সাধন সরকার

  ২০ জুলাই, ২০১৯

আকাঙ্ক্ষা

দাও ফিরে সে অরণ্য...

‘প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সংগ্রাম তখন থেকে শুরু হয়েছে, যখন মানুষ আগুন আবিষ্কার করেছে। মানুষ এতটা শক্তি অর্জন করেছে যে, ইচ্ছর করলে মুহূর্তেই পৃথিবীটা ধ্বংস করে দিতে পারে; যদিও তারা আরেকটা পৃথিবী তৈরি করতে সক্ষম নয়।’ এ কথাগুলো প্রকৃতিপ্রেমিক ও বৃক্ষসখা দ্বিজেন শর্মার। আমাদের পৃথিবী একটাই। পৃথিবী নামক এই ছোট গ্রহের মধ্যেই প্রায় সাড়ে ৭০০ কোটি মানুষের স্বপ্ন, সম্ভাবনা ও বেঁচে থাকা। প্রকৃতি ও পরিবেশ ভালো থাকার ওপরই নির্ভর করছে আমাদের টিকে থাকা। আমাদের নিজেদের স্বার্থে প্রকৃতিকে ভালোবাসতে হবে। প্রকৃতিকে সংরক্ষণ করতে হবে। আমাদের দেশের প্রকৃতি বিচিত্রময় এবং অনেক সম্পদে ভরপুর। নদ-নদী, খাল-বিল, পাহাড়-বন, হাওর-বাঁওড়, জলাশয়, মাটি আর বায়ু মিলিয়ে এক অপূর্ব প্রকৃতির সমারোহ। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ হিসেবে পরিচিত। একসময় এ দেশে ৭০০টিরও বেশি নদ-নদী ছিল। সত্যি বলতে, একবিংশ শতাব্দীতে এসে এ দেশে ২৩০টির বেশি নদ-নদী খুঁজে পাওয়া যায় না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নদ-নদী বিলীন হয়ে যাচ্ছে! এর দায় আমরা কোনোভাবে এড়াতে পারি না! আমার নিজের গ্রামে কপোতাক্ষ নদের ছোট একটি শাখা ছিল। পলি পড়ে ভরাট হয়ে আর দখলের কবলে সেটি হারিয়ে গেছে। আবার দক্ষিণাঞ্চলের বুক চিরে বয়ে যাওয়া মূল কপোতাক্ষ নদের অনেক জায়গা দখল করে ঘরবাড়ি তোলা হয়েছে। কোনো কোনো অংশে পুকুর বানিয়ে মাছের চাষ করা হচ্ছে।

যশোর, খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত মূল কপোতাক্ষ নদটির বেশির ভাগ বলতে গেলে এখন দখলদারদের কবলে। নদটি নাব্য সংকটে ভুগছে দীর্ঘদিন ধরে। সত্যি বলতে, দেশের বেশির ভাগ নদ- নদী দখল, দূষণ আর নাব্য সংকটে ভুগছে। নদীর মতো প্রকৃতির সব উপাদানই মানুষের জীবনধারণের সঙ্গে জড়িত। প্রচন্ড রোদের মধ্যে আমরা একটু শীতল পরশ পাওয়ার জন্য গাছের ছায়ায় আশ্রয় নিই। আবার বৃক্ষ না হলে পানি যেমন সুপেয় হবে না; তেমনি বায়ু নির্মলও হবে না। ফলে বায়ুতে বৃদ্ধি পাবে কার্বন ডাই-অক্সাইড। ঘূর্ণিঝড়, দুর্যোগে গাছ আমাদের আগলে রাখে। বৃক্ষ আমাদের শিক্ষা দেয় নমনীয় হতে, ভালোবাসতে, নিয়ম মানতে, বিশ^াসে দৃঢ় থাকতে। ইট-পাথর আর চার দেয়ালের মাঝে বন্দি থাকলেও একটু সময় পেলে আমরা ছুটে যাই প্রকৃতির কাছে, বনের কাছে, পাহাড়ের কাছে, নদীর কাছে। বুকভরে স্বস্তির নিঃশ^াস নিই। প্রকৃতি আমাদের মায়ের মতো। যে মা আমাদের আলো দিয়ে, বায়ু দিয়ে, আহার দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে।

দুঃখের বিষয়, প্রকৃতি বিনাশের কারণে জীববৈচিত্র্যের ওপর মারাত্মক হুমকি তৈরি হচ্ছে। অনেক উদ্ভিদ ও বন্যপ্রাণী বিলুপ্ত হয়েছে। আবার অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কাটা ও বন উজাড় করা হচ্ছে। প্রকৃতির কান্না আমরা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। অথচ প্রকৃতি রক্ষায় আমরা এগিয়ে আসছি না। প্রকৃতিও প্রতিশোধ নিতে জানে! বিভিন্ন সময় পাহাড়ধস, ভূমিধস ও অপরিকল্পিতভাবে পাথর উত্তোলনে শ্রমিক নিহত হওয়ার খবর আমাদের প্রায়ই হতবাক হতে হয়। এ ধরনের প্রকৃতি বিনাশী অসচেতন কাজকর্ম রোধ করতে হবে। পরিবেশের দূষণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বায়ুতে ক্ষতিকর গ্যাসের পরিমাণ বাড়ছে। আমরা শুধু বছরের একটা দিনে অর্থাৎ ‘পরিবেশ দিবসে’ (৫ জুন) পরিবেশ-প্রকৃতি নিয়ে ভাবনাচিন্তা করি। কিন্তু প্রকৃতি ও পরিবেশ আমাদের জীবনেরই অংশ। বছরের প্রতিটি দিন আমাদের প্রকৃতি ও পরিবেশের কথা ভাবা উচিত। প্রতি বছর আমাদের কৃষিজমি কমছে। বিদেশি উদ্ভিদ দেশি উদ্ভিদের জায়গা দখল করে নিচ্ছে। দেশি গাছের কদর করতে আমরা ভুলে যাচ্ছি। নগরায়ণ বাড়ছে। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের ব্যবধান তৈরি হচ্ছে। অপরিকল্পিত উন্নয়নের ফলে প্রকৃতি বিনাশ করা হচ্ছে। কার্বন নিঃসরণ রোধে তথা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষা করা সবচেয়ে বেশি জরুরি।

প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে আমরা টিকে থাকতে পারব না। প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থান করে ভূপৃষ্ঠের সামগ্রিক বাস্তুসংস্থান রক্ষায় সবাইকে সচেতন হতে হবে। বিশ^কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘সভ্যতার প্রতি’ কবিতায় বলেছেন, ‘দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর’। তাই যার যার অবস্থান থেকে প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। প্রকৃতিকে ভালোবাসতে হবে। কেননা লোভ- লালসা আর অর্থের লোভে বৃক্ষ, পাহাড়, কৃষিজমি, বন, কাটতে কাটতে আর মাটি, পানির দূষণ ত্বরান্বিত হতে হতে এমন একসময় আসবে যখন থাকবে শুধু টাকা; যে টাকা দিয়ে তখন আর নষ্ট হয়ে যাওয়া প্রকৃতি ও পরিবেশ ফেরত পাওয়া যাবে না।

লেখক : পরিবেশকর্মী ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close