মো. কায়ছার আলী

  ৩১ জুলাই, ২০১৯

মুক্তমত

ইতিহাসের পাতায় ছিটমহল

‘শক্তি নয়, ইচ্ছাই রাষ্ট্রের ভিত্তি’Ñ টি এইচ গ্রিন। হবস, লক এবং রুশোর মতে, ‘চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে’। প্রকৃতির নির্মম খেয়াল থেকে বাঁচার এবং একে অপরের জীবন, সম্পত্তি নিরাপত্তার জন্য পারস্পরিক চুক্তিতে উপনীত হওয়ার ফলে রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে। বিভিন্ন রাষ্ট্র, জাতি, উপজাতি, বর্ণ ও গোত্রে বিভক্ত কিন্তু সবার মূল পরিচয় মানুষ। তাইতো দেশে দেশে মানুষে মানুষে এত ভেদ-প্রভেদ থাকা সত্ত্বেও পরস্পরের প্রতি মমত্ববোধ চিরন্তন। মানবাধিকার, জননিরাপত্তাসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা একমাত্র রাষ্ট্র ছাড়া অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। অনেকের মতে, ‘পৃথিবীতে যত চুক্তি হয়েছে (বিনা রক্তপাতে) এর মধ্যে শ্রেষ্ঠ চুক্তি হলো স্থলসীমান্ত চুক্তি (ছিটমহল বিনিময়)। উন্নত দেশ হলে উভয় দেশের সরকারপ্রধান নোবেল শান্তি পুরস্কার পেতেন।

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের নির্মমতার শিকার বা মুঘল আমলের রাজন্য বর্গের খামখেয়ালিপনা অথবা ক্ষমতার দ্বন্দ্বের প্রতীক হলো ছিটমহল। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, কুচবিহারের রাজা এবং রংপুরের মহারাজা তিস্তার পাড়ে তাসখেলায় বাজি ধরতেন ছিটমহলের মালিকানা নিয়ে। তারা ছিলেন সামন্ত। ছিট শব্দের অর্থ খন্ড বা টুকরা। বিভিন্ন মহলকে এক একটি খন্ডে বিভক্ত করার পর এর নাম হয় ছিটমহল। ছিটমহল (Enclave) হলো রাষ্ট্রের এক বা একাধিক ক্ষুদ্র অংশ, যা অন্য রাষ্ট্র দ্বারা পরিবেষ্টিত। A Piece of territory surrounded by foreign dominion is Enclave. অর্থাৎ বন্দিত্ব বা দেশহীন মানুষের আবাসস্থল ছিটমহল। ইতিহাস পাঠে জানা যায়, ষোড়শ শতাব্দীতে মুঘল সম্রাট শাহজাহানের হঠাৎ অসুস্থতার কারণে কুচবিহারের রাজা প্রাণনারায়ণ কামরূপের সুবেদার মীর লুৎফুল্লাকে আক্রমণ করে মুঘল সাম্রাজ্যের বেশ কিছু বাড়তি অংশের ওপর নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে আওরঙ্গজেবের নির্দেশে বাংলার সুবেদার মীর জুমলা বিশাল বাহিনী নিয়ে কুচবিহার আক্রমণ করেন এবং অধিকৃত মুঘল সাম্রাজ্যর হৃত অংশগুলো পুনরুদ্ধার করে রাজধানী কুচবিহারও অধিকার করে ফেলেন। পরে ইসফান্দিয়ার বেগকে কুচবিহারের দায়িত্ব দেন। রাজা প্রাণনারায়ণ পালিয়ে গিয়ে পরবর্তীতে স্বসৈন্য শক্তি সংগ্রহ করে পুনরায় রাজ্য উদ্ধার করেন। তখন থেকেই মুঘলদের সঙ্গে দফায় দফায় রাজার যুদ্ধ লেগেই থাকত; যা শেষ হয় ১৭৭২ সালে। কুচবিহারের রাজা হন শান্তনু নারায়ণ। তখন খাঞ্জা খাঁ কুচবিহারের বোদা, পাটগ্রাম এবং পূর্বভাগ এ চাকলা তিনটি অধিকার করেন। রাজা বেনামে চাকলা তিনটি ইজারা নেন। অন্য ভূসম্পত্তি দ্বারা পরিবেষ্টিত হলেও মূলত এ তিনটি চাকলার অন্তর্ভুক্ত অঞ্চলগুলোই কুচবিহারের ছিটমহল। পরবর্তীতে বহু বছরব্যাপী খন্ড খন্ড যুদ্ধের ফলে কুচবিহার রাজ্যের বেশ কয়েকটি ভূখন্ডে মুঘলদের দখলদারি কায়েম হয় এবং কালক্রমে এ অংশগুলো রংপুরের জমিদারির অধীনে চলে আসে; যা পরে রংপুরের ছিটমহল নামে পরিচিত। সেই ভূখন্ড মূল সম্পত্তির সঙ্গে এক লপ্তে (Stretch) নয় অথচ ঠিকই খাজনা আসত রাজা বা জমিদারের তহবিলে।

পলাশী যুদ্ধের পর ১৭৮৯ থেকে ১৮০০ সালে ইংরেজরা কৌশলে কুচবিহারের রাজাকে নিজেদের বশে আনেন। সে প্রেক্ষাপটে প্রথমেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কুচবিহার রাজার কাছ হতে বোদা, পাটগ্রাম ও পূর্বভাগÑ এ তিনটি চাকলা অধিকার করেন এবং পুনরায় কুচবিহারের রাজার কাছে ফিরিয়ে দেন। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান ভাগের সময় সমস্যা বাধে কুচবিহার ঘিরে। কুচবিহারের রাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ এর কিছু জমিদারিস্বত্ব ছিল বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুর জেলার আওতাধীন। অপরদিকে রংপুর ও দিনাজপুরের জমিদারদের কিছু তালুক ও জোর ছিল কুচবিহার সীমানার মধ্যে। উভয়পক্ষ সমঝোতায় ব্যর্থ হওয়ায় বাংলাদেশের মধ্যে ভারতের এবং ভারতের মধ্যে বাংলাদেশের কিছু এলাকা পড়ে। দেশ বিভাগের মতো এত বড় জটিল কাজটি (৮ জুলাই ১৯৪৭ হতে ১৩ আগস্ট ১৯৪৭) Sir Siril Redclif অখন্ড ভারতের দীর্ঘদিনের স্থল ও জলযোগাযোগ ব্যবস্থা, সংস্কৃতি, সমন্বিত অর্থনীতি ও স্থিতি সম্পন্ন এলাকা ব্রিটিশ ভারতের পূর্ব-পশ্চিম দুই অঞ্চলের দুটি প্রদেশ বাংলা ও পাঞ্জাবকে মাঝ বরাবর ধরে ম্যাপের ওপর দাগ টেনে ভাগ করেন। সীমারেখা নির্ধারণী Top Sheet এর মূলকপি ১৬ আগস্ট ১৯৪৭ সালে জনসম্মুখে প্রকাশ করা হলে বিতর্কের ঝড় ওঠে এবং সব কিছু এলোমেলো হয়ে যাওয়ায় ছিটমহলবাসীর ১৬২টি ছোট-বড় ভূখন্ড অনিষ্পত্তি অবস্থায় রাখে, যার ফলে চরম দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়। পৃথিবীর মানচিত্রে এই অঞ্চলকে বিধ্বস্তবলয় (Shattered Belt) বলা হয়। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ছিল বলেই ছিটমহলবাসীর অবস্থা অত্যন্ত করুণ ও জটিল প্রকৃতির। নাগরিক অধিকার বঞ্চিত, নিপীড়িত অসহায় মানুষগুলো মেয়েদের সম্ভ্রমহানির ভয়ে সন্ধ্যা হলেই লুকিয়ে রাখত, শান্তিতে ঘুমাতে পারত না, হাসপাতালে গেলে ডাক্তার বাবুরা দেখত না, বলত দুই দিন পরে আস এবং গর্ভবতী মহিলাদের সন্তান জন্মদানের সময় ভর্তি নিত না।

কাজলাদিঘি ছিটমহলের বাসিন্দা হবিবর অসম্ভব মেধাবী ছোট মেয়েকে আত্মীয়স্বজনের সহায়তায় পরিচয় গোপন করে বাংলাদেশের একটি স্কুলে ভর্তি করায়। মেয়েটি এইচএসসি পরীক্ষায় এচঅ-৫ পেলে তার পিতৃ-পরিচয় জানাজানি হয়ে যায়। দেশি-বিদেশি সংস্থা মেয়েটির পড়াশোনার সহযোগিতা করতে আগ্রহী হলে আইনগত সমস্যা দেখা দেয়। এ অবস্থায় মেয়েটিকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি নিলে, সে পড়াশোনা ছাড়তে চায় না এবং দিন-রাত কান্নাকাটি করে। খাগরাবাড়ি সরকারপাড়া ছিটে সুরতন বেগমের জন্ম হওয়ায় বিয়ে হয়েছিল কিন্তু শ্বশুরবাড়ি যাওয়া হয়নি। নিরুপায় বাবা চেরুমদ্দীন জামাই এনে ঘরে রেখেছিলেন। কোর্টভাজনী ছিটের স্বপন চন্দ্র রায় গোপনে বাংলাদেশে উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পরও পুলিশের চাকরিতে উক্তীর্ণ হয়েও নাগরিকত্বের জটিলতায় চাকরি হয়নি এবং বর্তমানে তার চাকরির বয়স নেই। মনছুর আলী মিয়া বলেন, ১৯৬৬ সালে ৭ বছর আমরা গ্রাম থেকে বের হতে পারিনি। গ্রামে হকার আসত। আমরা গ্রাম থেকে বের হলেই ভারতের পুলিশ তাড়া করত। ১৯৯২ সালে শালবাড়ি ছিটমহলে শালবনের গাছ কেটে ফেলেছিল দুষ্কতিকারীরা। এরপর তারা ধরা পড়লে উভয়পক্ষের মারামারি, মারা যায় একজন, আহত অনেক, ৫০০ বাড়িতে আগুন, নির্বিচারে লুটতরাজ, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সরবরাহ বন্ধ, অবরুদ্ধ এবং সারা রাত চলে নারী ধর্ষণ। ঘটনাগুলোর বিচার করা তো দূরের কথা তদন্ত পর্যন্ত হয়নি। রেডক্লিফ রোয়েদাদ, বাউন্ডারি কমিশনের রিপোর্ট, নুন-নেহেরু চুক্তি, ১৯৭৪ সালের ১৬ মে ইন্দিরা-মুজিব ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরের পরও দীর্ঘ সময় বিচ্ছিন্ন ভূখন্ডের অবহেলিত, নাগরিকত্বহীন মানুষরা চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে মানবেতর জীবনযাপন করেছে; যাকে সোজা কথায় বলা যায়, সভ্য সমাজের এক ‘কলঙ্ক তিলক’।

জাতিসংঘ সনদে Protocol to the Internationl Convanant on Civil & Political Right এর ৪.৩ (৩) অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে ‘রাষ্ট্র সকলের আত্মবিকাশের সমান সুযোগ প্রদান করবে’। অন্যত্র জোর দিয়ে বলা হয়েছে ‘প্রত্যেক শিশুর একটি জাতীয়তা লাভের অধিকার থাকবে’। এ কথাগুলো এক দিন ছিল কাগজে আর কলমে, বাস্তবে নয়। বর্তমান শেখ হাসিনা সরকার ১৯৯৬ সালে ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির সূত্র ধরে নতুন করে কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করেন। ২০১১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং বাংলাদেশের সফরে এলে তখন একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেন। বাংলাদেশের পক্ষে ছিটমহল বিনিময় ও সীমানা নির্ধারণ-সংক্রান্ত বিলটি (জলসীমানা পূর্বেই মীমাংসিত) ৬ সেপ্টেম্বর ২০১১ তারিখে মহান জাতীয় সংসদে পাস হয়। নরেন্দ্র মোদির সরকার ২-৩ অংশের বেশি আসন নিয়ে ক্ষমতায় এসে ছিটমহলবাসীর দীর্ঘদিনের করুণ আর্তনাদ কর্ণগোচর হয়। অদৃশ্য সেই অভিশাপ বা সীমান্তরেখা গত ৭ মে ২০১৫ সালে ১১৯তম (প্রকৃতকক্ষে ১০০তম এবং স্বাধীনতা বা বিজয় দিবসের মতো) স্থলসীমান্ত চুক্তি-সংক্রান্ত সংবিধান সংশোধনী বিল (ছিটমহল বিনিময়) ভারতের লোকসভায় ৩৩১ জন সদস্যের উপস্থিতিতে এবং সর্বসম্মতক্রমে পাস হয়। বাংলাদেশের মধ্যে ভারতের ১১১টি ছিটমহল (লালমনিরহাটে ৫৯টি, পঞ্চগড়ে ৩৬টি, কুড়িগ্রামে ১২টি, নীলফামারীতে ৪টি মোট ১৭ হাজার ১৬০.৬৩ একর, জনসংখ্যা ৩৭৩৮৬ জন) বাংলাদেশ পেল এবং ভারতের মধ্যে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল (কুচবিহারে ৪৭টি, জলপাইগুড়িতে ৪টি মোট ৭ হাজার ১১০.০২ একর, জনসংখ্যা ১৪০৯০ জন) ভারত পেল। বসবাসরতরা ইচ্ছানুযায়ী যেকোনো দেশের অভ্যন্তরেই থেকে যেতে পারলেন। এ ছাড়া বাংলাদেশ ভারতের জোর করে দখল করে রাখা ২২৬৭.৬৮২ একর এবং ভারত বাংলাদেশের জোর করে দখল করে রাখা ২৭৭৭.৩৮ একর জমি যার যা দখলে আছে, সে তার মালিকানা পেল। তদুপরি নীলফামারী-পশ্চিমবঙ্গ, ফেনীর মহুরী নদী-ত্রিপুরা, লাঠিটিলা ও ডুমাবাড়ী-আসাম সীমান্তে ৬.৫ কিলোমিটার অমীমাংসিত সীমারেখা স্থির করা হবে এবং তিন বিঘা করিডর ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকল। ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও গুরুত্ব পেয়েছিল ছিটমহল বিনিময়ের খবর। বিশ্ববাসী জানতে পেরেছিল আমরা উভয় দেশ মিলেমিশে একসঙ্গে ভালো কাজ করতে পারি। এখন তাদের জীবনধারা বদলে গেছে।

দাসিয়ারছড়ার ছোট কামাত গ্রামের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ছোবেয়া খাতুন (৫১) বলেন, ‘ভাবিনি কোনো দিন বাঁচার অবলম্বন পাব। প্রতিবন্ধী ভাতা পেয়ে এখন নতুন করে জীবন পেয়েছি’। কালিরহাটের জয়নাল (৪৬) দৈনন্দিন রোজগারের অবলম্বন একটি ভ্যান পেয়ে স্ত্রী সন্তানদের মুখে দুমুঠো খাবার তুলে দিতে পারছেন। সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় জীবনের শেষ আশ্রয় একটি ঘর পেয়ে স্বস্তিতে আছেন আশ্রয়হীন ভবঘুরে বালাতাড়ি গ্রামের হাতেম আলী, মংলু চন্দ্র, জংলু চন্দ্র। কামালপুর গ্রামের আবুবক্কর সিদ্দিক (৭৯) বলেন, বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছেন, আপন করে নিয়েছেন। তার কাছে ছিটমহলবাসী সারা জীবন কৃতজ্ঞ। ভিক্ষাবৃত্তি করে দিন কাটাচ্ছিল রাশমেলা গ্রামের জহিরন, জমিলা ও রাশেদা। বিধবা ভাতা পেয়ে এখন তারা ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়েছেন। পুষ্টি প্রোগ্রামের আওতায় সন্তানসহ নিজের নানা পরামর্শ, ওষুধ ও খাদ্য সহায়তা পাচ্ছেন বালাতাড়ি গ্রামের মুক্তা বেগম, জহিরন ও তানিয়া। স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট, আকাশ সংস্কৃতি, বিদ্যুৎ সংযুক্তিসহ আধুনিক রাষ্ট্রের সব সুযোগ-সুবিধা তাদের কাছে স্বপ্ন নয়, বাস্তবে দৃশ্যমান হচ্ছে। পরিশেষে দুই দেশের ছিটমহলবাসীর ২০১২ সালে সেই সম্মিলিত সেøাগান, ‘দাও নাগরিকত্ব, নয় মৃত্যু’। ২০১৫ সালে এসে তা পূর্ণতা পেল।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close