ইয়াসমীন রীমা

  ০৫ আগস্ট, ২০১৯

মুক্তমত

স্বাস্থ্যঝুঁকিতে শিশুরা

কুমিল্লা নগরীর রেইসকোর্স এলাকার সানসাইন চাইল্ড একাডেমির পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস পার্টিতে এসে হঠাৎ করে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে দিলজান। দিলজানের এখন বয়স ১০। খবর পেয়ে দিলজানের মা ছু্েট আসেন। স্থানীয় একটি প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার তৎক্ষণিক জ্ঞান ফিরিয়ে আনলেও পরবর্তী এই জ্ঞান হারিয়ে ফেলার কারণ উদ্ঘাটনের জন্য জরুরিভাবে চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শ দিলেন। দিলজান মা-বাবার একমাত্র ছেলে। দিলজানের বাবাই প্রতিদিনের মতো তাকে সকালে মোটরবাইকের পেছনে বসিয়ে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে গেছে। তিনি একটি মালিকানাধীন ফার্মের প্রধান হিসাবরক্ষক। মা আতিয়া মোবারক গৃহশিক্ষিকা। ডাক্তারের কথানুযায়ী দিলজানের ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে জানা গেল, ফুড পয়জনিং। অর্থাৎ দোকানের প্যাকেটজাত খাদ্য খেয়ে তার বিষক্রিয়ায় তার এই হাল হয়েছিল। বেশ কয়েক দিন ধরে দিলজান প্রতিদিনই স্কুলের সামনে বসে থাকা ফেরিওয়ালার কাছ থেকে বরই আচার ও শিঙারা কিনে খেয়েছে। তাছাড়া বন্ধুদের দেওয়া ঝালমুড়িও খেয়েছে। প্রতিটি খাদ্যে পরীক্ষা করলে দেখা যাবে ভেজাল দিয়ে ভরা। যা কিনা শিশুদের উপযোগী খাদ্য নয়।

দিলজানের মতো সারা দেশে বিশেষ করে স্কুলগামী শিশুরা ভেজাল দ্রব্য খেয়ে দিন দিন অসুস্থ হয়ে পড়ছে। কাপড়ে ব্যবহৃত রং, কৃত্রিম ফ্লেভার, ঘনচিনি ও স্যাকরিণের দ্রবণ মিশিয়ে তৈরি হচ্ছে বিভিন ধরনের জুস এবং জেলিসহ ভেজাল খাদ্য ও পণ্য। আর এসব পণ্যের প্রধান ভোক্তা হচ্ছে শিশুরা। যাতে তাদের মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়তে হচ্ছে। মূলত বস্তি এলাকা বাইরের শহরগুলোতে বিক্রির জন্য এ ধরনের ভেজাল পণ্য উৎপাদন করা হয়। আর প্রধানত শিশুরা এগুলোর ক্রেতা। ভেজাল খাবার খেয়ে শিশুরা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে উপনীত হচ্ছে। তাদের দেহে এসব উৎপাদন ‘সেøা পয়জনিং’-এর মতো কাজ করছে। মূলত দুভাবে শিশুরা বিষাক্ত খাদ্য গ্রহণ করছে। প্রথমত. শিশুদের পছন্দের খাবার যেমনÑ জুস, চকলেট, জেলি, আচার, বরফি ইত্যাদি যাতে অতি নিম্নমানের ও ভেজাল রাসায়নিক উপাদান প্রয়োগ করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত. বিভিন্ন ধরনের দেশি-বিদেশি ফল, সবজিতে অতিমাত্রায় কীটনাশকের ব্যবহার, মাছ বা সবজিতে ফরমালিনের ব্যবহার।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) জরিপে, ভেজাল বা দূষিত খাবার খেয়ে প্রতি বছর প্রায় ৪ লাখ ২০ হাজার শিশুর মৃত্যু ঘটছে। যাদের এক-তৃতীয়াংশের বেশি হচ্ছে পাঁচ বছরের নিচে। তাছাড়া নিরাপদ খাদ্য ও পানির অভাবে দক্ষিণ ও পূর্ব-দক্ষিণ এশিয়ায় বছরে ৭ লাখ ডায়ারিয়ায় আক্রান্ত হয়ে শিশুর মৃত্যু ঘটে আর সারা বিশ্বে ঘটে ২২ লাখ শিশু। ভেজালমুক্ত খাদ্য ও নিরাপদ পানির নিশ্চয়তা না বাড়াতে পারলে ডায়ারিয়ায় আক্রান্ত হয়ে শিশু মৃত্যুর সংখ্যা খুব দ্রুত বেড়ে দ্বিগুণ হবে। তাছাড়া গত তিন বছরে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যার মধ্যে ডায়ারিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাই বেশি। বেঁচে থাকার অভিপ্রায়ে প্রতিটি শিশু নারী পুরুষের দুটি গুরুত্বর্পূণ উপাদান হচ্ছে ভেজালমুক্ত খাদ্য ও নিরাপদ পানি। আর তা যদি অনিরাপদ ভেজালযুক্ত হয়ে পড়ে, তা হলে কারো পক্ষে সুস্থ জীবন বজায় রাখা কঠিন। তাই উৎপত্তিস্থল থেকে মুখে গ্রহণ করার পূর্ব পর্যন্ত খাদ্য ভেজালমুক্ত রাখতেই হবে।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইিডিসিআর) কারিগরি উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘প্রতিদিন প্রচুর পেটের পীড়ার শিশু রোগী হাসপাতালে আসছে, যারা সরাসরি ভেজাল খাদ্যে আক্রান্ত। তাছাড়া ভেজাল খাবার শিশুদের নানাভাবে ক্ষতিসাধন করে। প্রক্রিয়াজাত খাবার ছাড়াও সাধারণ শাকসবজি, মাছেও অতিরিক্ত কীটনাশক ও প্রিজারভেটিভ প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। কীটনাশক একবার দেহে প্রবেশ করলে জীবনভর ক্ষতি করতে থাকে। আর বেরোতে চায় না। তার উপস্থিতিতে অস্থিমজ্জা, যা শরীরে রক্ত তৈরি করে তা-ও কার্যকারিতা হারাতে পারে। ভেজাল ও খাদ্য বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ২০১৩ সালে কেবলমাত্র দিনাজপুর জেলায় ১৩টি শিশুর মৃত্যু ঘটে।’

এদিকে আইন থাকার পরও কেবল বিধিমালা না হওয়ায় মাতৃদুগ্ধ বিকল্প শিশুখাদ্য বিক্রয় ও বিপণন বিষয়ে কোনো আইনি পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। বিভিন্ন সুপারসপ, মুদি দোকান, কনফেকশনারির মতো দোকান ঘুরে দেখা যায়, অবাধে প্রদর্শন ও বিক্রি হচ্ছে মাতৃদুগ্ধের বিকল্প শিশুখাদ্য। যা পুরোপুরি ভেজালমুক্ত নয়। শিশুদের জন্য ক্ষতিকর এ ধরনের পণ্য। বিশেষভাবে প্রদর্শনের জন্য দোকানের মালিকপক্ষের সঙ্গে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন চুক্তিও হয়ে থাকে বলে জানা গেছে। শিশু স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মতামত প্রকাশ করছেন, জন্মের পর থেকে গুঁড়া দুধসহ বিকল্প ভেজালযুক্ত শিশুখাদ্য গ্রহণের ফলে শিশুরা অপুষ্টিতে আক্রান্ত হয়। শিশুর দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা না বেড়ে ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। ফলে ওই শিশুদের ডায়ারিয়া, নিউমোনিয়া, অন্ধত্ব, ত্বকে ঘা, রক্তস্বল্পতাসহ নানা জটিল রোগ দেখা দেয়। এভাবে বিভিন্ন রোগ ও অপুষ্টিজনিত কারণে প্রতিদিন ৫ বছরের কম বয়সি শিশুদের মধ্যে প্রায় ২০০ শিশু মারা যায়।

খাদ্যনিরাপত্তা বলতে জীবাণু ও পরজীবীদুষ্ট নয়, এমন খাবারকেই বোঝানো হয়ে থাকে। যাতে থাকবে না কোনো ক্ষতিকারক রাসায়নিক দ্রব্য এবং যা প্রাকৃতিকভাবে তৈরি বিষ থেকে মুক্ত থাকবে। অনেক ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ কোনো না কোনোভাবে খাদ্যচক্র বা পানির মাধ্যমে শিশু দেহাভ্যন্তরে প্রবেশ করছে এবং বিশেষ করে শিশুরা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। তাই নীতিনির্ধারকদের বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে কার্যকর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। সমাজের সবস্তরের শিশুর অভিভাবকদের সজাগ হতে হবে এখনই। নইলে সামনে অপেক্ষা করছে ভয়াবহ মুহূর্ত।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও গবেষক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close