আবু জাফর সিদ্দিকী

  ২৪ জুলাই, ২০১৯

জিজ্ঞাসা

এভাবে আর কত দিন

প্রতিদিন বেড়েই চলেছে বিশ্বজিৎ-রিফাতদের সংখ্যা। বাড়ছে ফেলানী, তনু, রাফি, সায়মাদের সংখ্যাও। পৃথিবীতে বাবা-মা যেখানে সন্তানের কাছে সবচেয়ে নিরাপদ; সেখানে বাবার দ্বারা নিজের ঔরসজাত শিশু দিনের পর দিন ধর্ষিত হচ্ছে! শিক্ষকের দ্বারা ছাত্রী হচ্ছে ধর্ষণের শিকার, শ্বশুরের ধর্ষণের শিকার পুত্রবধূ। সম্প্রতি রাজধানীতে সায়মা নামের এক শিশুকে ধর্ষণ করে নির্মমভাবে হত্যা করে, যা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও ধর্ষণ হচ্ছে। শিশু, বালিকা, যুবতী, স্কুল-কলেজের ছাত্রী, শিক্ষিকা, গৃহবধূ, প্রতিবন্ধী, গার্মেন্ট কর্মী, ডাক্তার, চার সন্তানের জননী, এমনকি বৃদ্ধাও বাদ যাচ্ছে না ধর্ষিতার তালিকা থেকে। কিন্তু এটা কাম্য নয়। শিক্ষকের লালসার শিকার হচ্ছে ছাত্রী, গৃহবধূও ধর্ষিতা হচ্ছে প্রতিবেশী যুবকদের দ্বারা। মনে হয় দেশে ধর্ষণের একটা প্রতিযোগিতা চলছে। বর্তমানে পরিস্থিতি অনুযায়ী বাবার বাড়ি, শ্বশুরবাড়ি, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা, হাট-বাজার, রাস্তা-ঘাট কোথাও কোনো নিরাপত্তা নেই নারীদের। সামাজিক অবক্ষয়, পুরুষের প্রতি নারীদের অনৈক ভঙ্গিমায় তাকানো, পর্দাহীন চলাফেরা, ধর্মীয় অনুশাসনের অভাবÑ এসবই দায়ী ধর্ষণের জন্য। অন্যদিকে প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে হত্যা করা যেন ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বজিৎ হত্যাকারীদের বিচার দেরিতে হওয়ায় বেড়েই চলেছে প্রকাশ্য হত্যাকান্ড। প্রকাশ্যে গুলি করে মোটরসাইকেল ছিনতাই, টাকা ছিনতাই। প্রকাশ্য হত্যা, গুম, ধর্ষণ, রাহাজানি, চাঁদাবাজি, সুদ-ঘুষ, পরকীয়া, দুর্নীতি, অনিয়ম, সীমান্ত হত্যা সবকিছু দেখে মনে হয় দেশটা দিন দিন আবার অন্ধকারের দিকেই ধাবিত হচ্ছে।

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত এ ছয় মাসে বাংলাদেশে ৩৯৯ জন শিশু ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার শিকার হয়েছে বলে জানিয়েছে বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন। তাদের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ধর্ষণের পর একজন ছেলেশিশুসহ মোট ১৬ জন শিশু মারা গেছে। ছয়টি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত ৪০৮টি সংবাদ বিশ্লেষণ করে সংস্থাটি এই তথ্য পেয়েছে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে যে, অন্তত ৪৯টি শিশু (৪৭ জন মেয়েশিশু ও ২ জন ছেলেশিশু) যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে। এর আগে ২০১৮ সালে ৩৫৬ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছিল বলে জানিয়েছিল সংস্থাটি। এর মধ্যে মারা গিয়েছিল ২২ জন এবং আহত হয়েছিল ৩৩৪ জন। দেশে ধর্ষণের শিকার এবং অকালে প্রাণ হারিয়েছেন কত মেয়ে? কে তাদের কথা মনে রাখে? সেই পরিসংখ্যান কারো মাথাব্যথার কারণ হয় না। ভুক্তভোগী পরিবার ছাড়া অন্যদের কাছে পরিসংখ্যান শুধুই সংখ্যা মনে হলেও ভুক্তভোগীর পরিবার জানে, এই পরিসংখ্যানের মানে কী!

১৪টি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে করা বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৮ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত আট বছরে ধর্ষণের শিকার ৪ হাজার ৩০৪ জনের মধ্যে ৭৪০ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) পরিসংখ্যান বলছে, (জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য) ২০০১ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার হন ১৮১ জন গৃহকর্মী। তাদের মধ্যে ধর্ষণের পর মোট কতজনকে হত্যা করা হয়েছে, সেই পরিসংখ্যান দিতে না পারলেও সংগঠনটির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, শুধু গত বছরই ধর্ষণের শিকার ১১ জনের মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় চারজন গৃহকর্মীকে। ১৪টি দৈনিক পত্রিকা থেকে সংগৃহীত তথ্য দিয়ে বিএনডব্লিউএলএ বলছে, ২০১০ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত ধর্ষণের চেষ্টা, ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, ধর্ষণের পর আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ৪ হাজার ৪২৭টি। এর মধ্যে মামলা করা হয়েছে ২ হাজার ৭৩৪টি। গত ছয় বছরে ধর্ষণের পর ৫০৮ নারীকে হত্যা করা হয়েছে। তবে হত্যা করার পরও সব পরিবার মামলা বা আইনি আশ্রয় নেয়নি। এর মধ্যে মামলা হয়েছে মাত্র ২৮০টি ঘটনায়। আর ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ১৬৮ নারী এবং মামলা হয়েছে মাত্র ১১৩টির।

টেলিভিশনের পর্দায় তাকালে বা পত্র-পত্রিকা খুললেই চোখে পড়ে সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশি হত্যা। কিন্তু কেন? প্রতিবেশী দেশের আচরণ কি এটা হওয়া উচিত? ভারতের উচ্চপর্যায় থেকে বারবার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও সীমান্তে বাংলাদেশের নাগরিকদের হত্যা বন্ধ হয়নি।

বিজিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০০১ থেকে ২০১৭ সালের ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত সীমান্তে বিএসএফ ও ভারতীয় নাগরিকদের হাতে মারা গেছে ৯৩৬ বাংলাদেশি। এর মধ্যে বিএসএফের হাতে ৭৬৭ ও ভারতীয়দের হাতে ১৬৯ বাংলাদেশি নিহত হয়েছে। দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিক হত্যা, তবু দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি দুই দেশের সরকারের। আর কত দিন চলবে এভাবে সীমান্তে হত্যাকান্ড? আর কত মায়ের বুক খালি হবে, কেউ কি বলতে পারেন? এই বর্বরতার একটা শেষ চাই, এই নৃশংসতার অবসান চাই। সম্প্রতি এ হত্যাকান্ড আরো বেড়ে গেছে। সবার এখন একটাই প্রশ্ন সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যা বন্ধ হবে কবে?

এমন দেশ তো আমরা চাইনি। আমরা চেয়েছিলাম স্বাধীন-সার্বভৌম একটি দেশ। যে দেশে থাকবে শুধুই শান্তি আর শান্তি। বর্তমানে ধর্ষণ, খুন, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি সব কিছু মিলিয়ে দেশটা আজ বহির্বিশ্বের কাছে মর্যাদাহীন হয়ে পড়ছে। কোনোভাবেই কমছে না ধর্ষণ, হত্যা, চাঁদাবাজি। দেশে মনে হয় আর মানুষ নেই। এমতাবস্থায় সবাইকে মানুষ হতে হবে। কাজ করতে হবে দেশ ও দেশের মানুষের জন্য। এগিয়ে আসতে হবে মানবতার জন্য।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close