জোবাইদা নাসরীন

  ৩০ জুলাই, ২০১৯

মুক্তমত

বাস্তবতা যখন ১ বনাম ১৬

এ দেশে যখন কোনো ধরনের ধর্ষণ এবং যৌন হয়রানির ঘটনা মিডিয়াতে মনোযোগ পায়, তখন আমরা সবাই মানবিকভাবে বিষয়গুলোর সঙ্গে একাত্মতাবোধ করি আর তখন মনে হয় এরপর এ দেশে কোনো ধর্ষণ কিংবা যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটবে না। কিন্তু বাস্তবের চিত্র একেবারেই বিপরীত। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়গুলোর একটি হলে শিশু ধর্ষণ। কেন এই ধর্ষণ বাড়ছে? সব ধর্ষণ একই সমান মনোযোগ পায় না। আবার যেগুলো মিডিয়ার কারণে জনমনে আলোচনা ছড়াতে সক্ষম হয়, সেগুলোর ভবিষ্যৎও একসময় আড়ালে চলে যায়।

কোনোভাবেই এটি বন্ধ করা যাচ্ছে না। যৌন নিপীড়নের শিকার শুধু মেয়ে শিশুই নয়, ছেলে শিশুও রয়েছে। আর এ পরিস্থিতিতে শঙ্কিত সংশ্লিষ্ট সবাই। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী এ বছরের প্রথম ছয় মাসে অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৩৯৯ শিশু ধর্ষণ ও ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছে। অথচ গত পুরো বছরে শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল ৩৫৬টি। সংস্থাটির হিসাব মতে, ধর্ষণ এবং ধর্ষণের পরে একজন ছেলে শিশুসহ ১৬ জন শিশু মারা গেছেন ২০১৯-এর প্রথম ছয় মাসে। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের (বিএসএএফ) তথ্য মতে, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৪৯৬ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ২০১৮ সালে ৫৭১ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। গত বছরের তুলনায় এ বছরের প্রথম ছয় মাসে দেশে শিশু ধর্ষণ বেড়েছে ৪১ শতাংশ হারে। এ বছরের প্রথম ছয় মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৪৯৬ শিশু। গত বছরের প্রথম ছয় মাসে এ সংখ্যা ছিল ৩৫১ জন। এপ্রিল এবং মে এ দুই মাসেই শিশু ধর্ষণ হয়েছে ২৪১ জন, যা মোট ধর্ষণের অর্ধেকেরও বেশি। এ বছরের প্রথম ছয় মাসে ধর্ষণ হওয়া ৪৯৬ শিশুর মধ্যে ৫৩ শিশুকে গণধর্ষণ এবং ২৭ প্রতিবন্ধী শিশুকে ধর্ষণ করা হয়। এর মধ্যে ২৩ জন শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। এছাড়া ওই ছয় মাসে ৭৪টি শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি মাসে গড়ে ৮০টির অধিক শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে; যা অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি। তবে এসবই প্রকাশিত তথ্য। ধারণা করা যায় যে, ধর্ষণের সংখ্যা আরো বেশি। কারণ এখনো ধর্ষণ মামলা করতে আসা পরিবারের সংখ্যা অনেক কম।

জনমনে প্রশ্ন, হঠাৎ কেন শিশু ধর্ষণ বেড়ে গেল? এর পেছনে কোন ধরনের সামাজিক মনস্তত্ত্ব কাজ করে? হতে পারে আগেও শিশু ধর্ষণ এ রকমই ছিল। এখন মিডিয়া অনেক সোচ্চার। অভিভাবকরাও অনেক সচেতন। রাখ ঢাকের দেয়াল ভেঙে জানান দিতে চান অপরাধীর পরিচয় এবং ন্যায়বিচার চান। তবে এ কথা স্বীকার করে নিতেই হবে যে, সামাজিক সম্পর্কগুলো এখন অনেক বেশি ভঙ্গুর। যাদের সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক হওয়ার কথা ছিল, তারাই হয়ে পড়ছে ধর্ষক কিংবা যৌন নিপীড়ক। অথচ এখন এই সম্পর্কগুলোকে নিয়ে মানুষ ভয়ে থাকছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, শিশুরা প্রথম যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে আত্মীয়দের দ্বারা। কেন এমন হচ্ছে? পারিবারিক এবং সামাজিক মূল্যবোধ ভেঙে তা কেবলই অর্থনির্ভর হয়ে পড়ছে। মানুষের সঙ্গে মানুষের সমর্থন কেবল অর্থনৈতিক সামর্থ্যরে ওপর দাঁড়িয়ে আছে। যে কারণে নুসরাতের হত্যাকা-ের পর আসামি পক্ষের আইনজীবী হিসেবে কেউ কাজ করবেন না বলে ঘোষণা এলেও বর্তমানে নুসরাতের মামলার আসামি পক্ষের আইনজীবী রয়েছেন ১৬ জন এবং রাষ্ট্রীয় পক্ষের আইনজীবী আছেন মাত্র একজন। এই পরিসংখ্যান থেকে আমরা বুঝতে পারি আসলে নৈতিক সমর্থন থেকে অর্থনৈতিক সমর্থন কতটা জোরালো। সামাজিক সত্তা হিসেবে মানুষের পরিচিতি ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে।

এর পাশাপাশি ধর্ষণের সংখ্যা বাড়ার কারণ দেশে বিরাজমান বিচারহীনতার সংস্কৃতি। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে বলা আছে, ১৮০ দিনের মধ্যে মামলা প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে। কিন্তু এমন অনেক নজির আছে যে বছরের পর বছর ধরে মামলা চলছে। যে কারণে দেখা যাচ্ছে, ধর্ষণের মামলা চলাকালীন বিভিন্ন বিব্রতকর পরিস্থিতি এবং বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা এবং অনেক সময়ই জামিনে মুক্তি পাওয়া আসামিদের নানা ধরনের হুমকি-ধমকির ধকল। এসব কারণে আইনের আশ্রয় নিতে অনেকেরই অনীহা তৈরি হয়। এর বাইরে দীর্ঘদিন মামলা চালিয়ে যাওয়ার সামর্থ্যও অনেক পরিবারের থাকে না। তাই তাদের দৌড় থানা পর্যন্ত পৌঁছায় না। থানায় গেলেও সব ধর্ষণ একইভাবে গুরুত্ব পায় না।

বিচার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করার বিপরীতে যাচ্ছে যে, ধর্ষণের শিকার নারীর পরিবারের সদস্যদের সরকারের পক্ষ থেকে চাকরি দেওয়ার বিষয়টিতে হয়তো প্রধানমন্ত্রীর মহানুভবতার প্রকাশ পায়, কিন্তু অন্যদিকে বিচারের জায়গাটির শক্ত অবস্থানকে নাজুক করে ফেলে এবং ধর্ষণ বন্ধের ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা রাখে না। তাই এর বদলে বিচার প্রক্রিয়াকে দ্রুত করার নির্দেশ ধর্ষণ বন্ধ করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে আমি বিশ্বাস করি। যৌন সহিংসতা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। এটিকে ‘নারীর বিষয়’ হিসেবে পাঠ করার বিপরীতে কীভাবে সম্মিলিত উদ্যোগে প্রতিরোধ করা যায় সেই বিষয়ে আমাদের মনোযোগ তৈরি করতে হবে। আইন এবং বিচার ব্যবস্থার ভূমিকা ধর্ষণের ক্ষেত্রে আরো কঠোর এবং দ্রুত হওয়া জরুরি। এ ক্ষেত্রে আসামিদের জামিন ধর্ষণের শিকার নারী এবং তার পরিবারকে আরো বিপর্যস্ত করে তোলে। তাই এ ক্ষেত্রে আসামির জামিনের ক্ষেত্রেও সার্বিক বিষয় বিবেচনায় আনা গুরুত্বপূর্ণ।

লেখক : শিক্ষক

নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close