রেজাউল করিম খোকন

  ৩০ জুলাই, ২০১৯

সাফল্য

রফতানি বাণিজ্যে নতুনমাত্রা

সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে বাংলাদেশের রফতানি আয় লক্ষ্যমাত্রাকে অতিক্রম করেছে। বছর শেষে রফতানি প্রবৃদ্ধির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে সাড়ে ১০ শতাংশ। এটি পুরো অর্থনীতিতে ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে, সন্দেহ নেই। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশের সামগ্রিক পণ্য রফতানি ৪০ বিলিয়ন অর্থাৎ ৪ হাজার কোটি ডলারের মাইলফলক স্পর্শ করেছে। যদিও রফতানির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ হাজার ৯০০ কোটি ডলার। এ সময় ৪ হাজার ৫৩ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে। এই আয় তার আগের অর্থবছরে রফতানি হওয়া ৩ হাজার ৬৬৬ কোটি ডলারের চেয়ে ১০ দশমিক ৫৫ শতাংশ বেশি।

এ ছাড়া লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩ দশমিক ৯৪ শতাংশ রফতানি বেশি হয়েছে বিদায়ী অর্থবছরে। এ সময় মোট রফতানি আয়ের ৮৪ শতাংশ গার্মেন্ট খাত থেকে এসেছে। সব মিলিয়ে বছরটিতে ৩ হাজার ৪১৩ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রফতানি হয়েছে। এই আয় ২০১৭-১৮ অর্থবছরের চেয়ে ১১ দশমিক ৪৯ শতাংশ বেশি। আর বিদায়ী অর্থবছরের পোশাক রফতানি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪ দশমিক ৪২ শতাংশ বেশি। পোশাক রফতানি বাড়লেও বিভিন্ন কারণে এর উৎপাদন খরচ বেড়েছে। ফলে মূল্য সংযোজন খুব একটা হচ্ছে না বর্তমানে। পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে সরকার নানাভাবে সহায়তা দিচ্ছে। প্রচলিত বাজারে ১ শতাংশ নগদ সহায়তা দিচ্ছে সরকার। এতে করে রফতানিকারকরা এক ধরনের স্বস্তিতে রয়েছেন। রফতানি তালিকায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় সর্বোচ্চ উপার্জনকারী পণ্য চামড়া ও পাট রফতানি কমেছে। পোশাকের বাইরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১০১ কোটি ৯৭ লাখ ডলারের রফতানি আয় চামড়া খাত থেকে এসেছে। অবশ্য অনেক দিন ধরেই খাতটির রফতানি আয় নিম্নমুখী। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়া পণ্যের রফতানি কমেছে ৬ শতাংশ। তৃতীয় সর্বোচ্চ ৯০ কোটি ৮৯ লাখ ডলারে রফতানি আয় প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য থেকে এসেছে। এই আয় গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরের চেয়ে ৩৪ দশমিক ৯২ শতাংশ বেশি। চামড়ার মতো হোম টেক্সটাইলের রফতানিও কমেছে। ৮৫ কোটি ডলারে রফতানি আয় হলেও তা ২০১৭-১৮ অর্থবছরের চেয়ে ৩ শতাংশ কম। পাট ও পাটপণ্যের রফতানিও কমে গেছে। রফতানিতে পোশাক খাতের ওপর অতি নির্ভরতা কমিয়ে আনতে সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও বাস্তবে এর তেমন কোনো প্রতিফলন নেই। বরং রফতানিতে তৈরি পোশাক কেন্দ্রিকতা ক্রমেই বাড়ছে। সম্ভাবনাময় হওয়ার পরও গতি পাচ্ছে না অন্যান্য পণ্য রফতানি। বরং ক্ষেত্রবিশেষে কমছে। রফতানি খাতে আয় বাড়াতে রফতানি পণ্যে যেমন বৈচিত্র্য আনা প্রয়োজন, তেমনিভাবে রফতানি গন্তব্য দেশের সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি নতুন নতুন বাজার অনুসন্ধান জরুরি হয়ে উঠেছে। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং বারবার গুরুত্বারোপ করেছেন। যদিও বর্তমানে রফতানি খাতে বৈচিত্র্য আনার পরিকল্পনাগুলোর বাস্তবায়ন চলছে। এ বিষয়ে সরকারের গৃহীত বিভিন্ন উদ্যোগ কার্যকর করা হচ্ছে। তবে এ উদ্যোগের সুফল চট করে রাতারাতি পাওয়ার আশা করা বৃথা। সবাইকে বুঝতে হবে, এই প্রক্রিয়াগুলো সম্পন্ন করা সময়সাপেক্ষ। দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানি খাত চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের উন্নয়নে সরকারের ঘোষণা রয়েছে এবং তা বাস্তবায়নের কাজও চলছে।

বর্তমানে রফতানি বৈচিত্র্যকরণে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতে উদ্যোক্তাদেরও এগিয়ে আসতে হবে। নীতি সুবিধা আদায়, প্রাপ্তি, কার্যকর হওয়া সাপেক্ষে পর্যায়ক্রমে রফতানি খাতকে আরো বৈচিত্র্যময় করা সম্ভব। রফতানি খাতকে বৈচিত্র্যময় করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে উদ্যোক্তা উন্নয়নের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। কৃষি ও চামড়াজাত পণ্যকে এ ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এ খাতগুলোর বাজার সম্প্রসারণের ব্যাপারেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া মৎস্যসহ অন্যান্য অপ্রচলিত যেসব পণ্য রয়েছে, সেগুলোকে সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হবে। হালকা প্রকৌশল ও প্লাস্টিকপণ্য খাতকে ইতোমধ্যে নানাভাবে সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে। এ-সংক্রান্ত দক্ষতা বৃদ্ধিতে প্রকল্প চালু করেছে সরকার। এক জেলা এক পণ্য কর্মসূচির আওতায় জেলা ও অঞ্চলভিত্তিক বিভিন্ন প্রসিদ্ধ পণ্যের রফতানি বাজারে প্রবেশের জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। এলাকাভিত্তিক পণ্যের মান উন্নয়নে প্রান্তিক চাষিকে বিভিন্ন রকমের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। রফতানিযোগ্য পণ্যের মান ঠিক রাখার জন্য প্যাকেজিং ও সংরক্ষণ বিষয়ে সহায়তার জন্য বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদকে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে এবং তার ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে।

যে গার্মেন্ট খাত থেকে সর্বোচ্চ রফতানি আয় এসেছে; সেই খাতটিকে এখন অনেক আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বস্ত্র ও পোশাক খাতে সংস্কার-পরবর্তী উন্নত কর্মক্ষেত্রের প্রেক্ষাপটে বিপুল পরিমাণ কার্যাদেশ রয়েছে। প্রচুর চাহিদা থাকা সত্ত্বেও মূল্য সক্ষমতায় পিছিয়ে থাকার কারণে ক্রয়াদেশ ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে। আমাদের এখানে ক্রয়াদেশ আসার চেয়ে এখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে মূল্য সক্ষমতা ধরে রাখা। প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে এ সক্ষমতা বৃদ্ধি প্রয়োজন। রফতানি খাতকে বৈচিত্র্যময় করতে ও বর্তমান প্রবৃদ্ধি টিকিয়ে রাখতে সরকারের নীতিসহায়তার পাশাপাশি অন্যান্য প্রণোদনার আওতা বাড়ানো প্রয়োজন। দেশকে অর্থনৈতিকভাবে আরো সমৃদ্ধ এবং শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যেতে রফতানি আয় বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু আমাদের রফতানি পণ্য কিছু নির্দিষ্ট আইটেমে সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে এখনো। একটা সীমাবদ্ধ গন্ডিতে আটকে আছে রফতানি বাণিজ্য।

এ অবস্থায় আমাদের প্রচলিত পণ্যের গন্ডি ভেঙে বেরিয়ে আসতে হবে। অপ্রচলিত নতুন নতুন পণ্যের বাজার সৃষ্টি করতে পারলে একদিকে রফতানি আয় বাড়বে; অন্যদিকে দেশীয় শিল্পের বিকাশ ঘটবে। এতে কর্মসংস্থানও বাড়বে, যা গোটা অর্থনীতিতে নতুন প্রাণের সঞ্চার করবে। গার্মেন্টসামগ্রীর বাইরে অন্যান্য পণ্য যেমনÑ জুতা, প্লাস্টিকপণ্য, ফুটওয়্যার, হোম টেক্সটাইল, সিরামিকস, কৃষিজাত পণ্য প্রভৃতির অপার সম্ভাবনা রয়েছে। রফতানি বহুমুখীকরণের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হলো, পণ্যের আন্তর্জাতিক মান ও কমপ্লায়েন্স অর্জন করা। মান ও খরচের বিবেচনায় প্রতিযোগিতামূলক না হলে বিশ্ববাজারে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। রফতানি বহুমুখীকরণকে একক বা বিচ্ছিন্নভাবে দেখলে চলবে না। এর সঙ্গে আমাদের শিল্পনীতি, আমদানিনীতি, আর্থিকনীতি ও অন্যান্য নীতির সামঞ্জস্য থাকতে হবে। সঠিকভাবে নীতিসহায়তা ও গৃহীত পদক্ষেপগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশে রফতানি পণ্যের বহুমুখীকরণ সম্ভব এবং এর মাধ্যমে দেশে শিল্পের আরো বিকাশ ঘটবে। শুধু গার্মেন্ট খাতের ওপর অতি নির্ভরশীলতা আমাদের রফতানি বাণিজ্যকে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ করে রেখেছে। আন্তর্জাতিক নানা পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক মেরূকরণের প্রভাবে মাঝেমধ্যে তৈরি পোশাক ক্রেতারা যে ধরনের অযাচিত চাপ প্রয়োগ করে অস্থিরতা, অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করে; তা গোটা অর্থনীতিতে হুমকি ডেকে আনে। এ ক্ষেত্রে পাশাপাশি আরো বেশিসংখ্যক পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্ত থাকলে; সেই হুমকি এবং ঝুঁকি অনেকটাই কমে যাবে। এ নিয়ে সরকার ও রফতানিকারকদেরও দুশ্চিন্তা দূর হয়ে যাবে। রফতানি খাতগুলোতে বিরাজমান সমস্যা চিহ্নিত করে দ্রুত সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে। কাস্টমসকে ঢেলে সাজাতে হবে। রফতানি বাড়ানোর জন্য নতুন নতুন বিনিয়োগ ও শিল্পায়ন দরকার।

লেখক : ব্যাংকার ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close