ইসমাইল মাহমুদ

  ০৪ আগস্ট, ২০১৯

মুক্তমত

ভিআইপির চাপে...

ভিআইপির প্রটোকলের কারণে মাদারীপুর জেলার কাঁঠালবাড়ী ১ নম্বর ফেরিঘাটে তিন ঘণ্টা ফেরি চলাচল বন্ধ রাখায় অ্যাম্বুলেন্সে থাকা সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্মকভাবে আহত নড়াইলের কালিয়া পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির মেধাবী ছাত্র ১১ বছর বয়সি তিতাসের করুণ মৃত্যু সারা দেশের সাধারণ মানুষের হৃদয়কে নাড়া দিয়েছে। ভিআইপির চাপে পদদলিত হয়েছে মানবতা। একজন মানুষের জীবন যেন একেবারে তুচ্ছ ‘ভিআইপি’ নামক মর্যাদার কাছে। দিনে দিনে দেশের অধিকাংশ মানুষের বোধের মাত্রা যেন শূন্যের কোঠায় এসে দাঁড়িয়েছে। সন্তানের জীবন বাঁচাতে ফেরিঘাটের ম্যানেজারের পায়ে ধরে মাটিতে গড়িয়ে কাকুতি-মিনতি করেছেন মমতাময়ী মা। তার চোখের জলে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হলেও পাষাণের মন এতটুকুও গলেনি। ৩০ লাখ শহীদ ও ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন এ দেশের সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়নে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার দিন-রাত নিরবধি কাজ করলেও সরকারের অংশ ধ্বজাধারী কারো কারো জন্য বর্তমান সরকারের সুবিশাল অর্জন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। দেখে-শুনে মনে হচ্ছে, এ দেশে জীবনের দামের চেয়ে ভিআইপিদের মর্যাদার দাম বেশি!

দেশের বিভিন্ন জেলায় জেলা প্রশাসকের আদেশ যেন ওই জেলার সবার কাছে শিরোধার্য। সেটি শুদ্ধ হোক বা ভুল হোক কোন অসুবিধা নেই। হোক না সেটি মানবতা বিবর্জিত! মাদারীপুরের জেলা প্রশাসকের আদেশ আমলে নিয়ে ওই আদেশ শতভাগ তামিল করেছেন ফেরিঘাট ম্যানেজার আবদুস সালাম তার (ফেরিঘাট ম্যানেজার) বক্তব্যের সূত্রে এমন সংবাদ গণমাধ্যমে এসেছে। আর এ আদেশের বলি হয়েছে সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হয়ে উন্নত চিকিৎসা নিতে অ্যাম্বুলেন্সে করে আসা ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র তিতাস। তার বাঁচার সব পথই বন্ধ হয়ে যায় এক আদেশে। তিতাসের পরিবার তথা মায়ের আবেদনও ভিআইপির প্রটোকলের কারণে মানবিকভাবেও সাড়া দেয়নি ফেরিঘাট ম্যানেজার। ওই ফেরি নদী পাড়ি দিতে আধাঘণ্টা সময়ও লাগার কথা নয়। কিন্তু ভিআইপি নামক যন্ত্রণার কারণে ফেরিটি তিন ঘণ্টা বন্ধ করে রাখা হয়। পরে কথিত সেই ভিআইপি যুগ্ম সচিবের জন্য তিন ঘণ্টা অপেক্ষার পর ফেরিটি নদী পাড়ি দেওয়া শুরু করলেও মাঝপথেই সবাইকে ছেড়ে পরকালে চলে যায় তিতাস নামের ফুটফুটে ওই বালক। এ নিয়ে দেশে আলোড়ন সৃষ্টি হলে নৌ মন্ত্রণালয় ঘটনার তদন্তে একটি কমিটি গঠন করেছে। কমিটি যথানিয়মে কাজ করবে, ঘটনার তদন্ত করবে, তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবে। কিন্তু তাতে লাভ কি?। তিতাসের জীবন তো আর ফিরে আসবে না। সেই ভিআইপি’র কাছে তিতাসের পরিবারের কান্না আর আকুতির পরাজয়তো এরই মধ্যে নিশ্চিত হয়েছে।

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সচিব মো. আবদুুস সালাম ঘটনা সম্পর্কে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ফেরি যাবে আসবে কমন বিষয়। মুমূর্ষু রোগীদের জন্য গুরুত্ব বেশি দেওয়া হয় ঘাটে। কিন্তু কোনো ভিআইপির জন্য অপেক্ষা করতে হবে তা কোনো ক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়। ভিআইপিদের জন্য দরকার হলে আলাদা ব্যবস্থা করতে হবে। সাধারণ জনগণকে কোনোক্রমেই ভোগান্তিতে ফেলা যাবে না।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে দেখা যায়, গত ২৫ জুলাই রাত ৮টায় গুরুতর আহত তিতাসকে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সটি কাঁঠালবাড়ি ১ নম্বর ফেরিঘাটে পৌঁছলে ‘কুমিল্লা’ নামে ফেরিটি ওই ঘাটেই ছিল। কিন্তু সরকারের ‘এটুআই’ প্রকল্পের যুগ্ম সচিব আবদুস সবুর ম-লের গাড়ি যাবে-এই নির্দেশনা থাকায় ফেরি তিন ঘণ্টা ছাড়েনি ঘাট কর্তৃপক্ষ। শেষ পর্যন্ত রাত ১১টার দিকে যুগ্ম সচিবের গাড়ি ঘাটে পৌঁছলে ফেরি ‘কুমিল্লা’ রওনা হয়। কিন্তু মাঝ নদীতে অ্যাম্বুলেন্সেই মারা যায় ১১ বছর বয়সি তিতাস।

তিতাসের করুণ মৃত্যুর ঘটনার পর মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক মো. ওয়াহিদুল ইসলাম গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘সরকারের এটুআই প্রকল্পের যুগ্ম সচিব আবদুুস সবুর ম-ল পিরোজপুর থেকে ঢাকা যাচ্ছিলেন। তিনি কাঁঠালবাড়ী ঘাটে যাওয়ার আগে আমাকে ফেরিতে যাওয়ার বিষয়টি জানান। আমি ঘাটের ব্যবস্থাপক সালামকে বিষয়টি জানাই। কিন্তু ওই ঘাটে অ্যাম্বুলেন্সে একজন গুরুতর আহত রোগী আছে, তা আমি জানতাম না। ঘাটের ম্যানেজার এ বিষয়ে আমাকে কিছু জানাননি।’

একটি জীবন অকালে ঝরে গেল। কার অপরাধে প্রাণটি ঝরেছে তা হয়তো নির্ণয় করা যাবে। হয়তো এ ঘটনায় যে বা যিনি দায়ী তিনি শাস্তি পাবেন। এমনও হতে পারে এ ঘটনায় ‘বলির পাঠা’ হবে কেউ। এখন আর যাই ঘটুক না কেন তিতাস আর ফিরে আসবে না তার পরিবারের কাছে এটাই চূড়ান্ত বাস্তবতা। আর যেন কোন তিতাস এভাবে ভিআইপির বলি না হয় অথবা ভিআইপির চাপে মানবতা পদদলিত না হয় সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে সংশ্লিষ্টদের। মনে রাখতে হবে ভিআইপি মর্যাদার চেয়ে একটি জীবনের মূল্য অনেক-অনেক বেশি।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close