ইসমাইল মাহমুদ

  ০৭ আগস্ট, ২০১৯

বিশ্লেষণ

বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে চাই সামাজিক আন্দোলন

দেশে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সরকার নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে। এ ছাড়া বেসরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) এবং সামাজিক সংগঠনগুলো বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সভা-সমাবশে এবং জনসাধারণ বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে দেশের মানুষের মাঝে বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে অনেকটা সচেতনতা গড়ে উঠেছে। ইতোমধ্যে সরকার দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলাকে বাল্যবিবাহমুক্ত জেলা বা উপজেলা ঘোষণা করেছে। তথাপিও বাল্যবিবাহের পরিমাণ শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি পরিবার বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান রাখে। কিন্তু এ জ্ঞানের বহির্প্রকাশ ঘটান বা জ্ঞানটি সম্পর্কে মূল্যায়ন করেনÑ এমন পরিবারের সংখ্যা এখনো আশাপ্রদ নয়।

আমাদের দেশে বৈধ বিবাহের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে মেয়েদের ১৮ বছর আর ছেলেদের ২১ বছর। এর আগে কোনো ছেলে বা মেয়ের বিয়ে মানেই বাল্যবিবাহÑ এ কথা প্রায় সবারই জানা। সরকারিভাবে প্রতিনিয়তই বাল্যবিবাহ বন্ধ করার জন্য অভিভাবকদের আহ্বান, শাস্তির ব্যবস্থাসহ সচেতনতার জন্য নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। বেসরকারিভাবেও বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তবু কোনোভাবেই পুরোপুরি বন্ধ করা যাচ্ছে না বাল্যবিবাহ বা বাল্যবিয়ে নামের এই ব্যাধি।

আমাদের দেশের গ্রামগুলোতে একটা সময় গ্রাম্য পঞ্চায়েতের মাধ্যমে ধুমধাম করে ঢোল পিটিয়ে, হইহুলোড় করে, রং মাখামাখি করে বিয়ের উৎসব হতো। বিয়ের অনুষ্ঠান মানেই মজার সব আয়োজন। কিন্তু বর্তমান সময়ে এমন আয়োজন খুব একটা চোখে পড়ে না। এখন দেশে প্রতিদিন গড়ে যতগুলো বিয়ে হয় তার অর্ধেকের বেশি হয় অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। কোথাও কোথাও এমন গোপনে বিয়ে হয় যে, পাড়াপড়শিও জানতে পারে না খবরটি। এমনও দেখা যায়, এক বাড়িতে বিয়ে হচ্ছে অথচ পাশের বাড়ির লোকজন বিষয়টি জানেই না। কেন এমন গোপনীয়ভাবে বিয়ে হচ্ছে? কেনইবা এত রাখঢাক? কারণ কী? আসলে কারণ একটাই, একসময় আমাদের দেশে বিয়ের কোনো বয়স ছিল না। তথ্যানু সন্ধানে এমন ঘটনাও পাওয়া যায়, পঞ্চাশ বা ষাটের দশকে গ্রামাঞ্চলে ৬-৭ বছরের কোনো মেয়েশিশুর সঙ্গে ৮-১০ বছরের ছেলেশিশুর বিয়ে পর্যন্ত হয়েছে। দুই পক্ষের অভিভাবকদের ইচ্ছাতে বিয়ে হলেও বিয়ের বর ও কনে জানতই না বিয়ে কী জিনিস। বর্তমান সময়ে ৬-৭ বছর বয়সি মেয়েশিশুর বিয়ের খবর কোথাও খুঁজে পাওয়া না গেলেও অনেক গ্রামে এখনো ১১-১২ বছরের মেয়েশিশুর সঙ্গে ১৫-১৬ বছরের ছেলেশিশুর বিয়ের খবর শোনা যায়। কোথাও কোথাও দরিদ্র পরিবারের ১১-১২ বছরের মেয়েশিশুকে এলাকার প্রভাবশালী পরিবারের বয়োবৃদ্ধের কাছে বিয়ে দেওয়ার নজিরও চোখে পড়ে। বিশেষ করে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গোপনীয়তা অবলম্বন করা হয়। আর এসব বিয়েতে সহায়তা করেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সমাজপতি ও স্থানীয় কাজী। জনপ্রতিনিধিরা মেয়ে বা ছেলের বয়স বাড়িয়ে বা নাম বদলে জন্মনিবন্ধন করার প্রবণতাও উল্লেখযোগ্য।

গ্রামের সমাজপতিরা এসব বিয়ের খবর জানেন। রাতের অন্ধকারে গোপনে এসব বিয়ে আয়োজনের খবর জেনেও তারা চুপচাপ থাকেন। কখনো কখনো বাল্যবিবাহ সম্পর্কে সমাজের সচেতন মানুষ জানার পর প্রতিবাদ করলে মেয়ের পরিবার থেকে বলা হয়, স্কুলে বা বাড়িতে বখাটে অমুক মেয়েটিকে যন্ত্রণা দেয়। তার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে মেয়েকে দ্রুত পাত্রস্থ করতে হচ্ছে। কোনো কোনো পরিবার থেকে বলা হয়, গরিবের সংসারে মেয়েটি অনেকটা বোঝা। তাই ভালো বা পয়সাওয়ালা অথবা প্রবাসী পাত্র পেয়ে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন। এমন অনেক অজুহাত থাকে বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে। কোনো কোনো স্থানে যে মৌলভী সাহেব বিয়ে পড়ান, তিনি ফতোয়া দেন পৃথিবী সৃষ্টি থেকে কোটি কোটি মেয়ের ৬-৭ বছরে বিয়ে হলো, কই কারো তো কোনো ক্ষতি হয়নি। এখন হবে কেন? আবার দেখা গেল, মৌলভী সাহেব যদি বাল্যবিবাহ পড়াতে না চান, তবে সমাজপতিরা বাল্যবিবাহ পড়াতে তাদের বাধ্য করেন। এ অবস্থায় কখনো কোনো সচেতন মানুষ বা প্রশাসন যদি খবর পেয়ে বিয়ের মজলিসে উপস্থিত হন, তবে তিনি বা তাকে সদ্য কিনে নিয়ে আসা নতুন জন্মসনদটা দেখানো হয়। বিয়ে মজলিসে কেউ উপস্থিত হলে মানবতার দোহাইও দেওয়া হয়। বলা হয়, ‘আজ বিয়ে ভেঙে গেলে এ মেয়েকে নিয়ে সমাজে মুখ দেখাতে পারব না।’ সমাজে বর্তমানে এভাবেই চলছে বাল্যবিবাহ।

গ্রামাঞ্চলের অনেক অভিভাবক ভাবেন তার পরিবারের মানসম্মানের কথা, ভাবেন তিনি সমাজের অতি দরিদ্র একজন মানুষ। যেদিন তার কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করল, সেদিন থেকেই যেন পরিবারের কর্তার মাথায় একটা পাহাড়সম বোঝা চেপে বসল। সেদিন থেকেই চিন্তায় চিন্তায় তার জীবন যেন ছারখার! তার মেয়েটা একটু বড় হওয়ার পর বয়সে বড় না হলেও দেখতে বড় হলে চিন্তার মাত্রাটা দ্বিগুণ হয়ে যায়। কোনোমতে ১১-১২ বছর হলেই পরিবারের কর্তার দিন-রাত দৌড় শুরু হয়ে যায় ঘটকের পেছনে। যেন কোনোমতে বিয়েটা দিতে পারলেই তিনি দম ফেলে বাঁচেন।

আসলেই কি তাই? মেয়েকে অপরিণত বয়সে বিয়ে দিয়ে পরিবারের কর্তা কি বাঁচলেন? অনেক ক্ষেত্রে এমন ধারণা ভুল প্রমাণিত হচ্ছে। পরিবারের কর্তা নিজ হাতে তার কন্যার একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ নষ্ট করলেন। তিনি নিজেও ডুব দিলেন অমানিষার কালো অন্ধকারে। অপরিণত বয়সের মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার পর অধিকাংশ সময়ই প্রথম যে জিনিসটি সামনে আসে তা হলো, বিয়ের কিছুদিন পর স্বামীর বাড়ি থেকে মেয়েটি এসে আর স্বামীর বাড়ি ফিরতে চায় নাÑ এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে আমাদের সমাজে। যখন তার পুতুল খেলার বয়স তখনই যদি থাকে সংসার নামক শৃঙ্খলে বন্দি করা হয় তাতে লাভের চেয়ে ক্ষতির পরিমাণই বেশি হয়ে থাকে। যখন অভিভাবকরা কোনোমতেই বুঝিয়ে-সুঝিয়েও মেয়েকে আর স্বামীর বাড়ি পাঠাতে পারেন না; তখন সমাজপতিরা এ নিয়ে বিচার-সালিসে বসেন। অথবা মামলা, থানা, আদালত করে সময় কাটাতে হয় অভিভাবকদের। বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়ই তালাকের মাধ্যমে বিয়ের কবর রচিত হয়। আজকাল আমাদের সমাজে এ ধরনের ঘটনা অহরহ ঘটছে। তথ্যানুসন্ধানে দেখা গেছে, বর্তমান সময়ে যেসব স্বামী-স্ত্রীর তালাক হচ্ছে, তাদের অধিকাংশই বাল্যবিবাহের শিকার। তাই বাল্যবিবাহের বিষয়ে সচেতন হতে হবে আমাকে-আপনাকে সবাইকে।

অল্প বয়সে বেশির ভাগ মাতৃমৃত্যুর প্রধান কারণ বাল্যবিবাহ। দেশে মা ও শিশুমৃত্যুর মূল কারণ ১৮ বছরের কম বয়সিদের মা হওয়া। কিশোরী মায়ের মৃত্যুঝুঁকি প্রাপ্তবয়স্ক মায়ের তুলনায় অন্তত চার গুণ বেশি বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। এক বেসরকারি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বাংলাদেশের ৬৫ শতাংশ কিশোরীর বিয়ে হয় ১৮ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগেই। বাল্যবিবাহের কারণে মাতৃমৃত্যু কিংবা শিশুমৃত্যুর ঝুঁকি অনেক বেশি হয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে নাবালিকা মেয়ে মা হওয়ায় কীভাবে শিশুকে পরিচর্যা করবে; সে সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকে না। এর ফলে মা ও শিশুর মৃত্যু ঘটতে পারে। বাল্যবিবাহের কারণে নারীর প্রতি সহিংসতা, মাতৃমৃত্যুও ঝুঁকি, অপরিণত গর্ভধারণ, প্রসবকালীন শিশুর মৃত্যুঝুঁকি, প্রজনন স্বাস্থ্য সমস্যা, নারীশিক্ষার হার হ্রাস, স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হার বৃদ্ধি, নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার ক্ষমতা ও সুযোগ কমে যাওয়াসহ নানা রকম নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা থাকে। সরকারি ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার পাশাপাশি বাল্যবিবাহবিরোধী পদক্ষেপের সঙ্গে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে। সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে মা ও শিশুর মৃত্যুহার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব বলে ওই পরিসংখ্যানে প্রকাশ।

পরিশেষে বলা যায়, আপনার অপরিণত মেয়েকে আপনার অভিলাষের বলি বানাবেন না। তার বিয়ের খরচ, মালামালের খরচ বা পাত্র পক্ষের চাহিদা অনুযায়ী যৌতুক যা দেবেন, তা দিয়ে মেয়েটির লেখাপড়ার খরচ জোগান। দেখবেন লেখাপড়া করে ওই মেয়েটিই একসময় নিজের পায়ে দাঁড়াবে। হয়তো সরকারি বা বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানে বড়মাপের কর্মকর্তা হবে। তখন তাকে বিয়ে করার জন্য সমাজের উন্নত পরিবারের ছেলেদের লাইন পড়ে যাবে। বর্তমান সরকার প্রতিটি শিশুকে শিক্ষাদানের লক্ষ্যে প্রতি বছরের জানুয়ারি মাসের ১ তারিখেই এখন নতুন বই দিচ্ছে, শিক্ষাবৃত্তি দিচ্ছে। এ ছাড়া বিনা বেতনে লেখাপড়ার সুযোগ তো আছেই। তা হলে কেন আপনার দুমুঠো অন্ন সাবাড় করছে বলে তাকে বাল্যবিবাহের পিঁড়িতে ঠেলে দিচ্ছেন? আসুন আপনি-আমি সবাই সচেতন হই এবং সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে বাল্যবিবাহ নামের ব্যাধিটা সমাজ থেকে চিরতরে বিদায়ের ব্যবস্থা করি।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close