নিতাই চন্দ্র রায়

  ০৫ আগস্ট, ২০১৯

রোগ প্রতিরোধ

জনসচেতনতার বিকল্প নেই

রাজধানী ঢাকা থেকে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে দেশের ৬৪ জেলায়। সরকারের হেল্থ ইমার্জেন্সি অপারেশন ও কন্ট্রোল রুমের ২ আগস্টের তথ্য থেকে জানা যায়, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে ১ হাজার ৭১২ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। সরকারের হিসাবে এ পর্যন্ত ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা আরো অনেক বেশি। ঢাকার বাইরেও ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। মির্জাপুরের কুমুদিনী হাসপাতালে ১ আগস্ট পর্যন্ত ৫৫ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ২৮ জন চিকিৎসাধীন। শেরপুর জেলা সদর হাসপাতালেও কয়েকজন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি করা হয়েছে। দেশে যখন ডেঙ্গু রোগ ভয়াবহ আকার ধারণ করছে, সারা দেশের মানুষ যখন মহা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে, নিজেদের বসতবাড়ি ও কর্মস্থল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কাজে ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করছে, তখন দেশের সব পৌরসভার কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা সরকারি তহবিল থেকে বেতন, বোনাস ও পেনশন প্রদানের দাবিতে গত ১৪ জুলাই থেকে অবিরাম ধর্মঘট চালিয়ে যাচ্ছেন। টানা ২০ দিনের এ ধর্মঘটে প্রায় অচল হয়ে পড়েছে নাগরিক জীবন। ধর্র্মঘটের অংশ হিসেবে পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা শহরের ময়লা-আবর্জনা অপসারণের কাজ বন্ধ রেখেছেন। ফলে দেশের পৌরসভাগুলোর বিভিন্ন রাস্তার ধারে, বাসাবাড়ির আশপাশে, এখানে-সেখানে ময়লার স্তূপ জমে এক অস্বাস্থ্যকর ভুতুড়ে পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে।

কারো কারো মতে, দেশের ময়লা-আবর্জনা পূর্ণ শহরগুলো বর্ষা মৌসুমে এডিস মশার অভয়াশ্রম হয়ে উঠতে পারে। হয়ে উঠতে পারে এডিস মশার লার্ভাগুলোর বংশ বিস্তারের জন্য উপযুক্ত স্থান। ফলে ডেঙ্গু সারা দেশের পৌর এলাকায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে। ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে এ মরণব্যাধি। তাই দেশের এই দুর্দিনে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের অবিলম্বে ধর্মঘট ত্যাগ করে পৌরবাসীদের সহযোগিতায় শহরে জমে থাকা ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার কাজে আত্মনিয়োগ করা উচিত। জাতির এই দুর্দিনে কর্মবিরতির নামে পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থাকার কোনো অবকাশ নেই। অবকাশ নেই পৌরসভার অন্যান্য বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ধর্মঘট করার। কারণ এটা আন্দোলনের সময় নয়, এটা দাবি আদায়ের মুহূর্ত নয়। এটা পৌরবাসীদের ভয়াবহ ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ থেকে বাঁচানোর সময়। অন্যথায় তাদের কর্মবিরতির কারণে দেশের শহরগুলোতে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা বৃদ্ধি পেলে, মানুষের মৃত্যুর কারণ হলে জাতি তাদের কোনো দিন ক্ষমা করবে না এবং বিবেকের কাছেও তারা দায়ী থাকবেন। এ ব্যাপারে পৌরসভাগুলোর সচেতন নাগরিকদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ ও বিক্ষোভ সৃষ্টি হচ্ছে। দেশের প্রায় ৫ কোটি নগরবাসীকে ডেঙ্গুর মতো একটি মারাত্মক রোগের মধ্যে ঠেলে দিয়ে অবিরাম ধর্মঘটের নামে শহর অপরিষ্কার রাখার মতো কাজ কোনো অবস্থাতেই নৈতিক ও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে সমর্থনযোগ্য নয়।

আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের কলকাতাতেও একসময় ডেঙ্গুর প্রচন্ড প্রকোপ ছিল। কলকাতার পৌর কর্তৃপক্ষ ও স্বাস্থ্য বিভাগ তাদের কঠোর পরিশ্রম এবং কর্মকৌশল দিয়ে ডেঙ্গু মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছে। কলকাতা পৌর কর্তৃপক্ষ যদি পারে, তা হলে আমাদের না পারার কোনো কারণ থাকতে পারে না। আমরা তাদের সফলতার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে পারি। এজন্য প্রয়োজন বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করে সঠিক কর্মকৌশল অবলম্বন করা। ডেঙ্গু দমনের ব্যাপারে আমাদের দেশে একটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। কারণ গবেষণা ছাড়া এই মারাত্মক রোগ দমনে টেকসই সফলতা পাওয়া যাবে না।

এডিস মশার প্রজননস্থল ও লার্ভা ধবংস না করলে উপদ্রব বাড়তে থাকে। একটি স্ত্রী মশা তার জীবনকালে ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার ২৫০টি ডিম পাড়ে। আর ডিম পাড়ার জন্য মানুষকে কামরানো ও রক্ত পান করতে হয়। ওষুধ ছিটালে কিছুক্ষণের জন্য মশা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে থাকে বা কিছু মারা যায়। মশার লার্ভা সাধারণত এক থেকে দেড় ফিট পানিতে থাকে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কোনো বিকল্প নেই। ঘরবাড়ি ও আঙিনা সব সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মহির উদ্দিন ও মহাখালী স্বাস্থ্য অধিদফতরের সিনিয়র কীটতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ রেজাউল করিমের কাছ থেকে এসব তথ্য জানা যায়। মহাখালী স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, এডিস মশার কামড়ে এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গু জ্বরে মোট আক্রান্ত হয়েছে ১৯ হাজার ৫১৩ জন। এখনো হাসপাতালে ভর্তি আছে ৫ হাজার ৮৩৮ জন। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মহির উদ্দিনের মতে, এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গু জ্বর, চিকনগুনিয়া ও ইউরো ফিভার হয়। মশা দমন করতে হলে ফুলের টব, ডাবের খোসা, টায়ার-টিউবে যাতে পানি না জমে থাকে; সে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পরিবেশ সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। বাসাবাড়ির কোনো স্থানে পানি জমিয়ে রাখা যাবে না। এমনকি গ্লাস ও জগে যাতে পানি জমে না থাকে, তার জন্যও পদক্ষেপ নিতে হবে। মহাখালী স্বাস্থ্য অধিদফতরের সিনিয়র কীটতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ রেজাউর করিম খানের মতে, স্ত্রী মশা দুই দিন পর পর ডিম পাড়ে। এ মশা বাঁচে মাত্র এক মাস। এক মাসে একটি মশা ১৫ বার ডিম পাড়ে। প্রতিবারে একটি স্ত্রী মশা ১২০ থেকে ১৫০টি ডিম পাড়ে। ডিম পাড়ার জন্য রক্ত পান করতে হয়। দিনে একটি এডিস মশা ৪ থেকে ৫ জনকে কামরায়। আর এডিস মশা ৫০০ মিটার পর্যন্ত উড়তে পারে। বর্তমানে থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে পরিষ্কার ও স্বচ্ছ পানিতে এডিস মশা ডিম পাড়ে। এ মুহূর্তে মশা দমন ও মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করার জন্য ক্রাশ প্রোগ্রাম চালু করা দরকার। না হলে চলতি মাসে এর প্রকোপ আরো বাড়তে পারে। তিনি আরো বলেন, পূর্ণাঙ্গ মশা দমনে কার্যকর কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে। একই জায়গায় বা একই ঘরে ১০

দিনে চারবার কীটনাশক প্রয়োগের মাধ্যমে মশা দমন করা সম্ভব হবে। একই সঙ্গে এডিস মশার লার্ভা দমনে কার্যকরী লার্ভিসাইড প্রয়োগ করতে হবে। লার্ভা দমনের জন্য একই জায়গায় প্রথম, দ্বিতীয়, সপ্তম ও দশম দিনÑ এই চারবার লার্ভিসাইড প্রয়োগ করতে হবে।

বাংলাদেশের পাশাপাশি এশিয়ার কয়েকটি দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ডেঙ্গুর বিস্তার ঠেকাতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে ফিলিপাইনের মতো দেশ। ইতোমধ্যে দেশটিতে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ফিলিপাইন জুড়ে শনাক্ত করা হয়েছে ১ লাখেরও বেশি ডেঙ্গু রোগী। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় আক্রান্তের সংখ্যা ৮৫ শতাংশ বেড়েছে। এ ছাড়া শ্রীলঙ্কায় ২৯ হাজার, মালয়েশিয়ায় ৪০ হাজার এবং সিঙ্গাপুরে ৮ হাজারের বেশি মানুষ ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়েছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে ব্যাপকভাবে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ে। সেসময় গ্রাম থেকে শহরে আসা মানুষের আবাসনের জন্য দ্রুত নগরায়ণ করতে হয়। সে নগরায়ণ ছিল অপরিকল্পিত। সেখানে পরিকল্পিত ড্রেনেজে ব্যবস্থা না থাকায় ডেঙ্গুর কারণে নগরবাসীর ভোগান্তি বেড়ে যায়। চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফিলিপাইন। ১ লাখ ১৫ হাজারের বেশি মানুষ ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়েছে। মারা গেছে ৫০০ জনেরও বেশি মানুষ। তাদের সিংহভাগই শিশু। ১৯৫৩ ও ১৯৫৪ সালে ফিলিপাইনে প্রথম মহামারি আকারে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ১৯৫০-এর দিকে থাইল্যান্ডে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়লেও ১৯৫৮ সালে তা ভয়াবহ আকার ধারণ করে। তখন অনেক মানুষের প্রাণহানি ঘটে। চলতি বছর সিঙ্গাপুরে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্তকারীদের সংখ্যা অতীতের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে। আট হাজারের মতো এ বছর আক্রান্ত হয়েছে। মারা গেছে পাঁচজন। সেদেশে ডেঙ্গু দমনের জন্য সরকার তিনটি আইন পাস করেছে। এ আইনের অধীনে ডেঙ্গু বিস্তারের মতো পরিবেশের কারণ তৈরি করলে নাগরিকদের শাস্তি ভোগ করতে হয়। আমাদের দেশেও অনুরূপ আইন পাস করাটা জরুরি হয়ে পড়েছে। ডেঙ্গু নির্মূলে ভারত এগিয়ে রয়েছে।

কার্যকরভাবে ডেঙ্গু দমন করতে হলে দেশের সব নাগরিকের মধ্যে ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। এজন্য দেশের সব গ্রাম ও শহরে মে মাসের প্রথম সপ্তাহকে জাতীয় ডেঙ্গু প্রতিরোধ সপ্তাহ হিসেবে পালন করা যেতে পারে। এই কর্মসূচির সঙ্গে দেশের সব স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, রাজনীতিবিদ, কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি, স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি, শিক্ষক, সাংবাদিক, শিল্পপতি, চিকিৎসক, চাকরিজীবী, কীটতত্ত্ববিদ, পরিবেশবিদ, সাংস্কৃতিক কর্মী, শ্রমিক-কর্মচারী, স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতা কর্মীসহ সব পেশার মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে প্রত্যেক নাগরিকের বাড়িঘর, অফিস-আদালত ও কর্মস্থলের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। ধ্বংস কতে হবে এডিস মশা, মশার লার্ভা ও তাদের প্রজননস্থল।

লেখক : কৃষিবিদ ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close