ইসমাইল মাহমুদ
বিশ্লেষণ
বিশ্ব আদিবাসী দিবস
আজ ৯ আগস্ট বিশ্ব আদিবাসী দিবস। বিশ্বের সব আদিবাসীর অধিকার, শত বছরের সমৃৃদ্ধ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে সুরক্ষার লক্ষ্যে প্রতি বছর দিবসটি পালন করা হয়। অস্ট্রেলিয়ায় এবরিজিন, যুক্তরাষ্ট্রে রেড ইন্ডিয়ান, নিউজিল্যান্ডে মাউরি, দক্ষিণ আমেরিকায় ইনকা ও মায়া, জাপানে আইনু, রাশিয়ায় মেনেট, ফ্রান্স ও স্পেনে বাসকু, আরবে বেদুইন আর বাংলাদেশে চাকমা, মারমা, মণিপুরি, গারো, সাঁওতাল, ম্রো, তঞ্চঙ্গা, ত্রিপুরা প্রভৃতি ১৪ জনগোষ্ঠী প্রাচীনকাল থেকেই আদিবাসী হিসেবে বিশ্বে পরিচিত। কিন্তু বর্তমান সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ‘আদিবাসী’ শব্দকে বিলুপ্ত করে ৫০টি জাতিগোষ্ঠীকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সম্প্রতি গেজেট প্রকাশ করেছে।
১৯৯২ সালে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের উন্নয়ন ও সংরক্ষণ উপকমিশনের কর্মকর্তারা তাদের প্রথম সভায় ‘বিশ্ব আদিবাসী দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৯৩ সালকে জাতিসংঘ প্রথমবার বিশ্বে আদিবাসী বর্ষ ঘোষণা করে। পরের বছর ১৯৯৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রতি বছর ৯ আগস্টকে বিশ্ব আদিবাসী দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ ছাড়া জাতিসংঘ ১৯৯৫-২০০৪ এবং ২০০৫-২০১৪ সালকে যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় আদিবাসী দশক ঘোষণা করে; যা সারা বিশ্বে পালিত হয়।
১৯৯৪ সালে বিশ্বে প্রথমবারের মতো দিবসটি পালিত হয়। ওই বছর থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে দিবসটি পালন করে আসছে বিশ্বের কমপক্ষে ৩০ কোটি আদিবাসী। ওই বছর থেকে বিশ্বজুড়ে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস পালন করা শুরু হলেও বাংলাদেশে দিবসটি পালন শুরু হয় ২০০১ সালে। সে বছর ‘বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম’ নামের একটি সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে। ওই সংগঠনের মাধ্যমেই প্রতি বছর বাংলাদেশে বেসরকারিভাবে বৃহৎ পরিসরে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। সে হিসেবে বিশ্বে দিবসটি ২৬তম হলেও বাংলাদেশে আজ ১৯তম আদিবাসী দিবস পালিত হচ্ছে। বিশ্ব আদিবাসী দশক, বর্ষ ও দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আদিবাসী জনগণের মানবাধিকার, পরিবেশ উন্নয়ন, শিক্ষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কিত বিভিন্ন সমস্যা নিরসনে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সুদৃঢ় করা ও গণসচেতনতা সৃষ্টি করা।
জাতিসংঘের তথ্যমতে, বর্তমানে বিশ্বের ৭০টি দেশে ৩০ কোটির অধিক আদিবাসী বাস করে। তাদের অধিকাংশই এখনো মানবিক অধিকারবঞ্চিত। অনেক দেশে আদিবাসীরা এখনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিই পায়নি। আদিবাসীদের কোনো কোনো দেশে উপজাতি, কোনো কোনো দেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বলে অভিহিত করা হয়।
বাংলাদেশের প্রকৃতি আর আদিবাসী একে অপরের পরিপূরক। প্রকৃতি ছাড়া আদিবাসীদের অস্তিত্ব কল্পনা করারও কোনো সুযোগ নেই। আদিবাসী পরিবারে একটি শিশু জন্মগ্রহণ করার পরপরই তার নিগূঢ় বন্ধুত্ব তৈরি হয় প্রকৃতির সঙ্গে। এ যেন হাজারও বছরের চিরাচরিত নিয়ম। তাদের চাষাবাদ, ঘরবাড়ি, আসবাবপত্র, ওষুধপত্র, খাবার-দাবার, জ্বালানিসহ সব কিছু সংগ্রহ করেন প্রকৃতি থেকে। বাংলাদেশ সরকারের তালিকা অনুযায়ী বর্তমানে দেশে ৫০ জাতের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী (আদিবাসী) রয়েছেন। তারা হলোÑ ওরাঁও, কোচ, কোল, খাসিয়া বা খাসি, খিয়ং, খুমি, গারো, চাক, চাকমা, ডালু, তঞ্চঙ্গা, ত্রিপুরা, পাংখোয়া বা পাংখো, বম, বর্মণ, মণিপুরী, মারমা, পাহাড়ি বা মালপাহাড়ি, মুন্ডা, ম্রো, রাখাইন, লুসাই, সাঁওতাল, হাজং, মাহাতো বা কুর্মি মাহাতো বা বেদিয়া মাহাতো, কন্দ, কড়া, গঞ্জু, গড়াইত, গুর্খা, তেলী, তুরি, পাত্র, বাগদী, বানাই, বড়াইক বা বাড়াইক, বেদিয়া, ডিল, ভূমিজ ভূইমালী, মালো বা ঘাসিমালো, মাহালী, মুসহর, রাজোয়াড়, লোহার, শবর, হুদি, হো, খারিয়া বা খাড়িয়া এবং খারওয়ার বা খেড়োয়ার। এসব নৃগোষ্ঠী বা আদিবাসী লোকজনের অধিকাংশই পাহাড়ে ও যৎসামান্য কিছু সমতলে যুগ যুগ ধরে নানা বঞ্চনা ও হয়রানির শিকার হয়ে আসছে। কিন্তু প্রকৃতির সঙ্গে তাদের যে সংযোগ, তা কখনোই বিচ্ছিন্ন হয়নি। প্রকৃতি তাদের দিচ্ছে অঢেল। প্রকৃতির এ দান তারা যেমন গ্রহণ করছে; তেমনি এ দেশের উন্নয়ন, অগ্রগতি, জীব ও প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য রক্ষা এবং বৃদ্ধিকল্পে নৃগোষ্ঠী বা আদিবাসীদের লোকজনও নীরবে-নিভৃতে অবদান রেখে চলেছেন। প্রকৃতির কোলে জন্ম নেওয়া নৃগোষ্ঠীর লোকজন শিশুকাল থেকেই নিজেদের অস্তিত্বের জন্য প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার নিরন্তর সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। নৃগোষ্ঠীর লোকজন আর প্রকৃতির এ নিগূঢ় বন্ধুত্ব পথচলা হাজারও বছরের।
সর্বাধিক স্বীকৃত আদিবাসী সংজ্ঞা হলো, ‘আদিবাসী শব্দের মূল বক্তব্য প্রান্তিকতায় যারা ঐতিহাসিকভাবে শোষণ ও বঞ্চনার শিকার হয়েছে এবং এখনো প্রান্তিক অবস্থানে আছে। যারা আধুনিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময়ে এবং এখনো নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদের শিকার হচ্ছে। যাদের ভাষা, সংস্কৃতি বিলুপ্তপ্রায় এবং যারা সাধারণত রাজনৈতিকভাবে অন্যের অধীনস্থ। আদিবাসীদের অন্য বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে রয়েছে যাদের সমাজ ব্যবস্থা, ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য দেশের মূল স্রোতধারার জনগোষ্ঠীর ভাষা, সংস্কৃতি ইত্যাদি হতে পৃথক। যারা রাষ্ট্রীয় আইনের চেয়ে প্রথাগত আইনের ভিত্তিতে সমাজ পরিচালনা ও অভ্যন্তরীণ বিরোধ নিষ্পত্তি করে। ভূমির সঙ্গে যাদের নিবিড় সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অধ্যাত্মিক স¤পর্ক রয়েছে এবং যারা সাধারণভাবে মূল স্রোতধারার জনগোষ্ঠীর চেয়ে প্রান্তিক অবস্থানে রয়েছে তারাই আদিবাসী।’
আমাদের দেশের উত্তরাঞ্চলের চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ, জয়পুরহাট, রংপুর, দিনাজপুর জেলায় প্রায় ২০ লাখ আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বাস। এ অঞ্চলে প্রায় ৩০টি আদিবাসী জনগোষ্ঠী বাস করে। এদের মধ্য শিং, সাঁওতাল, ওরাঁও, মুন্ডারি, মাহতো, রাজোয়ার, কর্মকার, মাহালী উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ জেলায় রয়েছে প্রায় ৪৫টি আদিবাসী জনগোষ্ঠী। যাদের অধিকাংশেরই জীবন-জীবিকার মূল উৎস পাহাড়ের প্রাকৃতিক সম্পদ।
লেখক : গণমাধ্যম কর্মী ও কলামিস্ট
"