মোহাম্মদ আবু নোমান

  ১০ আগস্ট, ২০১৯

বিশ্লেষণ

পশু কোরবানি আত্মকোরবানির প্রতীক

পিতা-পুত্রের সুমহান আত্মত্যাগের ফলে প্রতিষ্ঠিত হলো ইবরাহিম (আ.)-এর সুন্নাত হিসেবে মানবসন্তানকে জবাই করার পরিবর্তে সম্পদের মোহ ত্যাগ করে গৃহপালিত চতুষ্পদ জন্তু আল্লাহর নামে উৎসর্গ করার বিধান কোরবানি প্রথা। এর দ্বারা আল্লাহর প্রতি বান্দার প্রেম ও সম্পদের প্রতি লোভ-লালসার আতিশয্যের কামনা-বাসনা ত্যাগের পরীক্ষা করা হয়। এর বিনিময়ে আল্লাহর কাছ থেকে মুমিন বান্দারা পুণ্যের আধিক্যতা ও জান্নাতের নিশ্চয়তা পেয়ে থাকে। এই ত্যাগের প্রতীক বা স্মারক হিসেবে কোরবানির ঈদের রীতি প্রবর্তিত হয়; যাতে সুস্পষ্ট হয়ে যায় ঈদুল আজহার সৌন্দর্য এবং উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে মানবিক মূল্যবোধ। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘সুতরাং তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করো এবং কোরবানি করো।’Ñ কাওছার : ২।

সাহাবিগণ রাসুলুল্লাহকে (সা.) জিজ্ঞাসা করেন, ‘এই কোরবানি কী?’ তিনি বললেন, ‘তোমাদের পিতা ইবরাহিমের সুন্নাত’।Ñ ইবনে মাজা। মেহেরবান আল্লাহ মুসলমানদের জন্য বছরে দুটি শ্রেষ্ঠ খুশির দিন উপহার দিয়েছেন। একটি ঈদুল ফিতর, অপরটি ঈদুল আজহা। দুই ঈদেরই রয়েছে দুই রকম বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও তাৎপর্য। ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ আসে ত্যাগের মহিমা নিয়ে। আরবি ‘আজহা’ এবং ‘কোরবান’ উভয় শব্দের অর্থ উৎসর্গ। ‘কুরব’ ধাতু থেকে কোরবানি শব্দটির উৎপত্তি। এর অর্থ আত্মত্যাগ, উৎসর্গ বা বিসর্জন, নৈকট্য বা অতিশয় নিকটবর্তী হওয়া ইত্যাদি। ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ বিশ্ব মুসলিম মননে আত্মত্যাগ ও আত্মোৎসর্গের দৃঢ়প্রত্যয় গ্রহণের তাগিদ সঞ্চারিত করে।

ইসলামের পরিভাষায় কোরবানি বলা হয় ওই নির্দিষ্ট পশুকে; যা একমাত্র আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট সময়ে আল্লাহর নামে জবাই করা হয়। কোরবানি দেওয়ার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি হাসিল করা যায় বলে এমন নামকরণ। কোরবানির বিধান যুগে যুগে সব শরিয়তেই বিদ্যমান ছিল। মানবসভ্যতার সুদীর্ঘ ইতিহাসে প্রমাণিত যে, পৃথিবীর সব জাতি ও সম্প্রদায় কোনো না কোনোভাবে আল্লাহর দরবারে তার প্রিয় বস্তু উৎসর্গ করতেন। উদ্দেশ্য একটাই, আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কোরবানির এক বিশেষ রীতি পদ্ধতি নির্ধারণ করে দিয়েছি, যেন তারা ওইসব পশুর ওপর আল্লাহর নাম নিতে পারে, যা আল্লাহ তাদের দান করেছেন।’Ñ হজ্জ : ৩৪।

কোরবানির শুরু হয়েছিল আদম (আ.)-এর দুই ছেলে হাবিল ও কাবিলের মধ্যে সংঘটিত কোরবানির মাধ্যমে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে রাসুল! আপনি তাদের আদমের পুত্রদ্বয়ের বৃত্তান্ত যথাযথভাবে পাঠ করে শুনান। যখন তারা উভয়েই কোরবানি করেছিল, তখন একজনের কোরবানি কবুল হলো এবং অন্যজনের কোরবানি কবুল হলো না। সে (কাবিল) বলল, আমি তোমাকে অবশ্যই হত্যা করব। অপরজন (হাবিল) বলল, অবশ্যই আল্লাহ মুত্তাকিদের কোরবানি কবুল করেন। সে (হাবিল) বলল, যদি তুমি আমাকে হত্যা করতে আমার দিকে হস্ত প্রসারিত কর, তবু আমি তোমাকে হত্যা করতে তোমার প্রতি হস্ত প্রসারিত করব না। কেননা, আমি বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করি।’Ñ মায়েদা : আয়াত ২৭-২৮। এ হলো কোরবানি কবুল হওয়া ব্যক্তির ভাবাবেগ ও মানসিকতা। কেননা, কোরবানি তাকওয়াবান লোকদের আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের অনন্য নিদর্শন।

বর্তমান মুসলিম মিল্লাতের এই কোরবান বা উৎসর্গের রয়েছে অর্থবহ এক ঐতিহাসিক পটভূমি। ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর সন্তুষ্টির পরীক্ষায় ইসমাইল (আ.) কে কোরবানির স্মৃতিময় ঘটনা নিজেদের মধ্যে বিরাজমান করা। ইবরাহিম (আ.) স্বপ্নে তার সবচেয়ে প্রিয় বস্তু কোরবানি দেওয়ার জন্য আদিষ্ট হন। এজন্য তিন দিনে দৈনিক ১০০ করে মোট ৩০০ উট কোরবানি করলেন; কিন্তু তা আল্লাহর দরবারে কবুল হলো না। বারবারই স্বপ্নে আদেশ করা হলো, ‘তোমার প্রিয় বস্তু কোরবানি করো।’ ইমানের কঠিন পরীক্ষায় শেষ পর্যন্ত ইবরাহিম (আ.) উত্তীর্ণ হন।

ইবরাহিম (আ.) ইসমাইলকে স্বপ্নের কথা অবগত করে তার থেকে জবাইয়ের পরামর্শ চাইলেন। বললেন, অতএব তুমি ভেবে দেখ তোমার অভিমত কী? এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেন, ‘হে ছেলে! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, তোমাকে জবাই করছি। এ বিষয়ে তোমার অভিমত কী? সে (হজরত ইসমাইল (আ.) বলল, ‘পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, আপনি তা পালন করুন। আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন।’Ñ সাফফাত : ১০২।

প্রাণপ্রিয় পুত্র ইসমাইল (আ.) বললেন, আব্বাজান! ইহজগৎ থেকে চিরবিদায় নেওয়ার পূর্বমুহূর্তে আপনি আমার এই প্রার্থনাগুলো মনজুর করুন। ১. আপনি ছুরি খুব ধারালো করে নিন। আর আমার হাত-পা শক্ত করে বেঁধে ফেলুন। যেন আমার অনিচ্ছাকৃত লাফালাফিতে আমার রক্তের ছিটা আপনার কাপড়কে নাপাক না করে। ২. আমাকে মাটির দিকে মুখ করিয়ে শোয়ায়ে দিন, যেন জবাই করার সময় আমার চেহারা আপনি না দেখেন, যা জবাই থেকে বাধা দেবে। ৩. আমার রক্তমিশ্রিত জামা-কাপড় নিয়ে আম্মাজানকে দেবেন। তা হলে আমার আম্মা পুত্রের বিচ্ছেদের যন্ত্রণা লাঘব করতে পারবেন। এক রেওয়ায়েতে আছে যে, ইসমাইল (আ.) কে জবাই করার খবর তার আম্মাকে না দিতে বলেছিলেন।

পরম সত্যের প্রবল আকর্ষণে ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর নির্দেশিত স্বপ্নের বাস্তবায়ন করে প্রাণপ্রিয় পুত্র ইসমাইল (আ.) কে কোরবানি করতে উদ্যত হয়েছিলেন। মুহূর্তে আশ্চর্যজনকভাবে আল্লাহর নির্দেশে ইসমাইল (আ.) সম্পূর্ণ নিরাপদে সংরক্ষিত হলেন এবং সৃষ্টিকর্তার অসীম কুদরতে তদস্থলে পুত্রের বিনিময়ে বেহেশত থেকে আনীত কোরবানিকৃত দুম্বা উৎসর্গিত হলো।

এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেন, ‘যখন তারা (পিতা-পুত্র) উভয়ে আনুগত্য প্রকাশ করল এবং ইবরাহিম তার পুত্রকে (জবাই করার জন্য) কাত করে শায়িত করল, তখন আমি তাকে আহ্বান করে বললাম, ‘হে ইবরাহিম! তুমি তো স্বপ্নাদেশ সত্যই পালন করলে!’ এভাবেই আমি সৎকর্মপরায়ণদের পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চয়ই এটা ছিল এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তাকে (ইসমাইল) মুক্ত করলাম এক মহান কোরবানির বিনিময়ে।’Ñ সাফফাত : ১০৩-১০৭।

আল্লাহর প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে যারা হালাল পশু কোরবানি করবেন, তাদের পুণ্যের আধিক্য সম্পর্কে নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘আদম সন্তান কোরবানির দিন যেসব নেকির কাজ করে থাকে তন্মধ্যে আল্লাহর কাছে সবচেয়ে পছন্দনীয় আমল হলো কোরবানি করা। কিয়ামতের দিন কোরবানির পশু তার শিং, পশম ও খুরসহ উপস্থিত হবে এবং কোরবানির রক্ত জমিনে পড়ার আগেই তা আল্লাহর কাছে কবুল হয়ে যায়। অতএব তোমরা এ পুরস্কারে আন্তরিকভাবে খুশি হও।’Ñ তিরমিজি, ইবনে মাজা ও মিশকাত।

কোরবানির পর মাংসের একটা অংশ চলে যায় আপনজনের মধ্যে, যারা কোরবানি দিতে পারেননি তাদের ও গরিবের ঘরে। তার মানে কোরবানি ঈদে প্রত্যেকের ঘরে ঘরেই পৌঁছে যায় মাংসের ভাগ। কোরবানির ঈদের সবচেয়ে ভালো দিকটি হলো সবার ঘরে মাংস পৌঁছে দেওয়ার এই সাম্যের ধারণা। এর চেয়ে চমৎকার আর কী হতে পারে? অনেক মানুষ আছে, যারা বছরের মধ্যে কোরবানি উপলক্ষেই পরিতৃপ্তিসহকারে একটু মাংস খেতে পারেন। এই সবার ঘরে ঘরে আনন্দ পৌঁছে দেওয়াটাই কোরবানির ঈদের মূল চেতনা। ত্যাগেও যে পাওয়ার আনন্দ আছে, ঈদুল আজহা আমাদের মনে করিয়ে দেয় সেটাই।

কোরবানির দ্বারা মুসলমানরা ঘোষণা করে, তাদের কাছে আপন জানমাল অপেক্ষা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মূল্য অনেক বেশি। সুতরাং কেউ যেন ঈদুল আজহার ত্যাগের মহান আদর্শ থেকে কখনো বিচ্যুত না হয়। আল্লাহর কাছে কোরবানি করা পশুর রক্ত, মাংস, হাড় ইত্যাদি পৌঁছায় না, পৌঁছায় কেবল কোরবানিদাতার আন্তরিকতা, বিশুদ্ধ নিয়ত ও আল্লাহভীতি। এর দ্বারা আল্লাহ মানুষের অন্তরকে যাচাই করেন। কোরবানির মহান শিক্ষা হচ্ছে তাকওয়া অর্জন করা ও অন্তরের পবিত্রতা লাভ এবং সঙ্গে সঙ্গে সব ধরনের হিংসা-বিদ্বেষ ও মনোমালিন্য থেকে মুক্ত থাকা। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না তাদের গোশত এবং রক্ত, বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া। এভাবেই তিনি এদের তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন, যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করো।’Ñ হজ : ৩৭।

‘ত্যাগ’ ছাড়া ঈদুল আজহার আরেকটি বড় শিক্ষা হলো আনন্দ ভাগাভাগি করে নেওয়া। কোরবানির গোশত গরিব আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশী, মিসকিন, দ্বীন-দুঃখী, হতদরিদ্রসহ যত বেশি অভাবী মানুষকে অকাতরে বিলিয়ে দেওয়া যায় ততই উত্তম। এটা তাদের হক বা অধিকার। কোরবানি করে সব ফ্রিজে জমা রেখে সপরিবারে গোশত খাওয়া যেন ধনীদের মনকে পেয়ে না বসে। মানুষের মনের মধ্যে যে পশুশক্তি সুপ্ত বা জাগ্রত অবস্থায় বিরাজমান তা অবশ্যই কোরবান করতে হবে। কেননা, কোরবানির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করা, পশু কোরবানি হচ্ছে আত্মকোরবানির প্রতীক মাত্র।

কোরবানির দিন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ধনী-গরিব নির্বিশেষে এক কাতারে নামাজ আদায়, কোলাকুলি ও শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর কোরবানি করা হয়। এদিনে অশ্রুসিক্ত হয়ে অনেকেই যান কবরস্থানে, বাবা-মাসহ প্রিয়জনদের রুহের মাগফিরাত কামনায়।

পশু কোরবানির মাধ্যমে আমাদের মাঝে বিরাজমান যাবতীয় পশুত্ব তথা নির্মমতা, ক্রোধ, হানাহানি, লোভ, পরশ্রীকাতরতা, সব অশুভ ইচ্ছা ও কুবাসনার কোরবানি হোক, সব কুরিপুর কোরবানি হোক। মানবতাবোধে উজ্জীবিত হওয়ার শিক্ষাই হলো কোরবানির মহান শিক্ষা। সত্য সুন্দর আর পবিত্রতায় সব কুরিপুকে কোরবানি করে ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হোকÑ এই কামনা মহান করুণাময় মেহেরবান আল্লাহর পাকের দরবারে। আল্লাহ তায়ালা মুসলিম উম্মাহকে লোক দেখানোর জন্য কোরবানি নয়, বরং পশুকে জবাইয়ের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে মনের পশু ও আমিত্বকে জবাই করার তাওফিক দান করুন। কোরবানির মাধ্যমে নিজেকে তাকওয়াবান হিসেবে তৈরি করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close