ইসমাইল মাহমুদ

  ২১ জুলাই, ২০১৯

বিশ্লেষণ

অরক্ষিত লেভেলক্রসিং রক্ষিত হোক

সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের কান্দাপাড়া গ্রামের রাজন শেখ (৩২) এবং চরঘাটিনা গুচ্ছগ্রামের সুমাইয়া খাতুন (২১)। দুই গ্রামের এই দুই নর-নারী চরম সুখের প্রত্যাশায় গত ১৫ জুলাই দুপুরে নদীর দুই ধারার মতো এক মোহনায় এসে মিলেছিলেন। হাতে হাত রেখে সেদিনই তারা দুই দেহ এক আত্মা হওয়ার বাসনায় এবং জীবন-মরণের সাথি হওয়ার প্রত্যয় নিয়ে কবুল করে নিয়েছিলেন উভয়ে-উভয়কে। কিন্তু বিয়ের পিঁড়িতে বসার মাত্র চার ঘণ্টা পেরোনোর আগেই তাদের ভবিষ্যতের সব আশা আর রঙিন স্বপ্ন পরিণত হয়েছে নির্মম সমাধিতে। যুগল জীবন শুরু করার আগেই নিভে গেছে উভয়েরই জীবনপ্রদীপ। সুমাইয়া খাতুনকে জীবন-মরণের সাথি করে রাজন শেখ যখন আত্মীয়-স্বজনসমেত বাড়ি ফিরছিলেন, তখন উল্লাপাড়া উপজেলার সলপ রেলস্টেশনের অর্ধ কিলোমিটার উত্তরে অরক্ষিত একটি লেভেলক্রসিং পার হওয়ার সময় তাদের বহনকারী মাইক্রোবাসের ওপর এসে হামলে পড়ে রাজশাহী থেকে ঢাকাগামী ‘পদ্মা’ এক্সপ্রেস নামের একটি যাত্রীবাহী ট্রেন। বর-কনেসহ বরের আত্মীয়-স্বজনদের বহনকারী মাইক্রোবাসটিকে পদ্মা ট্রেনটি টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায় লেভেলক্রসিং থেকে অর্ধ কিলোমিটার দূরে। এতে বর রাজন, কনে সুমাইয়াসহ ওই মাইক্রোবাসটির এগারো আরোহীর সবাই মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। মাইক্রোবাস আরোহী কয়েকজনের দেহ একেবারে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। তাদের চেনার কোনো উপায় নেই। এ ঘটনার পর বিয়ের আনন্দে মাতোয়ারা দুই পরিবারে নেমে আসে বিষাদের কালো ছায়া।

দুই : বাংলাদেশ রেলওয়ে এখন একটি অব্যবস্থাপনায় পরিপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। রেলওয়ের চরম অব্যবস্থাপনা এবং অনিয়মের একটি ক্ষেত্র হলো সারা দেশের অরক্ষিত লেভেলক্রসিংগুলো। দেশের প্রায় প্রতিটি লেভেলক্রসিংয়ে গড়পড়তা প্রতি মাসেই ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে। এতে প্রতিনিয়তই বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। লেভেলক্রসিং নামক মরণফাঁদে অকালে ঝরে যাচ্ছে তাজা প্রাণগুলো। অবৈধ যে লেভেলক্রসিংগুলো রয়েছে তা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের। উপরন্তু বৈধ লেভেলক্রসিংগুলোর অর্ধেকের মতো গেটম্যান নেই। ফলে অরক্ষিত ক্রসিংয়ে প্রায়ই দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটছে। বৈধ লেভেলক্রসিংগুলো সুরক্ষিত করার কোনো তাগিদ নেই যেন কারো। প্রতিবার এসব লেভেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা ঘটার পর রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করে। নির্দিষ্ট মেয়াদে তদন্ত কমিটিকে তদন্ত রিপোর্ট দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। ব্যাস, এ পর্যন্তই। এক সপ্তাহের মধ্যে সব পুনরায় স্বাভাবিক হয়ে যায়।

তিন : সারা দেশে ৪ হাজার ৪৪৩ কিলোমিটার (২০০৩-২০০৪) রেলপথ রয়েছে। পূর্বাঞ্চলীয় ও পশ্চিমাঞ্চল জোনে মোট রেলস্টেশন রয়েছে ৪৫৮টি রেলস্টেশন ও জংশন। রেলওয়ের মোট ৩৪৭টি ট্রেনে (আন্তনগর : ৯০টি, মেইল এক্সপ্রেস ডেমো : ১২০টি এবং লোকাল : ১৩৫টি) প্রতি বছর যাত্রী পরিবহন করে প্রায় ৪২ লাখ জন; আর মালামাল বা পণ্য পরিবহন করে প্রায় ৩২ লাখ ৬ হাজার টন। এতে বছরে গড়পড়তা রেলেও আয় হয় ৪৪৫ কোটি ৬২ লাখ ৪০ হাজার টাকা। রেলওয়ের ওই দুই জোনে কর্তৃপক্ষের হিসাব মতে, বৈধ লেভেলক্রসিং রয়েছে ১ হাজার ৬১০টি। আর অবৈধ লেভেলক্রসিংয়ের সংখ্যা ১ হাজার ৩০০টি। এই অবৈধ ক্রসিংগুলো পুরোপুরিই অরক্ষিত এবং মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। বৈধ লেভেলক্রসিং যেগুলো রয়েছে, সেগুলো দিয়ে পারাপার, রেললাইনের ওপর দিয়ে চলাচলসহ বিভিন্ন কারণে প্রতি বছর গড়ে প্রায় আড়াই হাজার মানুষ ট্রেনে কাটা পড়ে প্রাণ হারাচ্ছেন। যেসব বৈধ লেভেলক্রসিং রয়েছে, সেগুলোতে অনেক সময় গেটম্যান থাকেন না। ফলে বৈধ লেভেলক্রসিংয়েও দুর্ঘটনা ঘটছে। এ অবস্থায় রেল কর্তৃপক্ষের যখন করণীয় হলো, দেশে রেলপথে অধিক পরিমাণ লেভেলক্রসিং স্থাপন, লেভেলক্রসিগুলো রক্ষণাবেক্ষণ, অবৈধ লেভেলক্রসিং বন্ধ করে লেভেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি কমিয়ে আনা। কিন্তু রেল কর্তৃপক্ষ যেন কুম্বকর্ণের ঘুমে! অকালে এসব প্রাণহানির দায় কার?

চার : মৃত্যুফাঁদে পরিণত হওয়া অরক্ষিত লেভেলক্রসিংগুলোগুলো দ্রুততম সময়ের মধ্যে রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। অবৈধ লেভেলক্রসিং বন্ধের ব্যাপারে রেল কর্তৃপক্ষের দাবি করছেন স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের হস্তক্ষেপের জন্য একের পর এক তৈরি হচ্ছে অবৈধ লেভেলক্রসিং। তারা তাদের সীমাবদ্ধতার কথা জানান দিচ্ছেন। অবৈধ ও অরক্ষিত লেভেলক্রসিংয়ের ব্যাপারে আমাদের দেশের আইন কী বলছে, তা আমরা জানি না। তবে এইটুকু জানি মানুষের স্বার্থেই তৈরি হয় দেশের আইন। দেশের মানুষের সময়ের দাবি হচ্ছে লেভেলক্রসিংকে ঝুঁকিমুক্ত করে জান-মালের সুরক্ষা করতে হবে। তাই রেল দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করতে সুরক্ষিত করতে হবে লেভেলক্রসিংগুলোকে। দেশে যেসব বৈধ লেভেলক্রসিং আছে সেগুলোতে গেটম্যান থাকা সুনিশ্চিত করতে হবে। যদি কোনো বৈধ লেভেলক্রসিংয়ে গেটম্যান না থাকে, তবে সেসব লেভেলক্রসিংয়ে দ্রুত নিয়োগ প্রদান করে গেটম্যান নিযুক্ত করতে হবে। দেশের ১ হাজার ৩০০টি অবৈধ লেভেলক্রসিং বন্ধের ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে যদি কোনো কারণে সেগুলো বন্ধ করা সম্ভব না হয়, তবে গেট নির্মাণ করে গেটম্যান নিয়োগের মাধ্যমে সেগুলো সুরক্ষিত করা বা বৈধ করার ব্যবস্থা অচিরেই করতে হবে। নতুবা লেভেলক্রসিংয়ে মৃত্যুর মিছিল রোধ করা কারো পক্ষেই সম্ভব হবে না।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close