নাজমুল হক

  ১৮ জুলাই, ২০১৯

বিশ্লেষণ

গণমাধ্যম ও কর্মীর দায়বদ্ধতা

ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র, আন্তর্জাতিক বা যেকোনো ধরনের অসংগতি তুলে ধরাই একজন সাংবাদিকের মূল দায়িত্ব, কিন্তু সাংবাদিক বা গণমাধ্যম কি সমাজের সব অসংগতি তুলে ধরতে পারছে? আমি বলব, না পারছে না। কারণ গণমাধমের (ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া) মূল দায়িত্ব বা মালিকানায় যারা আছেন তাদের অনেকেই রাজনৈতিক, সামাজিক বা অর্থনৈতিকভাবে সরকার বা বিরোধী দল, সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি অথবা বিশিষ্ট শিল্পপতিদের সঙ্গে এক ধরনের সখ্য বজায় রাখেন। তবে ব্যতিক্রমী কিছু গণমাধ্যম যারা শত বাধাবিঘœœ অতিক্রম করে জনগণের আস্থা নিয়ে দিন দিন এগিয়ে যাচ্ছে, তবে তার সংখ্যা খুবই কম। অন্যদিকে গণমাধ্যম মালিকদের চিন্তা-চেতনা অথবা বিরোধিতা গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকদের যথেষ্ট প্রভাবিত করে। অনেক সময় সাংবাদিকরা গুরুত্বপূর্ণ অসংগতি তুলে আনলেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যদি গণমাধ্যম মালিকের সখ্য ব্যক্তি হয়; তবে অনেক গণমাধ্যম তা এড়িয়ে যায়। কারণ অনেক অখ্যাত বা ছোট পরিসরের গণমাধ্যমগুলো বৃহৎ কোম্পানিগুলোর অনুকম্পা নিয়েই চলতে হয়। আবার অনেক বিখ্যাত বা বড় পরিসরের গণমাধ্যমগুলোও বৃহৎ কোম্পানিকে বিভিন্ন ধরনের সুযোগ (বিজ্ঞাপন, দরপত্র) সুবিধার জন্য তাদের সমীহ করে থাকে। তবে ব্যতিক্রমী গণমাধ্যমগুলো এই জায়গাগুলোতে ছাড় দেয় না বলেই দিন দিন তাদের প্রতি জনগণের আস্থা বাড়তে থাকে।

অনেক সময় সাংবাদিকদের ব্যক্তিগত কর্মতৎপরতা অথবা ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতার জন্য ঘটনার গভীরে বা মূল ঘটনা তুলে আনতে পারে না। এ ছাড়া অনেক সময় মাঠপর্যায়ে বক্তব্য তুলে আনতে না পেরে প্রশাসন বা দুর্বল সমর্থিত সূত্র মোতাবেক প্রতিবেদন তৈরি করে, যার কারণে অনেক নিরীহ বা সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়; যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমাদের দেশে বিভিন্ন সময় গঠিত সরকারগুলো অসংগতি তুলে ধরা গণমাধ্যমগুলোর প্রতি যথেষ্ট সৌজন্যতা প্রদর্শন করেনি। তাছাড়া যে গণমাধ্যমগুলো সাহসিকতার সঙ্গে সরকারের অসংগতিগুলো তুলে ধরে, সরকারি সংস্থাগুলোর বিভিন্ন দরপত্র বা বিজ্ঞাপন সেই গণমাধ্যমকে বয়কট করে এবং সরকারের অনুগত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও সরকারি অনুগ্রহের আশায় সেই গণমাধ্যমকে বয়কট করে।

প্রশ্ন উঠতেই পারে, সরকারের অফূগতি তুলে ধরা কি সরকারের জন্য লাভ, না ক্ষতি? সবাই বলবে, সরকারের জন্য তা শতভাগ লাভজনক। কারণ সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড বা অসংগতির মূল কেন্দ্রে বসে সরকারের একার পক্ষে সমগ্র দেশের অবস্থা উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। তাছাড়া সরকারি বিভিন্ন সংস্থা যেমন গোয়েন্দা, পুলিশ বা অন্য প্রশাসনিক সংস্থার মাধ্যমে অনেক স্পর্শকাতর সংবাদ, যদি গণমাধ্যমে না আসত তবে তা সরকারের অগোচরেই থেকে যেত। যেমন ফেনীতে সংগঠিত নুসরাত রাফির নির্মম হত?্যাকান্ডের ঘটনাটি গণমাধ?্যমে না এলে স্থানীয় নেতাকর্মী, পুলিশ, গোয়েন্দা বা অন্য কোনো প্রশাসনিক মাধ্যমে প্রকৃত সংবাদটি হয়তোবা সরকারে উচ্চ মহলে পৌঁছাত না। কারণ স্থানীয় নেতাকর্মী, পুলিশ ও প্রশাসনের অনেকেই এ ঘটনায় জড়িত ছিল। শুধু গণমাধ্যম আসার জন্য সরকার এ ব্যাপারে অবহতি হয়েছে। এতে কি সরকারে লাভ হলো, না ক্ষতি হলো? অবশ্যই লাভ হয়েছে, হয়তোবা সাময়িক সময়ের জন্য সরকার কিছুটা বিব্রত; তবে ন্যায়বিচার করলে দীর্ঘমেয়াদি সরকারের জন্য তা লাভজনক। এ ঘটনাটি যদি গণমাধ?্যমে না আসতো মাত্র ১৩ জন দুর্বৃত্তের জন্য যাদের মধ্যে সোনাগাজী আওয়ামী লীগের দু-তিনজন নেতাও আছেন। এ ঘটনায় ওই থানাসহ আশপাশের চার-পাঁচটি থানায় অন্তত দু-তিন লাখ লোকের ভেতর নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি করেছে। কিন্তু ব্যাপারটি সরকারের দৃষ্টিগোচর হওয়ার এবং এর ন্যায়বিচারের ফলে সরকারি দল দু-তিনজন দুর্বৃত্তের পরিবর্তে দু-তিন লাখ লোকের হৃদয় জয় করছে। তাছাড়া এ ঘটনা থেকে আওয়ামী লীগে ঘাপটি মেরে থাকা দুর্বৃত্তরাও কঠিন একটি বার্তা পেল অপরাধ করলে ছাড় নেই। উন্নত বিশ্বের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, তাদের গণমাধ্যম কত শক্তিশালী, আমেরিকার ইতিহাসে আজ পর্যন্ত কোনো সাংবাদিককে আইনি হেনস্তার শিকার হতে হয়নি। তাছাড়া যে দেশের গণমাধ্যম যত শক্তিশালী, সেই দেশের সাংবিধানিক অধিকার তথা নাগরিক সুবিধা ততবেশি। গণমাধ্যমের সবচেয়ে দুর্বল দেশ হিসেবে পরিচিত উত্তর কোরিয়া সভ্য দুনিয়ায় সমগ্র দেশটিই একটি কারাগার হিসেবে পরিচিত। মধ্যপ্রাচ্যের যে দেশগুলোতে আজ রক্তক্ষয়ীযুদ্ধ ও অরাজকতা চলছে তার জন্য তাদের সরকার নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমগুলো অনেকাংশে দায়ী। মধ্যপ্রাচ্যের যে দেশগুলোতে গণমাধ্যম খুবই দুর্বল এবং কোণঠাসা ছিল; সেই দেশগুলোতেই আজ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, যুদ্ধ ও অরাজকতা বিদ্যমান। গণমাধ্যমগুলো যদি মিথ্যায় প্রভাবিত না হয়ে সত্য তথ্য তুলে ধরে; তবে দেশে দেশে যুদ্ধ, হানাহানি শূন্যর কোঠায় নেমে যাবে। কিছুদিন আগে ভারত- পাকিস্তানের মধে?্য সংঘটিত সংঘর্ষে তাদের দুই দেশের গণমাধ?্যমগুলোতে যুদ্ধের পক্ষে উসকানি ছিল ব?্যাপক। আমাদের জানা আছে, ইরাক ও আফগানিস্তান নিয়ে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলো ভুল বা মিথ্যা সংবাদ প্রচারের কারণেই (ইরাকে ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র আছে, পরবর্তীতে তা ভুল প্রমাণিত হয়) সারা পৃথিবী আজ যুদ্ধের দামামায় অস্থিতিশীল। অন্যদিকে ইরান নিয়ে তাদের গণমাধ্যমে যুদ্ধবিরোধী মনোভাবের কারণে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আন্তরিক ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও যুদ্ধে জড়ানোর সুযোগ পায়নি। ইরানের বিরুদ্ধে যে ট্যাংকার হামলা ও ড্রোন ধ্বংসের অভিযোগ (যুদ্ধের অজুহাত) ট্রাম্প তুলেছিল, তা তাদের গণমাধ্যমের বিশ্লেষণে ধোপে টিকেনি। তাই যুদ্ধ থেকে পিছপা হতে বাধ্য হয়েছিলেন ট্রাম্প। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযদ্ধের আগে পশ্চিম পাকিস্তানের গণমাধ্যমগুলো বাংলাদেশের (পূর্ব পাকিস্তান) নিপীড়ন, দুঃশাসন, অধিকারবঞ্চিত ও নির্মমতার কোনো চিত্রই তাদের জনগণের কাছে তুলে ধরেনি। তাছাড়া অনেক বাস্তব সত্য ও নির্মমতা তারা রাষ্ট্রীয় চাপে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের কাছে ভুলভাবে উপস্থাপন করেছে; যার দরুন মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের ত্রিশ লাখ শহীদের এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়। অন্যদিকে যুদ্ধকালীন সময়েও আমাদের প্রতি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম নির্যাতন ও হত্যার বাস্তবতা নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানি প্ররোচনায় মধ্যপ্রাচ্যের গণমাধ্যমগুলো তেমন কোনো সক্রিয় ভূমিকা রাখেনি; যা কলঙ্কজনক ইতিহাস হয়ে থাকবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close