রায়হান আহমেদ তপাদার

  ২০ জুলাই, ২০১৯

আন্তর্জাতিক

হংকংয়ে আন্দোলনের নেপথ্য

গণতন্ত্রের দাবিতে প্রতিবাদ-বিক্ষোভে মুখর হয়ে উঠেছে হংকং। চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের বিষয়ে তাই সতর্ক করে দিয়েছে সরকার। হংকংয়ের প্রশাসন বর্তমান এই সংকট সামলে নেবে প্রকাশ্যে অন্তত এ রকমই অবস্থান নিচ্ছে বেইজিং। হংকং প্রশাসন ধৈর্যের পরীক্ষায় বিক্ষোভকারীদের থেকে এগিয়ে থাকতে চায়। অর্থাৎ দমননীতির বদলে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে তাদের প্রতিবাদ চালিয়ে যেতে দেওয়া হবেÑ এমনটাই ইঙ্গিত করেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা। সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে তিনি এ কথা বলেছেন। শুধু হিংসা বা অন্য ধরনের অরাজকতা সৃষ্টি হলেই পুলিশ হস্তক্ষেপ করবে। গত সপ্তাহান্তের পর বিক্ষোভকারীদের সংখ্যা কমে যাওয়ায় উৎসাহ পাচ্ছে স্থানীয় প্রশাসনের অনেকেই নিশ্চয়ই জানেন, হংকংয়ে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চলে আসছে। এই আন্দোলনটি করছে হংকংয়ের গণতন্ত্রকামী জনগণ, যারা চায় তাদের নিজেদের নেতা নিজেরাই ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত করতে। ২০১৪ সালে বেইজিং থেকে বলা হয়, তারা হংকংয়ের প্রধান নির্বাহী বেছে নেওয়ার জন্য সরাসরি নির্বাচনের অনুমতি দেবে, কিন্তু তা কেবলই অনুমোদিত প্রার্থীদের তালিকার মধ্য থেকে।

এই ঘোষণার পর হংকংয়ের গণতন্ত্রকামীরা বিক্ষোভে রাস্তায় নেমে আসে, কারণ তারা এমন ব্যবস্থা চায়নি, তারা চেয়েছিল পূর্ণাঙ্গ গণতান্ত্রিক নির্বাচন ব্যবস্থা। বিক্ষোভের ফলে সেসময় শহরের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলোর অর্থনৈতিক কার্যক্রম বেশ কয়েক সপ্তাহ স্থগিত ছিল। তাছাড়া হংকংয়ে এমন অনেকেও আছেন যারা হংকংয়ের অভ্যন্তরীণ বিষয়াবলিতে চীন সরকারের হস্তক্ষেপের পক্ষে। এ কারণে হংকং এখন প্রধান দুই ভাগে বিভক্ত, বেইজিংয়ের সমর্থক একটি ক্যাম্প, যারা চায় হংকংয়ের রাজনৈতিক কার্যক্রমে চীনের কম্যুনিস্ট পার্টির সংশ্লিষ্টতা আরো বাড়ুক; গণতন্ত্রকামী গোষ্ঠী, যারা চায় হংকংয়ের স্বায়ত্তশাসন আরো মজবুত হোক এবং তারা চীনের ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে স্বকীয়তা গড়ে তুলুক। নতুন এক রাজনৈতিক সংকটে উত্তাল হয়ে উঠেছে হংকং। বিক্ষোভ আজ চলছে। অপরাধী প্রত্যর্পণ আইনের বিরুদ্ধে হংকংয়ের পথে নামে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ। নতুন এ আইন অনুযায়ী চীন চাইলে সন্দেহভাজন অপরাধীদের নিজ ভূখন্ডে নিয়ে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারবে। আয়োজকদের দাবি, ২০০৩ সালে সরকারের জোরদার জাতীয় নিরাপত্তা আইন চ্যালেঞ্জ করে পথে নামা অজস্র মানুষের সংখ্যাকে পেছনে ফেলে দিয়েছে গতকাল রাতের এই বিক্ষোভ। সেবার আন্দোলনের মুখে আইনটি বাক্সবন্দি করতে বাধ্য হয় সরকার। পদত্যাগ করেন এক প্রধান সরকারি কর্মকর্তাও। সাম্প্রতিক এই আন্দোলনের কারণে ইতোমধ্যে হংকংয়ের নেতা ক্যারি ল্যাম এবং বেইজিংয়ে তার সমর্থকরা চাপের মুখে পড়েছেন। ডেমোক্রেটিক পার্টির অভিজ্ঞ আইনপ্রণেতা জেমস শহরের সংসদের সামনে উপস্থিত জনতার উদ্দেশে বলেন, ‘এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তাকে (ক্যারি ল্যাম) পদত্যাগ করতে হবে। গোটা হংকং তার বিরুদ্ধে অবস্থান করছে।

এ ছাড়া আন্দোলনকারীরা রাস্তায় বিভিন্ন দাবিসংবলিত প্ল্যাকার্ড নিয়ে বিক্ষোভ করছে। হুইলচেয়ারে করেও অনেকে বিক্ষোভে যোগ দিয়েছেন, যাদের সহায়তা করছেন অন্য আন্দোলনকারীরা। সব মিলিয়ে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে আন্দোলনে নামলেও অনেকেই ঠিক পুরোপুরি আশাবাদী নন। কারণ হংকংয়ের আইনসভায় বেইজিংপন্থিরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। মিছিলের ব্যাপারে এখনো কোনো মন্তব্য করেননি ল্যাম। ব্যবসা, কূটনীতি ও আইনগত ক্ষেত্রে কয়েক সপ্তাহ ধরে চলা ক্রমবর্ধমান অরাজকতার কারণে এই বিক্ষোভ দেখা দেয়। এর ফলে হংকংয়ের বৈধ স্বায়ত্তশাসন হুমকির মুখে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বারবার সতর্ক করার পরও তাদের শান্ত করতে ব্যর্থ হয়ে মরিচের গুঁড়া ছিটিয়ে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে পুলিশ। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের কর্মকর্তারা আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে হুশিয়ার বার্তা জানিয়েছেন। এর কারণে হংকংয়ের আইন-সংক্রান্ত নীতিমালা পরিবর্তিত হতে পারে বলে ধারণা করছেন তারা। আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ী মহল এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলোও একই উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। যে আইন নিয়ে এ আন্দোলন, সেখানে বলা হয়েছে, বেইজিং, ম্যাকাও ও তাইওয়ান থেকে পালিয়ে আসা কোনো অপরাধীকে ফেরত চাইলে তাকে ফেরত দিতে হবে; বিশেষত যেসব অপরাধীর বিরুদ্ধে হত্যা ও ধর্ষণের মতো অভিযোগ রয়েছে। তবে হংকংয়ের কর্তৃপক্ষ বলছে, এ আইন নিয়ে এত দুর্ভাবনার কিছু নেই। কারণ এ অপরাধী প্রত্যর্পণ অনুরোধে সাড়া দেওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটি হংকংয়ের বিচার বিভাগই নেবে। এ আইনের ফলে চীনা বিচারব্যবস্থার অধীনে অন্যায্যভাবে আটক ও বিচারের মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেড়ে যাবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

হংকংয়ের বেইজিংপন্থি শাসকদের প্রস্তাবিত একটি বিলে সন্দেহভাজন অপরাধীকে চীন ও তাইওয়ানে ফেরত পাঠানোর পথ সুগম করা হয়েছে। তবে বেইজিংয়ের দুর্বল আইন এবং মানবাধিকার রেকর্ডের কারণে সেখানে কাউকে ফেরত পাঠানো নিরাপদ মনে করছেন না হংকংয়ের সাধারণ মানুষ। তারা মনে করছেন, বিলটি পাস হলে তা হংকংয়ের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে চীনের হস্তক্ষেপের সুযোগ বাড়িয়ে দেবে। সেখান থেকেই বিক্ষোভে নেমেছে তারা। চলমান বিক্ষোভে যে সহিংসতা হয়েছে, ১৯৯৭ সালে যুক্তরাজ্য চীনের কাছে হংকংকে পুনরায় ফিরিয়ে দেওয়ার পর থেকে দেশটি এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি। দেশটির হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, বুধবার রাত ১০টা পর্যন্ত অন্তত ৭২ জন আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। তবে বিক্ষোভ চরম আকার ধারণ করলেও সরকার পিছু হটেনি। হংকংয়ের আইন পরিষদ বিতর্কিত ওই অপরাধী প্রত্যর্পণ সংক্রান্ত বিলটি নিয়ে দ্বিতীয় বৈঠক পিছিয়ে দিয়েছে। সেই বৈঠক কবে অনুষ্ঠিত হবে তা নিয়েও স্পষ্ট কিছু জানা যায়নি। উল্লেখ্য, ১৫০ বছর ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনে থাকার পর লিজ চুক্তির মেয়াদ শেষে ১৯৯৭ সালের ১ জুলাই অঞ্চলটি চীনের কাছে ফেরত দেওয়া হয়েছিল। হংকংয়ের জনসংখ্যা প্রায় ৭৪ লাখ হলেও ১২০০ জনের একটি বিশেষ কমিটি নেতা বাছাইয়ে ভোট দেওয়ার সুযোগ পান। বিংশ শতকের শুরুর দিকে বেশ কয়েকবার ব্রিটেন সরকার চিন্তাভাবনা করেছে চীনের কাছে হংকংয়ের ইজারা ফিরিয়ে দেওয়ার। কারণ ইংল্যান্ডের জন্য দ্বীপটি আর গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। কিন্তু ১৯৪১ সালে জাপান দখল করে নেয় হংকং। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে চীনের উপকারের কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তিনি যেন চীনের কাছে হংকং দ্বীপটি ফিরিয়ে দেন। কিন্তু চার্চিল তাতে সম্মত হননি। বিশ্বযুদ্ধ শেষে হংকং আবার ব্রিটেনের অধীনেই চলে যায়, যদিও আমেরিকানরা ব্রিটেনের ওপর হংকং প্রশ্নে চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখে। ১৯৪৯ সালের মধ্যে মাও সেতুংয়ের নেতৃত্বাধীন পিপলস লিবারেশন আর্মি চীন দখন করে নেয়। তখন পশ্চিমা বিশ্ব ভয় পেতে শুরু করে যে, এবার হয়তো কম্যুনিস্টরা হঠাৎ করেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা হংকংয়ের দিকে হাত বাড়াবে এসপিওনাজের উদ্দেশ্যে, বিশেষত কোরিয়াযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে। বাস্তবিকই ১৯৬৭ সালে ‘গ্যাং অব ফোর’ হংকংয়ে সৈন্য পাঠানোর কথা ভেবেছিল, পরে অবশ্য সে চিন্তা তারা মুলতবি রাখে। ১৯৯৭ সালের ১ জুলাই ইজারার মেয়াদ শেষ হয় এবং গ্রেট ব্রিটেন ব্রিটিশ হংকং ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসমূহের নিয়ন্ত্রণ হস্তান্তর করে পিপলস রিপাবলিক অব চায়নার কাছে।

এখন পর্যন্ত হংকংয়ের এই রূপান্তর মোটামুটি ঝামেলা ছাড়াই হয়েছে, যদিও হংকংয়ের ওপর বেইজিংয়ের বৃহত্তর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টার ফলে কয়েকবার ছোটোখাট দ্বন্দ্ব ও বচসার সৃষ্টি হয়েছে।

হংকংয়ের মানুষ চায় গণতান্ত্রিক উপায়ে বৈশ্বিক ভোটাধিকার পদ্ধতির মাধ্যমে তাদের নেতা নির্বাচন করতে। কিন্তু চীন সরকার স্পষ্টতই অনিচ্ছুক হংকংকে পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করতে দিতে। আসলে চীনা ও হংকং প্রশাসন এক উভয় সংকটে রয়েছে। হংকং পুঁজিবাজার ও আর্থিক কেন্দ্র। সেখানে দমননীতি চালালে অর্থনীতির ওপর তার প্রভাব পড়তে বাধ্য। হংকংয়ে পর্যটনের ক্ষেত্রে এমন ধাক্কা এখনই টের পাওয়া যাচ্ছে। আবার কড়া প্রতিক্রিয়া না দেখালেও বিরোধীরা উৎসাহ পাবে। আরো গণতন্ত্রের দাবিতে প্রতিবাদ-বিক্ষোভে মুখর হয়ে উঠেছে হংকং। চীন অবশ্য কোনো রকম বিদেশি হস্তক্ষেপ বরদাশত করবে না বলে জানিয়েছে ইতোমধ্যেই। হংকংয়ের মতো সেখানেও মানুষের হাতে ছাতা ও স্মার্টফোনের উজ্জ্বল পর্দা। লন্ডনে চীনা দূতাবাসের সামনে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ দেখা গেছে। তাদের দাবি, চীনের সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনকে কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করতে হবে। হংকংয়ের সাবেক শাসক হিসেবে ব্রিটিশদের এ ক্ষেত্রে নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন। বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চল হিসেবে হংকংয়ের মানুষ এমন অনেক স্বাধীনতা ভোগ করেন, যা গণপ্রজাতন্ত্রী চীনে অভাবনীয়। কিন্তু বেইজিং এর বেশি ছাড় দিতে প্রস্তুত নয়।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close