ফোরকান উদ্দিন আহমদ

  ২৩ জুলাই, ২০১৯

মতামত

নার্সিং পেশার উন্নয়ন ও সম্ভাবনা

এক লাখের বেশি নার্সের ঘাটতি রয়েছে দেশে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী হাসপাতালের শয্যা, চিকিৎসক ও নার্সের অনুপাত হতে হবে ১:৩। অর্থাৎ একজন চিকিৎসকের সঙ্গে অন্তত তিনজন নার্স থাকতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে বর্তমানে সরকারিভাবে কর্মরত নার্স আছেন মাত্র ৪৮ হাজার। নার্সিং বিভাগ এড়িয়ে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাবিজ্ঞান বিভাগের সফলতা চিন্তা করা যায় না। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাবিজ্ঞান বিভাগের অন্যতম একটি অঙ্গ নার্সিং বিভাগের সুবিধা-অসুবিধা, একাল-সেকাল খুব বেশি তিতে ও ফিকে বলেই মনে হচ্ছে। সময়ের প্রয়োজনে চিকিৎসাবিজ্ঞান বিভাগের সব অপশনে ব্যাপক পরিবর্তন ও আধুনিকায়ন হলেও নার্সিং বিভাগ চিরবঞ্চিত এবং অবহেলিতই থেকে গেছে। আর এর সঙ্গে জড়িত লাখ লাখ কর্মী নিজেদের মানমর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করে দিন-রাত দায়িত্ব পালন করে অসুস্থ, মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের কাছে থেকে, পাশে থেকে, আপনার চেয়ে আপন হয়ে কখনো মাতৃ, কখনো ভগ্নি, কখনো পিতৃস্নেহে, কখনো জীবসঙ্গীর সোহাগের দোহাই আদর-যতœ, মায়া-মমতা দিয়ে আসছেন। অথচ এসব সেবক-সেবিকার খবর কেউ রাখছেন না। নীরবে-নিভৃতে অবিরাম নিরলসভাবে তারা নিজকে উৎসর্গ করে হাসপাতাল-ক্লিনিকের শয্যাপাশে আপন মনে সেবাদান করে যাচ্ছেন।

সেবা একটি মহান পেশা। চিকিৎসাসেবার মাধ্যমে সেবাকে পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন সেবক-সেবিকারা। সৃষ্টির ঊষালগ্ন থেকে জগতের সঙ্গে সেবা কথাটি সংযুক্ত ও সম্পৃক্ত হয়ে আছে। সেবা নানাভাবে বিস্তৃত ও বিচিত্র। যেমন জনসেবা, সমাজসেবা, মানবসেবা, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি। এ রকম নানা ধরনের সেবাকর্মের আদল থাকলেও একমাত্র পেশা হিসেবে স্বীকৃত। সারা পৃথিবীর এ স্বাস্থ্যসেবা পেশার সঙ্গে লাখ লাখ কর্মী জড়িত। অন্যান্য সেবাকর্ম পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারেনি। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাবিজ্ঞান বিভাগের সঙ্গে সেবাকর্ম নানা বিবর্তন পেরিয়ে নার্সিং বিভাগ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এসব সেবক-সেবিকার কেউ নার্স, কেউবা সিস্টার, কেউবা ব্রাদার বলে ডেকে নিজের অসুবিধার কথা তুলে ধরে সেবা নিচ্ছেন। কেউ তাদের কাছে সুবিধার কথা কোনো দিন বলে না। কেউ ব্যথা-বেদনার কথা বলে, কেউবা না পাওয়ার কথা বলে, কেউ আবার উদ্ভট যতসব অভাব-অভিযোগ কিংবা আবদারের কথা বলে থাকেন। অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে সব ধরনের রোগী বা রোগীর সঙ্গীর কথা শুনতে হয় সেবক-সেবিকাদের। শত অপ্রতুলতা, অপর্যাপ্ততা থাকার পর সবার চাহিদা কম-বেশি মিটাতে হয়। সেবক-সেবিকাদের কাউকে সান্ত¡না দিতে হয়, কাউকে উপদেশ দিতে হয়, কাউকে সোহাগের দোহাই দিতে হয়, কাউকে ওষুধ দিতে হয়। এসব দিতে গিয়ে অনেক সময় অনেক বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। অথচ চিকিৎসক, টেকনিশিয়ান ওষুধপত্র লিখে দিয়েও পরীক্ষা-নিরীক্ষা দিয়েই খালাস। কখনোই কোনো জটিল, কঠিন, মৃত্যুপথযাত্রী রোগী কিংবা তার আত্মীয়স্বজনের আর্তনাদ কোনো চিকিৎসক বা টেকনিশিয়ানদের শুনতে হয় না।

যত আহাজারি, যত কান্না, যত চিৎকার, যত অভাব-অভিযোগের বাণী নার্সদেরই শুনতে হয়। অথচ এসব নার্সের কোনো মর্যাদার কথা কেউ কোনো দিন চিন্তা করেছে বলে মনে হয় না। তাদেরও অভাব-অভিযোগ রয়েছে। তাদের সুযোগ-সুবিধার কথা কেউ আমলেই নিচ্ছেন না। বরং সবাই তাদের অবজ্ঞা করছেন। কেউ কেউ একটু এগিয়ে গিয়ে নার্সিং পেশাকে অমর্যাদাকর বানাতেও দ্বিধা করছেন না। খোদ স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিভাগের লোকজনই তাদের স্বীকৃতি দিতে চাচ্ছেন না। একজন মানসিক অশান্তি বা বিপর্যস্ত থাকলে দিনে যত কষ্ট পায়, শহরের সব সন্ত্রাসী, মাস্তান মিলে ততসংখ্যক মানুষকে কষ্ট দিতে পারে না। দেশের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে সেই নার্সদের ওপরে চলছে নৈরাজ্য। আর কতটুকু যাবে কামাল, নাজমা, আবুল খায়ের নামক দালালদের দৌরাত্ম্য।

জানা গেছে, নার্সিং সেক্টরে প্রশাসনের নিচ থেকে শীর্ষ প্রতিটি পদে ঘুষ এখন ‘ওপেন সিক্রেটে’ পরিণত হয়েছে। অধিদফতর থেকে মন্ত্রণালয় প্রতি পদে পদে ঘুষ। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার কাছে জিম্মি হয়ে গেছে নার্সিং অধিদফতর। অধিদফতর প্রতিষ্ঠিত হলেও পরিচালক, উপপরিচালক ও সহকারী পরিচালকসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক পদই শূন্য। এসব পদ চলতি দায়িত্বে নিজ বেতনে নার্সিং কর্মকর্তা দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। ফলে নার্সিং শিক্ষা খাতের উন্নয়ন সম্ভব হচ্ছে না। অথচ স্বাস্থ্যসেবা দানের ক্ষেত্রে নার্সিং শিক্ষা খাত অনেক গুরুত্বপূর্ণ। চিকিৎসাসেবার বড় অবদান রাখে নার্সিং শিক্ষা খাত। শিক্ষা দিয়েই সব কিছু শুরু হয়। একজন নার্স তৈরি করতে গেলে শিক্ষা খাত গুরুত্বপূর্ণ হলেও নজিরবিহীন অব্যবস্থা বিরাজ করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্বাস্থ্য খাতের বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশে শুধু একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে নার্সিংয়ে উচ্চতর ডিগ্রি এমএসসি নার্সিং চালু হয়েছে, যেখানে আসন সংখ্যা মাত্র ৫০। এর বেশির ভাগ (প্রায় ৯৭%) সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত চাকরিজীবীদের জন্য বরাদ্দ; ৩ শতাংশ বিদেশি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য। এ ব্যাপারে আমাদের যা করণীয়, তা হলো : ১. সরকারি এবং বেসরকারি সেক্টর বা খাত থেকে স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে আমাদের একটা কমিটি তৈরি করতে হবে; ২. ইনিশিয়েটদের জোরালো পদক্ষেপসহ ডায়ালগ বা আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে; ৩. বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন কর্তৃক বিএসসি-ইন নার্সিং গ্র্যাজুয়েটদের জন্য ক্যাডার সার্ভিসে পদ চালু করতে হবে এবং নার্সিং কারিকুলামকে ঢেলে সাজাতে হবে; ৪. বাংলাদেশ নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কাউন্সিল ডিজিএনএমএসের সহযোগিতায় দক্ষ নার্স ও শিক্ষাবিদদের নিয়ে একটা বিশেষজ্ঞ কারিকুলাম কমিটি গঠন করতে হবে; ৫. ডিপ্লোমা-ইন নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি এবং বিএসসি-ইন নার্সিং উভয় প্রোগ্রামেরই বিষয় কমাতে হবে এবং ব্যবহারিক সময় আরো বৃদ্ধি করতে হবে।

যেহেতু বাংলাদেশে নার্সদের নির্দিষ্ট কোনো ক্যারিয়ার ল্যাডার নেই, যেহেতু নার্সিং পেশাটি সেগমেন্টেড। সিনিয়র বা জ্যেষ্ঠ নার্সরা বেশি হতাশায় ভুগছেন। কারণ দেশে তাদের পদোন্নতির কোনো সুযোগ নেই। প্রবেশকালীন সময় থেকেই তারা একাডেমিক এবং ক্লিনিক্যাল সেটিংয়ে জ্যেষ্ঠ পদে কাজ করে আসছেন। এ ক্ষেত্রে নার্স-শিক্ষকরা তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য সমান সুযোগ পাচ্ছেন না। তাদের অনেকেরই মূল পদ সিনিয়র স্টাফ নার্স। এই পদে থেকে অনেকেই ৩০-৩৫ বছর চাকরি করে আসছেন। যদিও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে বেশিসংখ্যক সিনিয়র পদে নিয়োগ হচ্ছে। কিন্তু তারা পর্যাপ্ত স্বীকৃতি ও সুবিধা পাচ্ছেন না। দেশের উন্নয়নের জন্য সরকারি এবং বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রেই সরকারকে সমানভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। নিবন্ধিত নার্সদের আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। পরিশেষে এ কথা বলা যায় যে, নার্সিং পেশার গুণগত মান বৃদ্ধির যথাযথ পদক্ষেপসহ সব অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে সরকারকে কঠোর ও অনমনীয় হতে হবে। পাশাপাশি নার্সিং ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য এ বিভাগ থেকে দুর্নীতিকে মূলোৎপাটন করে এই বিভাগের আমূল সংস্কারে আন্তরিক ও মনোযোগী হয়ে পরিকল্পনামাফিক ঢেলে সাজাতে হবে।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close