ইসমাইল মাহমুদ

  ২২ জুলাই, ২০১৯

মুক্তমত

মৃত্যুদন্ড এখন সময়ের দাবি

আমাদের মানবসভ্যতার ইতিহাসের যেসব অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে, তার মধ্যে সর্বাধিক জঘন্যতম অপরাধ হলো নারী বা শিশু ধর্ষণ। বেশির ভাগ মানুষের মতে, নারী ধর্ষণ হত্যাকান্ড বা খুনের ঘটনার চেয়েও জঘন্যতম একটি অপরাধ। একজন মানুষ হত্যাকান্ডের শিকার হলে তিনি একবারই মৃত্যুবরণ করলেন। ধর্ষণ শেষে হত্যাকান্ডের শিকার হলেও তাই। কিন্তু একজন নারী বা শিশু ধর্ষণের শিকার হয়ে বেঁচে থাকলে তিনি মানসিকভাবে বিধ্বস্ত, সামাজিকভাবে নিগৃহীত হন। তিনি বেঁচে থাকলেও যেন মৃত। ধর্ষণের রেশ ধর্ষিতা নারীকে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হয়। কোনো নারী ধর্ষণের শিকার হলে তিনি হারান তার সম্মান, পরিবার-পরিজন। পাড়া-প্রতিবেশীদের কটূক্তি তো রয়েছেই। কোনো কোনো স্থানে সমাজের মানুষের আচার-আচরণে মনে হয় ধর্ষক নামের নরপশুদের কোনো অপরাধ নেই, সব অপরাধ ধর্ষিতা নারীরই। তিলে তিলে ধর্ষিতা নারী হারিয়ে ফেলেন তার জীবনের সব সুখ-শান্তি। আবার কখনো কখনো ওই নারীর সন্তান-সন্ততিরাও ভোগ করেন গ্লানিকর জীবন। ধর্ষিতা নারী মামলা-মোকদ্দমায় গেলে আদালতে ও মেডিকেলে তাকে ধর্ষণের চেয়েও গ্লানিকর অবস্থার মুখোমুখি হতে হয়। তখন ওই নারী বেঁচে থাকলেও তিনি থাকেন জীবনামৃত। এসব কারণে স্বাভাবিক কারণেই দেশের সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্নের উদ্বেগ হয় ধর্ষক নামের পুরুষ কর্তৃক একজন নারীর সারা জীবন গ্লানিকর করে তোলার পর ওই ধর্ষকের কিরূপ শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়?

বাংলাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩)-এর ৯ ধারা অনুযায়ী ধর্ষণের অপরাধের যেসব শাস্তির বিধান রয়েছে তা হলো : ১. যদি কোনো পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন, তা হলে তিনি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদন্ডেও দন্ডনীয় হইবেন। ২. যদি কোনো ব্যক্তি কর্তৃক ধর্ষণ বা উক্ত ধর্ষণ পরবর্তী তাহার নিষেধ কার্যকলাপের ফলে ধর্ষিতা নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি মৃত্যুদন্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অন্যূনতম এক লাখ টাকা অর্থদন্ডেও দন্ডনীয় হইবেন। ৩. যদি একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন এবং ধর্ষণের ফলে উক্ত নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে বা তিনি আহত হন, তাহা হইলে ঐ দলের প্রত্যেক ব্যক্তি মৃত্যুদন্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অন্যূনতম এক লাখ টাকা অর্থদন্ডেও দন্ডনীয় হইবেন। ৪. যদি কোনো ব্যক্তি কোনো নারী বা শিশুকে-(ক) ধর্ষণ করিয়া মৃত্যু ঘটানোর বা আহত করার চেষ্টা করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদন্ডেও দন্ডনীয় হইবেন (খ) ধর্ষণের চেষ্টা করেন, তাহা হইলে ব্যক্তি অনধিক দশ বছর কিন্তু অন্যূনতম পাঁচ বৎসর সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদন্ডেও দন্ডনীয় হইবেন। ৫. যদি পুলিশ হেফাজতে থাকাকালীন সময়ে নারী ধর্ষিতা হন, তাহা হইলে যাহাদের হেফাজতে থাকাকালীন উক্ত রূপ ধর্ষণ সংঘটিত হইয়াছে, সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তিগণ ধর্ষিতা নারীর হেফাজতের জন্য সরাসরিভাবে দায়ী ছিলেন, তিনি বা তাহারা প্রত্যেকে, ভিন্নরূপ প্রমাণিত না হইলে, হেফাজতের ব্যর্থতার জন্য, অনধিক দশ বৎসর কিন্তু অন্যূনতম পাঁচ বৎসরের সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অন্যূনতম দশ হাজার টাকা অর্থদন্ডেও দন্ডনীয় হইবেন। এছাড়া উল্লেখ্য যে, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ এর ৩২ ধারা মতে, ধর্ষিতা নারী ও শিশুর মেডিকেল পরীক্ষা ধর্ষণ সংঘটিত হবার পর যত শিগগিরই সম্ভব সম্পন্ন করতে হবে। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক এতে অবহেলা করলে আদালত চিকিৎসকের বিরুদ্ধেও শাস্তির বিধান রেখেছেন।

এবার বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নারী ধর্ষণকারীদের কি শাস্তি দেওয়া হয়, তার দিকে চোখ বোলানো যাক : ভারতে ২০১৩ সালে ধর্ষণবিরোধী আইন পাস হয়। এরপর ভারতে ধর্ষণের সাজা কিছুটা শক্তিশালী হয়েছে। বর্তমানে ভারতে ধর্ষককে ৭ থেকে ১৪ বছর পর্যন্ত কারাবাস করতে হয়। চলতি বছরে ভারতে আইন সংশোধন করে ধর্ষণ শেষে হত্যার ঘটনায় মৃত্যুদন্ড প্রদানের বিধান করা হয়েছে। ইসরায়েলে একজন ধর্ষককে অপরাধভেদে সর্বনি¤œ ৪ বছর থেকে সর্বোচ্চ ১৫ বছর পর্যন্ত কারাবাস করতে হয়। পোল্যান্ডে ধর্ষণ প্রমাণিত হলে ধর্ষককে হিংস্র বুনো ও অভুক্ত শূকরের খাঁচায় ফেলে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়! উত্তর কোরিয়ায় ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদন্ড ছাড়া আর কিছু নেই। সেখানে ধর্ষণের অভিযোগ প্রাপ্তির পর ধর্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে গুলি করে হত্যা বা মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কোনো ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে প্রথমেই দেখা হয় ধর্ষিতার বয়স ও ধর্ষণের মাত্রা। এর ওপর নির্ভর করে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পর ধর্ষকের কী শাস্তি হবে। সেখানে সর্বোচ্চ ৩০ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড হয় ধর্ষকের।

চীনে ধর্ষণ প্রমাণ হলে ধর্ষকের বিশেষ অঙ্গ কর্তন এবং সরাসরি মৃত্যুদন্ড প্রদান করা হয়। এর বাইরে আর অন্য কোনো শাস্তির বিধান নেই চীনে। মালেশিয়ায় কোনো নারী ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে এবং ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণিত হলে ধর্ষকের একমাত্র শাস্তি হলো সরাসরি মৃত্যুদন্ড। সেখানে আর কোনো শাস্তির ব্যবস্থা নেই ধর্ষকের। সৌদি আরবে কোনো নারী ধর্ষণের শিকার হলে এবং তা প্রমাণিত হলে ধর্ষককে শুক্রবার জুমার নামাজের পর প্রকাশ্যে শিরñেদ করে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। মঙ্গোলিয়ায় কোনো নারী ধর্ষণের শিকার হলে অপরাধ প্রমাণসাপেক্ষে ধর্ষিতা বা তার পরিবারের হাত দিয়ে ধর্ষকের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। আফগানিস্তানে কেউ ধর্ষণ করে ধরা পড়লে ধরা পড়ার মাত্র চার দিনের মধ্যে ধর্ষকের মাথায় গুলি করে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। সেখানে আদালতের রায় ও আপিলের কোনো সুযোগ নেই। ইরানে ধর্ষণ প্রমাণিত হওয়ার পর ধর্ষককে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে অথবা সরাসরি গুলি করে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। তবে কখনো ধর্ষিতা নারীর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে আসতে পারে, তবে ধর্ষক এই সর্বোচ্চ শাস্তির হাত থেকে রক্ষা পেয়েও যেতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে সামাজিক চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে তারা এটি করতেও পারে। তবে তার পরও অভিযুক্ত পুরোপুরি শাস্তি এড়াতে পারে না। ধর্ষিতার অনুমতিতে মৃত্যুদন্ড রহিত হলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে যাবজ্জীবন কারাদন্ড অথবা ১০০ চাবুকের আঘাতের শাস্তি তাকে ভোগ করতেই হয়। অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতারপূর্বক অভিযোগ প্রমাণ হলে গুলি করে হত্যা করা হয়। ধর্ষণ ঘটনার প্রমাণসাপেক্ষে মাত্র সাত দিনের মধ্যে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। মিসরে ধর্ষণ ঘটনা প্রমাণের পর পূর্বঘোষণা দিয়ে প্রকাশ্যে বা সবার সামনে ধর্ষককে ফাঁসির দড়িতে ঝোলানো হয়। তাদের আইনের বিধানমতে, প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়া মানে শুধু ধর্ষককে শাস্তিই দেওয়া হয় না। ওই ধর্ষকের ফাঁসির পাশাপাশি একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়; যাতে করে পরবর্তী সময়ে আর কেউ এ ধরনের অপরাধ করার সাহস না পায়। ফ্রান্সে ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণিত হলে প্রাথমিকভাবে ধর্ষককে ১৫ বছর সশ্রম কারাদন্ড (সঙ্গে শারীরিক অত্যাচার) দেওয়া হয়। তবে পরবর্তীতে যদি দেখা যায়, ধর্ষিতা নারীর অবস্থা গুরুতর, সেক্ষেত্রে শাস্তির মেয়াদ বাড়িয়ে ৩০ বছর এমনকি যাবজ্জীবন কারাদন্ডাদেশও দেওয়া হতে পারে। দক্ষিণ আফ্রিকায় ধর্ষণের শাস্তি কমপক্ষে ২০ বছরের কারাদন্ড। নেদারল্যান্ডসে যেকোনো ধরনের শারীরিক মিলন বা অত্যাচার এমনকি জোরপূর্বক চুমু খাওয়াকেও ধর্ষণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ওই নারী যদি একজন দেহ ব্যবসায়ীও হন, তবু তার সম্মতি ব্যতিরেকে তাকে চুমু খেলেও তা ধর্ষণ হিসেবে গণ্য হবে। আর এ ক্ষেত্রে ধর্ষকের শাস্তি নির্ভর করে ভুক্তভোগীর বয়সের ওপর। বয়সভেদে ধর্ষককে ৪ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদন্ড ভোগ করতে হয়। মধ্যপ্রাচ্য ও আরব দুনিয়ায় ধর্ষণের শাস্তি অত্যন্ত কঠোর। সে দেশগুলোর অধিকাংশটিতেই ধর্ষককে প্রকাশ্যে পিটিয়ে মারা হয়। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত পাথর ছুড়ে হত্যা, ফাঁসি, হাত-পা কাটা, যৌনাঙ্গ কেটে অতি দ্রুত মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। গ্রিসে ধর্ষককে ইহকালেই নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়। কোনো নারী ধর্ষণের শিকার হলে এবং ধর্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে ধর্ষককে জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করার মাধ্যমে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। নরওয়েতে ধর্ষিতার শারীরিক অবস্থার ওপর বিবেচনা করে ধর্ষককে ৪ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড দেওয়া হয়। রাশিয়ায় কোনো নারী ধর্ষণের শিকার হলে ধর্ষককে ২০ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদন্ড ভোগ করতে হয়। (তথ্য সূত্র : ইন্টারনেট)

ওপরের দেশগুলোর ধর্ষণের পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে দেখা যায়, যেসব দেশে ধর্ষককে সরাসরি মৃত্যুদন্ড প্রদান করা হয়; সেসব দেশে ধর্ষণের সংখ্যা অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেকটা কম। তাই ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদন্ডই হতে পারে ধর্ষণের মতো অপরাধ নিয়ন্ত্রণের একমাত্র পথ। ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদন্ড করা হলে একদিকে অপরাধীরা নির্মূল হবে; অন্যদিকে একই অপরাধের জন্য নতুন অপরাধী তৈরি হবে কম। হয়তো নতুন অপরাধীর সংখ্যা নেমে যেতে পারে শূন্যের কোটায়। তাই ধর্ষণের মতো অপরাধের শাস্তি মৃত্যুদন্ডই আমাদের দেশের জন্য এখন সময়ের দাবি।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close