রায়হান আহমেদ তপাদার

  ২২ জুলাই, ২০১৯

পর্যালোচনা

মানসম্পন্ন ওষুধ নিশ্চিত করা জরুরি

সভ্য সমাজে খাদ্যে ভেজালের বিষয়টি একেবারে অকল্পনীয়। কিন্তু আমাদের দেশে এটি নিয়তির লিখন হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, কোথায় ভেজাল নেই, সেটি নিয়েই এখন গবেষণা করা দরকার। অনেকে ভেজাল খাদ্যের ভয়ে মানসিকভাবে আতঙ্কগ্রস্ত। জীবন রক্ষাকারী ওষুধেও চলছে ভেজাল। আমাদের দেশে ভেজালের যে সর্বগ্রাসী আগ্রাসন তাতে মনে করা যেতেই পারে একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আমরা সভ্যতার মাপকাঠিতে এদিক থেকে জংলিযুগের চেয়েও পিছিয়ে আছি। কারণ আর যাই হোক, জংলিযুগের অধিবাসীরা ভেজালের মতো ঘৃণ্য কাজে লিপ্ত হওয়ার কথা ভাবতেও পারত না। প্রশ্ন ওঠে, দেশে সরকার, পুলিশ প্রশাসন, আইন-আদালত থাকা সত্ত্বেও ভেজালের দৌরাত্ম্য কেন বন্ধ করা যাচ্ছে না। নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩ হয়েছে তাতেও কিছুই এসে যায় না, ভেজালকারীদের। দাপট চলছেই। এভাবেই কি চলবে? না এভাবে চলতে দেওয়া যায় না। তাছাড়া চিকিৎসা এক মানবিক সেবা ও পেশার নাম। মানবসেবার নামে এ সেবায় অর্থ, মুনাফা বা অন্য কিছু অর্জনের চেয়ে মানবসেবাই মুখ্য হওয়া উচিত। মানবসেবার মধ্যে নাকি সৃষ্টিকর্তাকেও পাওয়া যায়। জ্ঞানী-গুণীর মুখ থেকে আমরা বহুবার এ রকম সত্য নীতিবাক্য আগেই শুনেছি। তাই টাকা-পয়সা সব কিছুর ঊর্ধ্বে থেকে কায়মনো বাক্যে হৃষ্টচিত্তে মানবসেবায় প্রাধান্য পাওয়া উচিত। যুগ যুগ ধরে চিকিৎসার এ মানব বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করে আসছে চিকিৎসক বা ভিষকবৃন্দ। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য যে, কালের বিবর্তনে চিকিৎসায় মানুষের সেবার ক্ষেত্রে সে সত্যবোধ নীতিবাক্য হারিয়ে গিয়ে প্রাধান্য পেয়েছে অর্থ, বাণিজ্য। যার কারণে বর্তমানে হাজার বছরের চিকিৎসায় মানবসেবার দিকটা আজ উপেক্ষিত।

আমাদের মৌলিক অধিকারের মধ্যে চিকিৎসা একটি। তাই আমাদের সংবিধানেও মানবসেবায় স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাকে অন্তর্ভুক্ত করে নাগরিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। আমাদের স্বাধীনতার ৪৫ বছরে রাষ্ট্রের বিভিন্ন সেক্টরে যেমন উন্নতি হয়েছে; তেমনি দেশে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন হাসপাতাল, ক্লিনিক স্থাপিত হয়েছে। চিকিৎসাকে প্রকৃত অর্থেই মানবসেবায় পরিণত করতে বেসরকারিভাবে আরো হাসপাতাল-ক্লিনিক স্থাপনের অনুমতি দিয়েছে সরকার। মানুষ বেকায়দায় বা সমস্যায় না পড়লে পুলিশ বা ডাক্তারের শরণাপন্ন হয় না। সাধারণ নাগরিক স্বাভাবিকভাবে প্রত্যাশা করে চিকিৎসাসেবাকে প্রকৃত অর্থেই মানবিক সেবা ও পেশা হিসেবে বেছে নিবে এসব সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের মালিকরা। দেশে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে স্থাপিত কিছু হাসপাতাল ও ক্লিনিক মানবসেবার হাত বাড়িয়ে দিলেও বেশির ভাগ বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকের ভূমিকা যথার্থ নয়, প্রশ্নবিদ্ধ। জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ওষুধের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য যে, বর্তমান ওষুধের গুণগত মান এতটা নিম্নমুখী যে তাতে রোগীর রোগ ভালো তো হয় না, বরং রোগ আরো বেড়ে যায়। বাংলাদেশে যেভাবে ওষুধশিল্পের প্রসার ঘটেছে, তা অভাবনীয় এবং ইতিবাচক। সম্প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, ওষুধশিল্পের প্রসার ও নিয়ন্ত্রণে জাতীয় ওষুধনীতি-২০১৬ এর খসড়া মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়েছে। পাশাপাশি এটাও আমাদের মনে রাখা উচিত, ওষুধ হচ্ছে জীবন রক্ষাকারী একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

এমনকি বাংলাদেশে উৎপাদিত বিভিন্ন কোম্পানির ওষুধ পৃথিবীর ১৫০টি দেশে রফতানি হচ্ছে। বিষয়টি নিঃসন্দেহে ইতিবাচক ও প্রশংসনীয়। তাই ওষুধের যেন গুণগত মান বজায় থাকে; সেদিকে লক্ষ রাখা অবশ্যই উচিত। ভেজাল ও মানহীন ওষুধ মানবজীবনে ক্ষতিকর যেমন ক্ষতিকর ভেজাল খাদ্য। পত্র-পত্রিকার রিপোর্ট থেকে জানা যায়, বিভিন্ন সময়ে দেশের বিভিন্ন মার্কেটে অভিযান চালিয়ে প্রচুর পরিমাণ অনিবন্ধিত নকল ভেজাল ওষুধ জব্দ করা হয়। একশ্রেণির অসাধু অতি মুনাফালোভী চক্র রয়েছে, যাদের কাজই হচ্ছে মানুষকে ঠকানো এবং এরাই নকল ভেজাল ওষুধ সরবরাহ করে থাকে। তবে ভেজাল নকলের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ। সম্প্রতি সরকার বেশ কয়েকটি ওষুধ কোম্পানির লাইসেন্স বাতিল করে। পাশাপাশি ২৩টি কোম্পানির অ্যান্টিবায়োটিকসহ বিভিন্ন ওষুধ উৎপাদন, বিপণনে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। তবু কিছু কিছু কোম্পানি সরকারের নির্দেশ উপেক্ষা করে মানহীন ওষুধ উৎপাদন বিপণন অব্যাহত রেখেছে বলে জানা যায়। সংগত কারণেই বিষয়টি আমলে নিতে হবে এবং আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। হাইকোর্টও সে ধরনের নির্দেশ দিয়েছেন। কারণ সরকারি নির্দেশ উপেক্ষা, মানহীন নকল ভেজাল ওষুধের ব্যবহার মানুষের জীবনকে ঠেলে দিচ্ছে মৃত্যুর মুখে, এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। এ যেন মানুষের জীবন নিয়ে খেলা। গত বছর ২ জুলাই ধানমন্ডির পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অভিযান চালিয়ে মেয়দোত্তীর্ণ ওষুধও রাসায়নিক সংরক্ষণের অপরাধে ২৫ লাখ টাকা জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের এক তথ্যে জানা যায়, গত ছয় মাসের বাজার তদারকি করে রাজধানীর প্রায় ৯৩ শতাংশ ফার্মেসিতে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ পেয়েছেন তারা। মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ মানবদেহে প্রবেশ মানে জীবন নিয়ে খেলা। তাছাড়া গত বছর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের বেসরকারি চিকিৎসা সেবা খাতে কমিশন ভিত্তিক বিপণন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। এই খাতে বাণিজ্যকরণের প্রবণতা প্রকট। সরকারের যথাযথ মনোযোগের ঘাটতি থাকায় নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। অথচ সেবাগ্রহীতারা ব্যাপকভাবে আর্থিক ও শারীরিক ক্ষতির শিকারের পাশাপাশি মানসম্পন্ন চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিতও হচ্ছেন। এতে দেশের বিভিন্ন জেলায় নিবন্ধিত ১১৬টি বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। উপরোন্ত মানহীন, নকল, ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বাজারজাতকরণে সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও শঙ্কা দেখা দিয়েছে। মানবসেবার নামে যে চিকিৎসাশাস্ত্রের তৈরি হয়েছে, ডাক্তার তৈরি হয়েছে কিন্তু অধিকাংশ ডাক্তারের আচার-আচরণ সন্তোষজনক নয়। সেবার মানও প্রশ্নবিদ্ধ। অর্থ অর্জনের জন্য ব্যাঙের ছাতার মতো গজে ওঠা বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে পর্যাপ্ত ডাক্তার নেই, প্রয়োজনীয় ওষুধ সামগ্রীর যথেষ্ট অভাব। এসব হাসপাতাল-ক্লিনিকের মালিকরা যা ইচ্ছা তাই করেন। সরকারের নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেন না। অথচ স্বাস্থ্য চিকিৎসাকে জনগণের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে সংবিধানে। দেশের সরকার অনুমোদিত ও অননুমোদিত অনেক চিকিৎসাকেন্দ্র গড়ে উঠেছে। অধিক ব্যয়সাপেক্ষ এসব চিকিৎসাকেন্দ্রে সবার পক্ষে চিকিৎসা নেওয়া সম্ভব নয়। অথচ বাংলাদেশের বিভিন্ন ওষুধ কারখানাগুলোতে ২৭ হাজার ব্র্যান্ডের ওষুধ উৎপাদিত হয়। যদি তাই হয়ে থাকে ২২ হাজার ওষুধ কোনো রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই বাজারে চলে যাচ্ছে, বিক্রিও হচ্ছে অবাধে।

চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতে, ওষুধের মধ্যে যেহারে বিভিন্ন উপাদান থাকার কথা; সেগুলো না থাকলেই ওই ওষুধ মানহীন। আর মানহীন ওষুধই হচ্ছে বিষ। তা হলে মান নির্ণয়ের পর্যাপ্ত ল্যাবরেটরি না থাকায় এসব ওষুধ সেবনের নামে মানুষ বিষ পান করছে! নকল ভেজাল মানহীন ওষুধ রোগ নিরাময়ের পরিবর্তে রোগকে আরো বাড়িয়ে দেবে। তাছাড়া প্রায় প্রতিদিন নতুন নতুন ওষুধও বাজারে আসছে। কি পরিমাণ ওষুধ বাজারে আসছে, তার সঠিক কোনো তথ্য যেমন নেই; তেমনি ওষুধের মান নির্ণয়ও যথাযথ হচ্ছে না। ওষুধশিল্পকে আরো গতিশীল ও নিয়ন্ত্রণ করা, মান নির্ণয়ে ল্যাবের সক্ষমতা বাড়ানো দরকার। বাংলাদেশের ওষুধ একটি সম্ভাবনাময় শিল্প। জাতীয় ওষুধ নীতিমালায় কিছু দিক সন্নিবেশিত করা হয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কার্যকর, নিরাপদ ও মানসম্পন্ন ওষুধ। তাই নকল, ভেজাল, নিম্নমান, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ফার্মেসিতে মজুদ, প্রদর্শন শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে নীতিমালায় এসেছে। তা সুষ্ঠু বাস্তবায়ন জরুরি। তেমনি আদালতের নির্দেশনা মানাও জরুরি। শুধু নীতিমালা বা আইন করলেই চলবে না, তার যথার্থ প্রয়োগ ঘটাতে হবে। আমরা শিশুদের জন্য বিষাক্ত খাদ্য চাই না। আমরাও ভেজালমুক্ত খাবার খেতে চাই। কিন্তু তা সম্ভব হচ্ছে না। ভেজাল খাবার খেয়ে আমাদের কারো কিডনি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, কারো ফুসফুস আক্রান্ত হচ্ছে। ক্যাংসার কিংবা অন্য কোনো জটিল রোগে ভুগছেন স্বজনরা। নিজেও সুস্থ নই। ক্যানসারে মারা গেছেন চাচা। বাড়ির পাশের শিশুটাও জটিল রোগে আক্রান্ত। রোগবালাই পেয়ে বসেছে আমাদের। মানুষ অকালে মারা যাচ্ছে। বিষ খেলে মানুষ তো মরবেই। বেঁচে থাকার তাগিদেই প্রতিদিনই আমরা খাবার খাই। কিন্তু এই খাবারই যে আবার মানুষকে মৃত্যুর দিকে ধাবিত করছে, সে খেয়াল কজনে রাখেন। আমরা আসলে কী খাচ্ছি! প্রতিদিন খাবারের নামে বিষ খেতে হচ্ছে। বোধ করি বেঁচে থাকার জন্য; বিষমুক্ত খাবারের জন্য আমাদের আরেকটি যুদ্ধের প্রয়োজন। চারদিকে ফরমালিনের জয়জয়কার। মাছ, আম, জাম, কাঁঠাল, তরকারিতে কোথায় নেই এই জীবন হন্তারক ফরমালিন। তেলে ভেজাল, চালে এমনকি নুনেও ভেজাল। কেউ কেউ তো বলেনই বিষেও নাকি ভেজাল। তাই যা হওয়ার নয়, তাই হচ্ছে। কিডনি নষ্ট হচ্ছে, হচ্ছে হাইপ্রেসার, ক্যানসার আর হার্টস্ট্রোকে অহরহ মরছে মানুষ। আমাদের অতি আদুরে সন্তানরা অকালে ঝরে যাচ্ছে এসব অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়ে। প্রতিটি খাবারে মেশানো হচ্ছে বিষ। আর সেই বিষ খেয়ে আমরা আর বেঁচে নেই। জীবিত থেকেও লাশ হয়ে গেছি। এ যেন জিন্দা লাশ। ভেজালের এ অবস্থা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। ভেজালের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী আমজনতা, প্রশাসন, সংশ্লিষ্ট বিভাগের সবাইকে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করতে হবে। জনস্বাস্থ্য নিয়ে অবহেলা প্রদর্শনের কোনোই সুযোগ নেই। আর এটাই হচ্ছে সময়ের দাবি।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close