বড় খাত চামড়াশিল্প। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশের আয় হয় ১০৮ কোটি ৫৫ লাখ ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ১২ শতাংশ কম। সর্বশেষ অর্থবছরেও বাংলাদেশের চামড়া খাতের সার্বিক রফতানি আয় কমেছে।

দেশে প্রস্তুতকৃত চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের প্রায় ৯৫ ভাগই বিদেশে রফতানি হয়। কিন্তু চামড়াশিল্প এখন দিন দিন ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে রফতানির লক্ষ্যমাত্রা ১৩৮ কোটি ডলারের বিপরীতে আয় হয়েছে ১০৮ কোটি ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ২১ দশমিক ৩৪ শতাংশ কম। আর ২০১৬-১৭ অর্থবছরের তুলনায় ১২ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ কম। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আয় হয়েছে ১২৩ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলার। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এই খাত থেকে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১২৮ কোটি ডলার। চামড়া ২৪ কোটি ডলারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও ২৩ দশমিক ৭১ শতাংশ কমে রফতানি হয়েছে ১৮ কোটি ৩০ লাখ ডলার, যা গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ছিল ২৩ কোটি ২০ লাখ টাকা। চামড়াজাত পণ্য থেকে ৫৪ কোটি ডলারের রফতানি লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আয় হয়েছে ৩৩ কোটি ৬০ রাখ ডলার, যা ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ছিল ৪৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার।

রফতানি পণ্য তালিকা প্রণয়ন করতে গেলে পাট ও চায়ের পর অনিবার্যভাবে যে পণ্যটির নাম চলে আসত তা হলো চামড়া। তবে আমাদের চামড়া খাত বাজার ধরতে পারছে না। পরিবেশ দূষণের কারণে বাংলাদেশের ট্যানারি বৈশ্বিক সংস্থা লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) মানসনদ দিচ্ছে না। বিশ্বের ৬৬টি বড় ব্র্যান্ডের সদস্য। এলডব্লিউজি’র মান সনদহীন ট্যানারি থেকে তারা চামড়া কেনে না। পরিবেশ সুরক্ষা, বর্জ্য পরিশোধন, কাঁচামালের উৎস, জ্বালানি ও পানির ব্যবহার ইত্যাদি বিবেচনা করা হয় সনদের ক্ষেত্রে। বিশ্বের ৪৪০টি কারখানা এলডব্লিউজি সনদ পেয়েছে। এর মধ্যে ২৪২টি গোল্ড সনদ। ভারত ১০৫টি, চীন ৭৫টি, ব্রাজিল ৬৩টি, ইতালি ২৬টি, ভিয়েতনাম ১৪টি, পাকিস্তান ৩টি। ২০১৫ সালে অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ট্যানারি ইউনিট এলডব্লিউজির নিরীক্ষায় সেরা মান অর্থাৎ গোল্ড কারখানার মর্যাদা পায়।

বিশ্ববাজারে চামড়ার পাশাপাশি বাংলাদেশে তৈরি চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। এছাড়া বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মানের চামড়াজাত পণ্য তৈরির প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠেছে। ‘ফরাসিদের ফ্রেঞ্চ কাফে’র পর মানের দিক থেকে বাংলাদেশের চামড়াই বিশ্বের সেরা বলে মনে করেন চামড়া বিশেষজ্ঞরা। এ রকম ‘স্মুথ গ্রেইন’র চামড়া বিশ্বের অন্য কোথাও মেলে না। কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ চামড়ার জুতা রফতানি করছে। বাংলাদেশে আগে জুতা তৈরি হলেও তা দ্বারা স্থানীয় চাহিদা পূরণ করা হতো। এখন জুতা রফতানি করা হচ্ছে। জুতা ও অন্যান্য পণ্যের লক্ষ্যমাত্রায় ৬০ কোটি ডলারের বিপরীতে আয় হয়েছে ৫৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এ খাত থেকে আয় হয়েছে ৫৩ কোটি ডলার। এছাড়া ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ১১৩ কোটি ডলারের চামড়া এবং চামড়াজাত পণ্য রফতানি করা হয়েছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে চামড়াজাত পণ্য রফতানিতে আয় হয়েছিল ১১৬ কোটি ৯ লাখ ৫০ হাজার ডলার। আমাদের প্রধান সুবিধা হচ্ছে, চামড়া আমরা অভ্যন্তরীণ উৎস থেকেই পাই। তার ওপর এখানে শ্রমিকের মজুরিও কম। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে আমরা তুলনামূলকভাবে কম দামে চামড়া এবং চামড়াজাত পণ্য দিতে পারি। আমাদের দেশে শ্রম সস্তা ও উৎপাদন খরচ অন্য দেশের তুলনায় কম। উন্নত দেশগুলোতে জুতা তৈরির মোট খরচের ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ ব্যয়িত হয় শ্রমিকের মজুরি বাবদ। আমাদের দেশে তা মাত্র ৫ শতাংশের মতো। জাপানে একজন জুতা শ্রমিকের প্রতি ঘণ্টায় মজুরি ২৩ দশমিক ৬৫ ডলার। বাংলাদেশে এ হার মাত্র শূন্য দশমিক ২৩ ডলার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একজোড়া চামড়ার জুতা তৈরি করতে খরচ হয় ৩২ ডলার, যা বাংলাদেশে ১৪ ডলার। চীনে চামড়ার তৈরি জুতা শিল্পের উৎপাদন ধীরে ধীরে কমছে বলে সে দেশের পত্রপত্রিকা মারফত জানা যাচ্ছে। চীনের ছেড়ে দেওয়া বিশ্বের জুতার বাজারে আমাদের প্রবেশ করতে হবে। একটু উদ্যোগী আর ব্যবসায়ীরা আন্তরিক হলেই এ সুযোগ কাজে লাগানো যাবে। মান বাড়িয়ে বাজার ধরতে দেশে অন্যান্য শিল্পবান্ধব অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। সরকার আন্তরিক। ব্যক্তি-উদ্যোগ স¤পৃক্ত করতে হবে বা বাড়াতে হবে।

আশার কথা হচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে পাকা চামড়ার পাশাপাশি এখন জুতা, ট্রাভেল ব্যাগ, বেল্ট, ওয়ালেট বা মানিব্যাগ বিদেশে রফতানি হয়। পাদুকাশিল্পে চামড়ার চাহিদা বাড়ছে। এ শিল্পে মোট চামড়ার ৫০ থেকে ৫৫ শতাংশ ব্যবহার করা হয়। এ ক্ষেত্রে নতুন প্রতিযোগী হয়ে উঠছে মোবাইল ফোনসহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক পণ্যের কাভার হিসেবে চামড়াজাত পণ্যের ব্যবহার। মোট চামড়ার ১২ শতাংশ এখন ব্যবহার করছেন তারা। অন্যদিকে গ্লাভস, ওয়ালেটস, পারস, পোশাক ইত্যাদি তৈরিতে চামড়ার চাহিদা বাড়ছে। মোট চামড়ার ৩৮ শতাংশ ব্যবহৃত হয় এ খাতে। এছাড়াও চামড়ার তৈরি নানা ‘ফ্যান্সি’ পণ্যেরও চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশে প্রচুর হস্তশিল্প প্রতিষ্ঠান আছে, যারা এসব পণ্য তৈরি করে বিশ্বের বাজারে পাঠাচ্ছে। বাংলাদেশের চামড়া এবং চামড়াজাত পণ্যের বড় বাজার হলো- ইতালি, যুক্তরাজ্য, ¯েপন, ফ্রান্স, জার্মানি, পোল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডা। এর বাইরে জাপান, ভারত, নেপাল ও অস্ট্রেলিয়াতেও বাজার গড়ে উঠেছে সাম্প্রতিক সময়ে। দেশি উৎপাদনকারীরা চাইলেও ওইসব পণ্য ইউরোপের ক্রেতারা বাংলাদেশি চামড়া ব্যবহার করতে আগ্রহী কম। তাদের অভিযোগ, বাংলাদেশের চামড়াশিল্প কারখানাগুলো উৎপাদনকাজ চালিয়ে যাচ্ছে অত্যন্ত নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে। শুধু ট্যানারি নয়, তাদের কেন্দ্র করে করে ছোট ছোট আরও অনেক অপরিকল্পিত কারখানা গড়ে উঠেছে বাংলাদেশে। সেসব কারখানায় ট্যানারির কঠিন বর্জ্য, যেমন টুকরো-চামড়া, গরুর হাঁড়, চর্বি, দাঁত পুড়িয়ে পোলট্রি ফিডসহ আরো নানা জিনিস তৈরি করা হয়। এটা ক্রমান্বয়েই বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে পরিবেশগত খারাপ দিক আছে। এসব কারখানার বিষাক্ত ধোঁয়া পরিবেশ দূষণ করছে। এক্ষেত্রে বিশেষ ব্যবস্থা ক্ষেত্রমতে আলাদা অঞ্চল তৈরি করা যেতে পারে। সম্ভাবনার বিচারে এ শিল্পে বাংলাদেশের অবস্থান আরো শক্তিশালী করার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু হচ্ছে না। এর মানে হলো পরিকল্পনার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা না হলে এ খাত থেকে কাক্সিক্ষত প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব নয়। প্রতি বছর সরবরাহ বাড়লেও কমছে চামড়া রফতানি চামড়ার সরবরাহ এবং রফতানির মধ্যে ভারসম্যহীনতা তৈরি হয়েছে। যে কারণে প্রতি বছর দেশের বাজারে চামড়ার দাম কমছে।

কোরবানি ঈদের সময় আমরা সিংহভাগ চামড়া পেয়ে থাকি। আর এসব চামড়ার মানও ভালো। তবে পরিবহন ব্যবস্থা ও সংরক্ষণ ব্যবস্থায় আরো সচেতন হতে হবে। চামড়ার প্রায় ৬০ শতাংশই আসে ঈদের পশু জবাই থেকে। প্রতি বছরের মতোই বিভিন্ন অজুহাতে দেশীয় বাজারে চামড়ার দাম কমাতে তৎপর হচ্ছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট চক্র। আর এ সময়েই সিন্ডিকেট ও কারসাজি করে বিপুল সম্ভাবনার এ খাতকে অস্থির করতে চায় কেউ কেউ। এ সময়ে সরকার আরো কঠোর ভূমিকা পালন করলে ভালো হবে। চামড়া খাতকে শক্তিশালী করতে ট্যানারি কারখানার আধুনিকায়ন, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়াতে হবে, চামড়াশিল্পে ব্যবহৃত উপকরণের উৎপাদন বৃদ্ধি, সঠিক পদ্ধতিতে পশুর শরীর থেকে চামড়া ছাড়ানোর জন্য প্রশিক্ষণ, সংরক্ষণ এবং পাচার রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণসহ ইত্যাদি বিষয়ে ব্যাপক প্রচার এবং সচেতনা বৃদ্ধিতে উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।

সংশিষ্ট সূত্র জানায় দেশে প্রতি মাসে ৫০ থেকে ৬০ লাখ বর্গফুট ফিনিশড চামড়া আমদানি হচ্ছে। অথচ দেশীয় পশুর চামড়া রফতানি ক্রমেই কমে যাচ্ছে। রফকানিতে মিলছে না ন্যায্যমূল্য। নানা অব্যবস্থাপনার কারণে দেশের চামড়াশিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কাঁচা চামড়া সঠিকভাবে সংরক্ষণ না হওয়ায় চামড়ার ন্যায্যমূল্য পাওয়া যাচ্ছে না। আবার দেশের ট্যানারিগুলো শতভাগ পরিবেশবান্ধব না হওয়ায় বিদেশি ক্রেতারা বিমুখ হচ্ছে। পশু থেকে চামড়া আলাদা করতে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ, লবণ দিতে বিলম্ব করায় প্রায় ৩০ শতাংশ ও গাড়িতে করে পরিবহনের কারণে ২০ শতাংশ কাঁচা চামড়া নষ্ট হচ্ছে। ২০১৬ সাল থেকে দেশে কাঁচা চামড়ার বাজারে ধস নামতে থাকে। কোরবানি দাতারা চামড়ার দাম পাচ্ছেন না। আড়তদার কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীরা ট্যানারি মালিকদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলেছেন। রপ্তানি বাড়াতে হলে চামড়ার গুণগতমান বৃদ্ধি করতে হবে।

২০১৭ সালের বর্ষপণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল চামড়াশিল্পের নাম। নীতিগত সুবিধার পাশাপাশি রফতানি বাড়াতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ফলাফল ভালো হয়নি। বিশ্বে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের বাজার রয়েছে ২২ হাজার কোটি ডলারের। সেই বাজারে বাংলাদেশের অংশ ১ শতাংশও নয়। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, চীন, ভারত, কোরিয়া, ইতালি চামড়া কেনাবেচা সবচেয়ে বেশি। এ পর্যায়ে উঠে আসতে সময়ক্ষেপণ না করে চামড়াশিল্পের বর্জ্য পরিশোধনের কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাটি কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। মৌসুমি ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমাতে পারলে চামড়াশিল্প আরো অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারবে। একই সঙ্গে ব্যাংক ঋণের সুদ কমিয়ে ট্যানারি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো হাজারীবাগ থেকে সাভারে স্থানান্তর সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান করতে পারলে এদেশের চামড়াশিল্প বিশ্ববাজারে প্রথম কাতারে স্থান করে নিতে পারবে। স্থানীয় চাহিদা বাড়ার কারণে ট্যানারি মালিকরা কিছুটা রফতানিবিমুখ হচ্ছে। সরাসরি বিপণন বাড়াতে পরিবেশবান্ধব সনদ পেতেই হবে। আর সেটি পেলেই প্রক্রিয়াজাত চামড়ার বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের অংশ আবার বাড়তে থাকবে।

লেখক : কবি ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close