নিতাই চন্দ্র রায়

  ১৭ আগস্ট, ২০১৯

বিশ্লেষণ

স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু

বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ও কাজের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালের জুন মাসে দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। উদ্দেশ্য ছিল- দুর্নীতি দমন, খেতে-খামারে ও কল-কারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধি। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ এবং জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা। সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে অর্থনৈতিক মুক্তি প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তিনি অভূতপূর্ব সাড়া পান। অতি অল্প সময়ের মধ্যে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি ঘটে। উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। চোরাচালানি বন্ধ হয়। দ্রব্যমূল্য মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে চলে আসে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদী চক্রের এ দেশীয় কিছু দালালের ষড়যন্ত্রের কারণে মানুষের সেই সুখ বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কিছু সংখ্যক বিপথগামী ও উচ্চাবিলাসী সেনা অফিসারের হাতে চিলির আলেন্দের মতো জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তার ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের নিজ বাসভবনে নির্মমভাবে নিহত হন। ঘাতকরা ভেবেছিল, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলে বাংলার মাটি ও মানুষের মন থেকে তার নাম চিরতরে মুছে যাবে। ওরা জানত না, যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, বাঙালি জাতি থাকবে, ততদিন থাকবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নাম। বঙ্গবন্ধু একটি ইতিহাস, এক কিংবদন্তী। বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্প, কৃষি ,অর্থনীতি, সামাজিক ও অবকাঠামোগত খাতে এত উন্নয়নের কথা চিন্তাও করা যেত না কোনো দিন।

সমাজের মহান ব্যক্তিরা যা করেন, সাধারণ মানুষ তা অনুসরণ করে এটা দ্রুব সত্য। তাই বাংলাদেশকে বিশ্ব-দরবারে একটি প্রগতিশীল বিজ্ঞানমনষ্ক উন্নত জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে, জাতির জনকের মতো মহাপুরুষের দীর্ঘ ত্যাগ ও সংগ্রামী জীবনের কথা দেশের নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে। তার আদর্শ, আত্মত্যাগ ও মহানুভবতা নতুন প্রজন্মকে সুখী ও সমৃদ্ধশালী সোনার বাংলা গড়ার কাজে উৎসাহিত করবে। তার গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ উদ্দীপ্ত করবে দেশের ৯ কোটি তরুণ প্রজন্মকে, যারা হবেন আগামী দিনের পরিবেশবান্ধব, পরিকল্পিত নগরীয় বাংলাদেশ গঠনের দক্ষ কারিগর। এজন্য সব ধরনের উন্নয়ন কর্মকা-ে চীন, দক্ষিণ কোরিয়া ও ভিয়েতনামের মতো জনগণকে যুক্ত করতে হবে। যাতে তারা মনে করেন, দেশ তাদের, দেশের সমৃদ্ধির জন্য তাদেরই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। আর এই কাজে নেতৃত্ব দিতে হবে ত্যাগী রাজনীতিবিদদের। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলতেন, কোনো মহৎ কাজ করতে হলে ত্যাগ ও সাধনার প্রয়োজন। যারা ত্যাগ করতে প্রস্তুত নয়, তারা জীবনে কোনো ভালো কাজ করতে পারেনি- এ বিশ্বাস আমার ছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম যে, এ দেশে রাজনীতি করতে হলে ত্যাগের প্রয়োজন আছে এবং ত্যাগ আমাদের করতে হবে।

আমাদের নেতাদের জানা উচিত, ভারত বিভাগের পর তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ঢাকা এসেছিলেন প্রায় নিঃস্ব অবস্থায়। সোহরাওয়ার্দী সাহেব সামান্য কাপড় ছাড়া আর কিছু নিয়ে আসতে পারেননি। ভারত সরকার তার সর্বস্ব ক্রোক করে রেখে ছিল। অনেকের কাছে আশ্চর্য মনে হবে, শহীদ সাহেবের কলকাতায় নিজের কোনো বাড়ি ছিল না। ৪০ নম্বর থিয়েটার রোডের বাড়িটি ছিল ভাড়া করা বাড়ি। তিনি করাচিতে তার ভাইয়ের কাছে উঠেছিলেন। কারণ তার খাবার পয়সাও ছিল না।

ভারতে মহাত্মা গান্ধী ও পাকিস্তানের কায়দে আজমের জন্ম ও শাহাদাতবার্ষিকী সর্বজনীনভাবে পালিত হলেও বাংলাদেশে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জন্ম ও শাহাদতবার্ষিকী সেভাবে পালিত হয় না। ইতিহাস এক জায়গায় স্থির থাকে না। একদিন আমরাও হয়তো আমাদের জাতির পিতাকে দলমত নির্বিশেষে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারব। এটা ছিল আওয়ামী লীগের মরহুম মহাসচিব সৈয়দ আশরাফের প্রত্যাশা। তার মতে, শুধু লেখনীর মাধ্যমে নয়; তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমেও ছোট ছোট শিশুদের সামনে বঙ্গবন্ধুর অমর কীর্তি তুলে ধরতে হবে।

আমরা জানি, ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর আহবানে দেশের আবালবৃদ্ধবনিতা স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ২৫ মার্চ কাল রাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর পাকিস্তান সেনাবাহিনী সশস্ত্র হামলা চালায়। আক্রমণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিলখানা বিডিআর সদর দফতর ও রাজারবাগ পুলিশ হেডকোয়ার্টার। বঙ্গবন্ধু ২৫ শে মার্চ রাত ১২টা ২০ মিনিটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। স্বাধীনতা ঘোষণায় তিনি বলেন, এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণ, তোমরা যে যেখানেই আছ এবং যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শেষ পর্যন্ত দখলদার সেনাবাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য আমি তোমাদের আহবান জানাচ্ছি। পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতারিত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তোমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। তার এই ঘোষণার ফলে দলমত নির্বিশেষে বর্বর পাকিস্তানি সেনাদের হাত থেকে দেশ মাতৃকাকে মুক্ত করার জন্য আগ্নেয়াস্ত্র হাতে তুলে নেন কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, শিক্ষকসহ সব পেশা ও শ্রেণির মানুষ।

১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে অস্থায়ী মুজিবনগর সরকার গঠন করা হয়। ১ কোটি মানুষ ভারতের শরনার্থী শিবের আশ্রয় গ্রহণ করে। সারা দেশের আনাচে-কানাচে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে শুরু হয় গেরিলা যুদ্ধ। যে যাই বলুক, স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তি সেনারা যুদ্ধের ময়দানে শুধু একটি স্লোগানই উচ্চারণ করতো সেটি হলো- জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। এটাই প্রমাণ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নামেই স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু ’৫২- এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ’৫৪ -এর যুক্ত ফ্রন্টের নির্বাচন, ’৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণ অভ্যুত্থান এবং ’৭০-এর সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে ৭ কোটি বাঙালিকে ধাপে ধাপে স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত করতে পেরেছিলেন তাঁর জাদুকরী ভাষণ, সাংগঠনিক শক্তি, ইস্পাত কঠিন সংকল্প, আদর্শ, নিখাদ দেশ প্রেম ও অসীম সাহসিকতার সাহায্যে।এটা পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের মতো খ্যাতিমান নেতারা যা করতে পারেননি, শেখ মুজিব তা করতে সক্ষম হন। কারণ শেখ মুজিব জনতার নাড়ির স্পন্দন বুঝতেন। বাঙালি মধ্যবিত্তের আশা-আকাক্সক্ষার কথা জানতেন। পলাশীর যুদ্ধ, সিপাহী বিপ্লব, খুদিরামের ফাঁসি, ফকির সন্নাসী বিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলন, টাংক আন্দোলন, তিতুমীর, মাস্টার দা সূর্যসেন ও প্রীতিলতার আত্মত্যাগের তাৎপর্য তিনি উপলব্ধি করতেন গভীরভাবে। নেতাজী সুভাষ বসুর কাছ থেকেও তিনি পেয়েছিলেন স্বাধীনতা যুদ্ধের অনুপ্রেরণা। ১৯৩৬ সালে বঙ্গবন্ধু যখন চোখের চিকিৎসার পর মাদারীপুরে ফিরে এলেন তখন স্বদেশী আন্দোলনের যুগ। মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জের ঘরে ঘরে স্বদেশী আন্দোলন। ১৫ থেকে ১৬ বছরের ছেলেদের স্বদেশীরা দলে ভেড়াতো। বঙ্গবন্ধুও নিয়মিত স্বদেশীদের সভায় যোগ দিতেন।ওই সময় তার মনে হতোÑ ইংরেজদের এদেশে থাকার কোনো অধিকার নেই। সংগ্রাম করেই স্বাধীনতা আনতে হবে। তখন থেকে বঙ্গবন্ধু নেতাজী সুভাস বসুর ভক্ত হতে শুরু করেন। তিনি পাকিস্তান আন্দোলনেরও একজন সক্রীয় নেতা ও সংগঠক ছিলেন। রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে তিনি আবুল হাশিম ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নিবিড় সান্নিধ্যে আসেন। শহীদ সাহেবকে তিনি প্রচ- ভালবাসতেন। প্রকৃতপক্ষে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীই ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের রাজনৈতিক গুরু ও আদর্শের অগ্নিশিখা।

অনেকের মতে, বঙ্গবন্ধুকে শুধু ১৫ আগস্টের শোক দিবসের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সারা বছর বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে তাকে স্মরণ করতে হবে। একই সঙ্গে তরুণ প্রজন্মকে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানাতে পাঠ্যপুস্তকে বঙ্গবন্ধুকে ভালোভাবে তুলে ধরতে হবে। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী দলের নেতাকর্মীদের বেশি করে পাঠ করতে হবে, এতে তারা বঙ্গবন্ধুর মতো দেশ প্রেমিক ও আদর্শবান হয়ে উঠবে। বঙ্গবন্ধু শুধু আওয়ামী লীগের নন, তিনি দেশের সব মানুষের। তিনি জাতির পিতা। বাঙালি জাতির পথ প্রদর্শক এবং দুর্দিনের কা-ারি । স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা। তিনি সব দলমত ও রাজনীতির ঊর্ধ্বে। যে যে দলই করুক না কেন, বঙ্গবন্ধুকে অবশ্যই জাতির পিতা হিসেবে মেনে নেওয়া উচিত। সর্বস্তরের মানুষের অন্তরে যদি বঙ্গবন্ধুকে গেঁথে দিতে হয়, তবে তৃণমূল থেকে কাজ শুরু করতে হবে। শিশু শ্রেণি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রতিটি স্তরের পাঠ্যপুস্তকে বঙ্গবন্ধুকে উপস্থাপন করতে হবে। শুধু কঠিন প্রবন্ধ আর কবিতা দিয়ে নয়; সবার উপযোগী করে সহজ সরল ভাষায় তার সংগ্রামী জীবনও মহৎ কর্মকা- তুলে ধরতে হবে নুতন প্রজন্মের কাছে। আর এভাবেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হয়ে উঠবেন সর্বজনীন। সেই দিন আর খুব বেশি দূরে নয়।

লেখক : কৃষিবিদ ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close