ফারিহা হোসেন

  ০৩ আগস্ট, ২০১৯

মুক্তমত

চাই নিরাপদ খাদ্য

মানুষের জীবনের জন্য পানি এবং খাদ্য অপরিহার্য। সব পানি যেমন পানের যোগ্য নয়, তেমনি সব খাবার স্বাস্থ্যের জন্য সুখকর নয়। এককথায় বলা যায়, একমাত্র বিশুদ্ধ পানিই শুধু পানের যোগ্য। ঠিক তেমনি সব খাদ্য স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ নয়। শুধু স্বাস্থ্যসম্মত, নিরাপদ খাদ্যই জীবনকে বাঁচাতে ও রোগমুক্ত রাখতে সক্ষম। তবু বেঁচে থাকার জন্য আমাদের খাদ্য গ্রহণ করতে হয়। তবে তা অবশ্যই

পুষ্টিকর, সুষম, ভেজালমুক্ত এবং নিরাপদ হওয়া প্রয়োজন। এ ধরনের খাবার ও পানি একজন মানুষকে সুস্থভাবে বাঁচিয়ে রাখতে সহায়তা করে। কিন্তু বাস্তবে প্রতিদিনের খাদ্যই যদি বিষাক্ত হয়, পানি দূষিত ও পানের অযোগ্য হয়, তা হলে ফলাফল কী দাঁড়ায়? জীবনকে বাঁচাতে সহায়তার পরিবর্তে জীবনকে প্রতিমুহূর্তে হুমকির মুখে ঠেলে দেওয়া হয়।

আমাদের বাঙালির প্রধান খাদ্য ভাত। এটি সত্য, আমরা এখন চালসহ সব রকমের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছেÑ সেই খাদ্য কতটুকু নিরাপদ? হলফ করে বলা যায়, আমরা প্রতিদিন যা খাচ্ছি তার নব্বই ভাগই অস্বাস্থ্যকর, অনিরাপদ। তবে স্বাস্থ্যসম্মত ভেজালমুক্ত নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে সরকারের নানামুখী তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত, জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত নিয়মিত টহল কার্যক্রম অব্যাহত রাখলেও এই কার্যক্রম প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এই কার্যক্রম শুধু রাজধানীতে নয়, বিভাগীয় পর্যায়, জেলা এমনকি উপজেলা পর্যন্ত সম্প্রসারিত হওয়ার পাশাপাশি নিয়মিত মনিটরিং করা অপরিহার্য। একই সঙ্গে মাটি, পানি ও ফসলকে বিষমুক্ত রাখার প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা ও এর সঠিক প্রয়োগ প্রয়োজন।

খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশে ধানের উৎপাদন বেড়েছে। নতুন নতুন ধান আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে। উচ্চফলনশীল এসব ধান দেশে বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে। অধিক ফসল উৎপাদন করতে গিয়ে আমরা যে জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছি, তা কি কেউ ভেবে দেখেছি? ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরির গবেষণায় যে তথ্য মিলেছে, তা রীতিমতো ভয়াবহ। গবেষণার জন্য চালের যে ২৩২টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল, তার ১৩১টিতে মিলেছে বিভিন্ন মাত্রায় ক্রোমিয়াম। ১৩০টিতে পাওয়া গেছে ক্যাডমিয়াম ও সিসা। ৮৩টিতে মিলেছে আর্সেনিকের অস্তিত্ব।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়াম, সিসা ও আর্সেনিক মানুষের শরীরে প্রবেশ করলে তা বের হতে পারে না। সবকটিই দীর্ঘমেয়াদে কিডনি, লিভার ও মস্তিষ্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এ ছাড়া ক্যানসারসহ নানা ধরনের ক্রনিক রোগের বড় উৎস হচ্ছে এসব রাসায়নিক। এগুলো ধীরে ধীরে মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। মানব শরীরে অতিরিক্ত ক্যাডমিয়াম জমা হলে মারাত্মক বিষক্রিয়ায় ক্যানসার, হৃদরোগ ও কিডনির সমস্যা দেখা দিতে পারে। ইউরোপীয় কমিশনের নীতিমালা অনুসারে মানবদেহের জন্য ক্রোমিয়ামের সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রা হচ্ছে ১ পিপিএম। জাতীয় নিরাপদ খাদ্য গবেষণাগারের গবেষণায় চালে ক্রোমিয়াম পাওয়া গেছে ৩.৪১৪ পিপিএম পর্যন্ত। ক্যাডমিয়ামের সহনীয় মাত্রা ০.১ পিপিএম হলেও গবেষণায় পাওয়া গেছে ৩.২৩৯৫ পর্যন্ত। সিসার সহনীয় মাত্রা ০.২ হলেও পাওয়া গেছে ১.৮৭ পর্যন্ত।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চালে ক্যাডমিয়ামের প্রধান কারণ জমিতে নিম্নমানের টিএসপি সার প্রয়োগ এবং গার্মেন্ট, ওষুধ কারখানা, টেক্সটাইল ও ট্যানারির অপরিশোধিত বর্জ্য। বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহারের পরিণতি কমবেশি সবাইকেই ভোগ করতে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে শিশুরা সবচেয়ে বিপজ্জনক পর্যায়ে রয়েছে। সঠিক মান ঠিক না করে এবং প্রয়োগবিধি না মেনে বিষাক্ত কীটনাশক প্রয়োগের ফলে একাধারে উৎপাদিত ফসল, মাছ, পানি ও জমি মারাত্মকভাবে বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে। এর যেকোনো মাধ্যম থেকে মানুষের শরীরে সহজেই প্রবেশ করছে এই

বিষাক্ত উপাদান। ফসল ও মাছে ভারী ধাতু প্রবেশ করছে মূলত মাটি ও পানি থেকে। মাটি ও পানি এমনভাবে রাসায়নিক দূষণের কবলে পড়েছে, যা খাদ্যচক্র হয়ে মানবদেহে ঢুকে মানুষের জীবনকে বিপন্ন করে তুলছে। নানা ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ।

বেঁচে থাকার জন্য আমাদের যে খাদ্য গ্রহণ করতে হয়, সে খাদ্যই যদি রোগাক্রান্ত হওয়ার কারণ হয়, তা হলে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা কোথায়। কাজেই আমাদের খাদ্য বিষমুক্ত করার সব ব্যবস্থা এখনই নিতে হবে। বিষাক্ত কীটনাশক ও সার ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। কারখানার বর্জ্য ব্যবস্থাপনায়ও শৃঙ্খলায় আনতে হবে। বিষমুক্ত খাদ্য নিশ্চিত করতে কঠোর পদক্ষেপের কোনো বিকল্প নেই। খাদ্যে ভেজাল, অনিরাপদ খাদ্য উৎপাদন, বাজারজাত, বিক্রি শতভাগ বন্ধে প্রশাসন, পণ্যের উৎপাদনকারী, বিক্রেতা, মজদকারী সবাইকে আইনের আওতায় আনা জরুরি। একই সঙ্গে দূষিত পানি বিক্রি ও উৎপাদনকারীকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। না হলে ভেজাল ও অনিরাপদ খাদ্য খেয়ে নানারকম প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাবে। যা বিভিন্ন সময়ে চিকিৎসক, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন।

খাদ্যে ভেজাল রোধে সরকার অত্যন্ত কঠোর অবস্থান নিয়েছে। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, র‌্যাব, বিএসটিআই, সিটি করপোরেশন পৃথক পৃথকভাবে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছে। পাশাপাশি ভেজাল, নকল মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বাজারজাত, বিক্রি, বিপণন বন্ধে প্রতিনিয়ত অভিযান পরিচালনা করছে এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে জেল-জরিমানা করা হচ্ছে। এর সুফলও আসছে। তবে এসব কর্মকান্ড বছরব্যাপী এবং সারা দেশে বিস্তৃত হওয়া প্রয়োজন। তবেই সম্ভব মানুষের জন্য নিরাপদ খাদ্য ও পানির নিশ্চয়তা। এসব নিশ্চিত করা গেলে মানুষের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত হবে পাশাপাশি সাধারণ মানুষ ব্যাপক চিকিৎসা ব্যয়ের হাত থেকে বাঁচবে। (পিআইডি-শিশু ও নারী উন্নয়নে সচেতনতামূলক যোগাযোগ কার্যক্রম নিবন্ধ)

লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close