অলোক আচার্য

  ২৪ জুলাই, ২০১৯

বিশ্লেষণ

অভাব মানেই অসম বণ্টন

পৃথিবীতে জন্ম নেওয়া প্রতিটি জীবেরই রয়েছে ক্ষুধার অনুভূতি। প্রতিদিন প্রতিক্ষণ প্রাণী ছুটেছে ক্ষুধা মেটানোর উদ্দেশ্যে। কেউ নিজের প্রয়োজনের চেয়ে বেশি খাদ্য নিয়ে উচ্ছিষ্ট ফেলে দেয় আবার সেই উচ্ছিষ্ট খেয়েই দিন কাটিয়ে দিচ্ছে অনেকে। কেউ আবার আধপেটা বা একবেলা খাওয়ার জন্য হাড়ক্ষয় করে। কী বিচিত্র এই পৃথিবী! একদিকে ক্ষুধার্ত বুভুক্ষু মানুষের চিৎকার; অন্যদিকে আধুনিক সভ্যতার আনন্দ। সেই যান্ত্রিকতা আনন্দে চাপা পড়ছে বুভুক্ষ মানুষের কষ্ট, আর্তনাদ। পরস্পর বিপরীতধর্মী হলেও এটাই পৃথিবীর নিয়ম। এই নিয়মেই চলছে সবাই। আমরা মেনেই নিয়েছি, কেউ না খেয়ে থাকবে আর অতিরিক্ত খাদ্য ডাস্টবিনে ফেলা হবে। তারপর সেই ডাস্টবিন থেকে কুকুর, বেড়ালের সঙ্গে অখাদ্য খুঁটে খুঁটে খাবে এই পৃথিবীতে জন্ম নেওয়া কিছু ভাগ্যহীন মানুষ। খাদ্যের অসম বণ্টন এবং অর্থনীতির ধনতান্ত্রিক গতিপ্রকৃতি এর জন্য দায়ী।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার মতো অন্যান্য সহযোগী সংগঠনগুলোর দেওয়া এক প্রতিবেদনে জানা যায়, গত বছর বিশ^জুড়ে ক্ষুধায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ছিল ৮২ কোটি ১০ লাখ। পরপর তিন বছরই ক্ষুধায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন দেশে যুদ্ধবিগ্রহ, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ২০১৫ সাল থেকে এ সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। জাতিসংঘের ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হলো বিশ^কে ক্ষুধামুক্ত করা। ২০১৭ সালে যেখানে ৮১ কোটি ১০ লাখ মানুষ পর্যাপ্ত খেতে পারত না; সেখানে বর্তমানে সেই সংখ্যাটি ৮২ কোটি ১০ লাখ। প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকিতে রয়েছে ২০০ কোটির বেশি মানুষ, যার আট শতাংশ উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপ। তারা পর্যাপ্ত পুষ্টি ও নিরাপদ খাবার পায় না। সেই সঙ্গে প্রতিবেদনে বাংলাদেশে দুই কোটির বেশি মানুষ ভালোভাবে খেতে পায় না বলে বলা হয়েছে। গত এক দশকে বাংলাদেশে অপুষ্টিতে ভোগা মানুষের সংখ্যা বেড়েছে অন্তত ১০ লাখ। ক্ষুধামুক্ত দেশ গড়া এবং প্রত্যেকের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি নিশ্চিত করা উন্নত দেশ গড়ার একটি চ্যালেঞ্জ।

ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি; কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের লেখা এই কবিতা থেকে ক্ষুধার যন্ত্রণা সম্পর্কে কিছুটা উপলব্ধি করা যায়। আবার প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ বলেছেন, রুচির রহস্য ক্ষুধায়। যেখানে ক্ষুধা নেই, সেখানে রুচিও নেই। অনেকের কাছে দুমুঠো ভাত যেন অমৃত। বিপরীতে অনেকের কাছে ভালো ভালো সুখাদ্যও অরুচিকর। ক্ষুধা প্রাণীর স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। মানুষ বাঁচার জন্য খায় নাকি খাওয়ার জন্য বাঁচেÑ একজন ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে সে প্রশ্ন অর্থহীন। প্রকৃতপক্ষে ক্ষুধা এমন এক কষ্ট, যা ক্ষুধার কষ্টে না থাকা কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী অনুভব করতে পারে না। তা সম্ভবও নয়। ব্যথিতের বেদনা কেবল একজন ব্যথিত হৃদয়ই বুঝতে পারে। বর্তমান পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ ক্ষুধার্ত থাকে। ঠিক সেই সময়ে প্রচুর খাবার নষ্ট হয়। ভারসাম্যহীন এই অবস্থার জন্য আমাদের দায় রয়েছে। একদিকে ক্ষধার্ত মানুষের যন্ত্রণার আওয়াজ; অন্যদিকে কোটি কোটি টাকার মারণাস্ত্রের বিকট শব্দ। কত কত আধুনিক অস্ত্রের সাজেসজ্জিত এই ধরণি। সেসব অস্ত্র কিনতে বা তৈরি করতে কত শতকোটি টাকা খরচ করছে বিশ^! এটাই সবথেকে আশ্চর্যের যে, মানুষ একমাত্র প্রাণী যারা অন্য মানুষের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য এসব অস্ত্র কিনছে। সেসব অস্ত্র বানাতেও কোটি কোটি ডলার ব্যয় করছে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট এখন ডোনাল্ড ট্রাম্প। উত্তর কোরিয়া ইস্যুতে এখন চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। কথায় বলে রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয় উলুখাগড়ার প্রাণ যায়। এই উলুখাগড়া হলো আমজনতা। যারা যুদ্ধ বোঝে না, যারা অস্ত্র বোঝে না, যারা দুমুঠো খাবার চেনে। অস্ত্র সেখানে নিরর্থক। যুদ্ধ মানেই অশান্তি, খাদ্যাভাব, পীড়িত মানুষের আর্তনাদ, গৃহহীন হওয়া, আত্মীয়স্বজনের জন্য চোখের জল ফেলা। উত্তেজনার বশে ক্ষমতার মোহে করা যুদ্ধে এর থেকে বেশি পাওনা আর কী আছে।

বর্তমানে যেসব অঞ্চলে যুদ্ধরত অবস্থা বিরাজ করছে; সেসব দেশের অবস্থা সম্পর্কে একটু খোঁজখবর নিলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী অবস্থা সম্পর্কে জানলেই দেখা যায়, ফেলে যাওয়া কিছু ধবংসাত্মক অবস্থা ছাড়া আর কিছুই নেই। সে অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়াতে সময় লেগেছে বহু বছর। কোটি কোটি মানুষের ক্ষুধার চিৎকার আধুনিক অস্ত্রের শব্দের কাছে বড়ই মøান মনে হয়। এটাই বুঝি বাস্তবতা। এ মুহূর্তে ইয়েমেনে চলছে অত্যন্ত খারাপ অবস্থা। সেখানে এখন বিশ্বের সবচেয়ে মানবিক বিপর্যয়। পৃথিবীতে যত যুদ্ধ হয়েছে সব জায়গাতেই রয়েছে পীড়িত মানুষের আর্তনাদ। যেখানে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের খাদ্যের অধিকার রয়েছে। কেউ ক্ষুধার্ত থাকার কথাও না। এমনকি কোনো প্রাণীরও ক্ষুধার্ত থাকার কথা না। সৃষ্টিকর্তার সৃষ্ট প্রতিটি জীবই ক্ষুধা মেটানোর অধিকার রাখে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি তাদের বাধ্য করে ক্ষুধা পেটে রাতে ঘুমাতে যেতে। ক্ষুধার্ত মানুষ কী কী করতে পারে। উত্তরটা এক কথায়। সবকিছু পারে। সে তখন নীতি-নৈতিকতার ঊর্ধ্বে থাকে। তাই ক্ষুধার সঙ্গে সমাজের আইনশৃঙ্খলার একটা প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। যত ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বাড়বে; প্রতিটি সমাজে ততই বিশৃঙ্খল অবস্থা বৃদ্ধি পাবে। কারণ প্রয়োজন কোনো আইন মানে না। নিজের বা পরিবারের ক্ষুধা মেটাতে অনেকেই জড়িয়ে যায় অনৈতিক কাজে। কারণ প্রয়োজনটাই মুখ্য, কাজটা নয়। অর্থনৈতিক দুরাবস্থার মাঝে এমনটা হতে পারে। প্রতিটি মুখের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সেই রাষ্ট্রের দায়িত্ব। প্রজাদের অভুক্ত রেখে রাজাদের মুখে মন্ডা মিঠাই খাজা উঠে কী করে। সেই যে কবিতায় জন্মদিনের পার্টিতে একটি কুকুরের যে খাতির দেখিয়ে ব্যঙ্গ করা হয়েছিল, তা আজও অসহায় মানুষের রূপ। আজকের তথাকথিত হাই সোসাইটিতে দামি অ্যালসেসিয়ানকে খাওয়াতে যে টাকা খরচ হয়, তার অনেক কম টাকাতেই তো অভুক্তের পেট ভরে। তবু মানুষ হয়েও পর্যাপ্ত খাদ্য নিশ্চয়তা তারা কেন পাবে না।

ক্ষুধা এবং দরিদ্রই একটি দেশের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে। এর পেছনের কারণগুলো সমাধান করা তাই জরুরি। ২০১৫ সালে এন এজেন্ডা ফর দ্য গ্লোবাল ফুড সিস্টেম শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে এশিয়া বা আফ্রিকাসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ক্ষুধা ও দরিদ্রতার বাস্তবতা বিবেচনায় রেখেই ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বিশ্ব গড়ার এ পরিকল্পনার কথা জানানো হয়। ২০৩০ সালের মধ্যে গোটা বিশ্ব থেকে দরিদ্রতা দূর করার আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছিল। আরো উল্লেখ করা হয়, বিশ্বে প্রতি রাতে কমপক্ষে ৮০ কোটি মানুষ পেটে ক্ষুধা নিয়ে ঘুমাতে যায়। বিভিন্ন দেশ এ থেকে উত্তরণের জন্য একটি ভালো খাদ্য ব্যবস্থা গড়তে গ্রামাঞ্চলে উন্নত কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করছে। ক্ষুধা ও দরিদ্র নিয়ে যে কেবল আমাদের মতো উন্নয়নশীল বা দরিদ্র দেশগুলোই চিন্তিত; বিষয়টা এমন নয়। অনেক উন্নত দেশেই ক্ষুধা এবং পুষ্টি বিষয়টি চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। আমাদের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। মাথাপিছু আয় দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের চিত্র নির্দেশ করে। কিন্তু প্রকৃত উন্নয়ন তখন সম্ভব হবে; যখন দরিদ্রতার হার উল্লেখযোগ্য হারে কমাতে সক্ষম হব। এটা একটা বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে। ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী গড়তে সারা বিশ্বের সামনে নিজের উন্নয়ন একটি মডেল। তবে এসডিজি অর্জন করতে হলে অবশ্যই দরিদ্রতার হার একেবারে কমিয়ে আনতে হবে। সোনার বাংলা গড়ে তুলতে হলে প্রতিটি হাতের জন্য কাজের ব্যবস্থা করতে হবে। সেই সঙ্গে প্রতিটি পরিবারেই ফিরবে আর্থিক সামর্থ্য। খাদ্য বণ্টনে ভারসাম্য আনাটাই এখন সময়ের দাবি।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close