নিতাই চন্দ্র রায়

  ২১ জুলাই, ২০১৯

জলবায়ু

পরিবর্তনের অভিযোজনে বাংলাদেশ সেরা শিক্ষক

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বে যে কয়টি দেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। খরা, বন্যা ও অতিবৃষ্টির কারণে শস্যহানি এবং লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে দক্ষিণাঞ্চলে মাটির উর্বরতা হ্রাস ও সুপেয় পানির তীব্র সংকট সৃষ্টি হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে। ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও নদীভাঙনের ফলে হাজার হাজার মানুষকে তাদের পূর্বপুরুষের ভিটামাটি হারিয়ে শহরের বস্তিতে আশ্রয় নিতে হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পরিবেশ বিপর্যয়ের ঝুঁকিতে হয়েছে দেশের ১ কোটি ৯৪ লাখ শিশু। শিশুরা যুক্ত হচ্ছে বিভিন্ন বিপজ্জনক কাজ। এছাড়া নদীভাঙন ও বন্যার ফলে বাস্তুচ্যুত হচ্ছে এদের অনেকেই। ২০৫০ সালের মধ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে এ বাস্তুচ্যুত শিশুদের সংখ্যা হবে দ্বিগুণ। জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের এক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া যায়।

শুধু বাংলাদেশেই নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে তীব্র গরমে পুড়ছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ। জার্মানি, পোল্যান্ড, ফ্রান্স ও চেক প্রজাতন্ত্রের মতো দেশগুলোতে গত জুন মাসে তাপমাত্রা আগের সব রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। প্রচন্ড গরমে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে উঠেছে। আগামী দিনগুলোতে তাপমাত্রা আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। আবহাওয়া দফতরের সূত্র থেকে জানা যায়, উত্তর আফ্রিকা থেকে তীব্র গরম বাতাস ইউরোপের দিকে আসছে। সে কারণে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হয়ে উঠছে এবং ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে দাবদাহ দেখা দিয়েছে। এ তীব্র গরমকে জীবনের জন্য হুমকি বলে সতর্ক করে দিয়েছে ফ্রান্সের কর্মকর্তারা। এর আগে ২০০৩ সালে ভয়াবহ দাবদাহে প্রায় ১৫ হাজার মানুষের মৃত্যু হয় ফ্রান্সে। ইউরোপের প্রায় সব দেশেই কমলা সতর্কসংকেত জারি করা হয়েছে। লাল সতর্কতার পর এটাই সর্বোচ্চ সতর্কতা। একই সঙ্গে কীভাবে এই তীব্র গরমে ও ঠান্ডা থাকা যায়, সে বিষয়েও পরামর্শ দিচ্ছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। ফ্রান্সের বিভিন্ন স্থানে অস্বাভাবিক গরমের কারণে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং অনেক স্কুল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশ তার নিজের উদ্ভাবন, মেধা ও কলাকৌশল প্রয়োগ করে বেশ সফলতা অর্জন করেছে। নিজস্ব উদ্যোগে গঠন করেছে ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড ও ক্লাইমেট রেসিরেন্স ফান্ড। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় যুগোপযোগী এবং ১০০ বছর মেয়াদি বদ্বীপ পরিকল্পনার মতো পদক্ষেপ গ্রহণ করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশ কৃষি, স্বাস্থ্য ও অবকাঠামো খাতে গ্রহণ করেছে বিভিন্ন প্রকল্প। খরা, বন্যা ও লবণাক্ততা সহিষ্ণু বিভিন্ন ফসলের জাত উদ্ভাবনসহ কৃষি গষেণা প্রতিষ্ঠানগুলো উদ্ভাবন করে চলেছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় নানা ধরনের টেকসই প্রযুক্তি। এসব কারণে বাংলাদেশ আজ জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলা করে খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণতা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। শুধু খাদ্যশস্য কেন মাছ, মাংস, দুধ উৎপাদনেও বাংলাদেশে সূচিত হয়েছে এক নীরব বিপ্লব। বিপ্লব সংগঠিত হয়েছে সবজি ও ফল উৎপাদনেও। গড় আয়ু ,মাথাপিছু বার্ষিক আয়, শিক্ষার হার বৃদ্ধি এবং জিডিপি প্রবৃদ্ধিসহ দারিদ্র্যবিমোচনে অভাবনীয় অগ্রগতির পেছনেওÑ এসব অভিযোজনমূলক কর্মকান্ডের অবদানকে অস্বীকার করা যাবে না।

জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব ও গ্লোবাল কমিশন অন অ্যাডাপ্টেশনের চেয়ারম্যান বান কি মুনের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিযোজনে বাংলাদেশ সেরা শিক্ষক। জননেত্রী শেখ হাসিনা প্রশংসা করে তিনি বলেন, বিশ্ব নেতাদের মধ্যে শেখ হাসিনাই অন্যতম, যিনি জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যাটি নিয়ে সামনে থেকেই নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বান কি মুন

এবং মার্শাল দ্বীপপুঞ্জের প্রেসিডেন্ট ড. হিলদা সি

হেইন উভয়েই অভিযোজনের প্রতিকূল প্রভাবকে মানিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ ও দুর্যোগ মোকাবিলায় গৃহীত কৌশলের জন্য বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করেন। ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে বাংলাদেশে প্রায় ১০ লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ১ লাখ ৫০ হাজার মানুষ মারা যায়। কিন্তু সরকারে পূর্বসতর্কতা এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপের কারণে সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড় ফণীতে মাত্র ১২ জন লোক মারা যায় এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও হয় খুব কম।

গ্লোবাল কমিশন অব অ্যাডাপটেশনের সহযোগিতায় বাংলাদেশ জলবায়ুর ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় সঠিক অভিযোজন কৌশলের পাশাপাশি সাশ্রয়ী পন্থা ও ঝুঁকি নিরসন ব্যবস্থার সুবিধা পেতে চায়। বাংলাদেশ অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে অপেক্ষা করছে আগামী সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ মহাসচিবের আহ্বানে অনুষ্ঠিতব্য ক্লাইমেট চেঞ্জ সামিটের প্রতিবেদনের সুপারিশগুলোর জন্য। ওই সম্মেলনে এলডিসিভুক্ত দেশগুলো ও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ শেখ হাসিনাকে বক্তব্য দেওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। অভিযোজন প্রক্রিয়ায় অগ্রগামী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ একটি আঞ্চলিক অভিযোজন কেন্দ্র স্থাপনের দাবি রাখে। এ দাবির প্রতি জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিবও সমর্থন জানান। এরই মধ্যে চীনে এ ধরনের একটি কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে যে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব অনুমিত সময়ের আগেই পৃথিবীর প্রত্যেকের ওপর প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। সেজন্য এর প্রভাব মোকাবিলায় বিশ্বকে বিনিয়োগে আরো বেশি অগ্রাধিকার দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুধু নিজের দেশ নিয়েই ভাবেন না। তিনি ভাবেন পৃথিবীর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপ রাজ্যের কথাও। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে অনেক ছোট ছোট দ্বীপপুঞ্জ পৃথিবীর মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে। তখন সেখানকার মানুষেরা কোথায় যাবে?

জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বড় হুমকি। পৃথিবীর উষ্ণতা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছেÑ এটা বড় উদ্বেগের কারণ। পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা এরই মধ্যে প্রাক শিল্পস্তরের চেয়ে প্রায় এক ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড ওপরে পৌঁছেছে। ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল মানব ইতিহাসে সবচেয়ে উত্তপ্ত বছর ছিল। জার্মান ওয়াচের ক্লাইমেট চেঞ্জ ভার্নাবিলিটি ইনডেক্স-২০১৮ অনুসারে বাংলাদেশ বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে ছিল ষষ্ঠ। দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এডিবির জলবায়ু এবং অর্থনীতিবিষয়ক প্রতিবেদনের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বার্ষিক জিডিপি ২ শতাংশ কমে যাবে। যদি বর্তমান হারে তাপমাত্রা বাড়তে থাকে তাহলে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের ১৯টি উপকূলীয় জেলা স্থায়ীভাবে ডুবে যাবে। নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে সমুদ্রতল বৃদ্ধি এবং লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের বিস্তৃত এলাকাল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণ বলছে, বাংলাদেশ এরই মধ্যে ৬০ লাখ জলবায়ু অভিবাসী রয়েছে। ২০৫০ সালের মধ্যে এই সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণেরও বেশি হতে পারে, যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে। বর্তমান সরকারে অক্লান্ত পরিশ্রমে গত এক দশকে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক খাতে যে বিশাল উন্নতি হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের কারণে আজ তা হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলো অভিযোজনের মাধ্যমে নিরসনের জন্য বছরে প্রায় ১০০ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় করছে।

বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় নিচু এলাকাগুলো। ওইসব এলাকায় সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে লোনা পানি বেড়ে যাচ্ছে, মিঠা পানি কমে যাচ্ছে। দেখা দিচ্ছে সেচ ও সুপেয় পানি তীব্র সংকট। এ সংকট উত্তরণে উপকূলীয় এলাকায় চাষ হচ্ছে নতুন উদ্ভাবিত লবণাক্ততা ও খরাসহিষ্ণু জাতের ধান, পাট, গম ও সূর্যমুখীর মতো ফসল। কেউ কেউ ধানচাষ ছেড়ে ঝুঁকছেন চিংড়ি চাষে। লবণাক্ত পানি কৃষি কাজে অনুপযোগী হওয়ায় উপকূল এলাকায় সীমিত আকারে প্রাপ্ত ভুপৃষ্ঠস্থ ও বৃষ্টির সাদু পানি সংরক্ষণ করে আধুনিক কলাকৌশল ড্রিপ ও শাওয়ার সেচ অনুসরণ করে শস্য উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে। এরই মধ্যে বিএডিসি, বিএমডিএ ও ডিএইতে কর্মরত কৃষি প্রকৌশলীরা বেশকিছু পানিসাশ্রয়ী আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন, যার সুফল পেতে শুরু করেছে উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষক। এসডিজি-২, এসডিজি-৬ এর লক্ষ্যমাত্রা হলো- ২০৩০ সালের মধ্যে গ্রহণযোগ্য কৃষি ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি ও টেকসই করা এবং পরিমিত পানির ব্যবহার নিশ্চিত করা। একইভাবে বিশ্বের প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষের সুপেয় পানির যে সমস্যা রয়েছে, তা একটি মাত্রা পর্যন্ত নামিয়ে আনা। উপকূলীয় এলাকায় এ ধরনের গবেষণার মাধ্যমে

ওইসব এলাকায় বসবাসকারী মানুষের ফসল উৎপাদন থেকে শুরু করে খাবার পানি ও গৃহস্থালিসহ অন্যান্য কাজে

সুপেয় পানির যে সংকট রয়েছে, তা অনেকাংশেই কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। দূর হবে নারীদের বহুদূর থেকে কষ্ট করে খাবার পানি সংগ্রহের সমস্যা। কৃষি উৎপাদন ও মৎস্য চাষেও সৃষ্টি হবে নতুন অধ্যায়ের সূচনা।

লেখক : কৃষিবিদ ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close