মোতাহার হোসেন

  ১৬ জুলাই, ২০১৯

মুক্তমত

প্রয়োজন মানবিক মূল্যবোধের জাগরণ

মানুষ যখন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করার শক্তি ও সাহস হারিয়ে ফেলে; তখন সমাজের সর্বস্তরে অনিয়মের বিস্তার ঘটে। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ৭ কোটি বাঙালি পাকজান্তার বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ছিনিয়ে এনেছিল মহান স্বাধীনতা। ঠিক অনুরূপভাবে এক রক্তাক্ত আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ১৯৫২ সালে মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার আদায় করেছিল বাঙালি। তাই বলতে হয়, আমাদের অতীত ইতিহাস গৌরবের, আত্মমর্যাদা বৃদ্ধির আর অহংকারের। যে কারণে বিশ্বে বাঙালি বীরের জাতি হিসেবে সমাদৃত। কিন্তু সাম্প্রতিক কালের কিছু কিছু বিচ্ছিন্ন অথচ হৃদয়বিদারক ঘটনা আমাদের শক্তি সাহস নিয়ে প্রশ্ন তুলতে বাধ্য। কারণ এগুলো যারা ঘটাচ্ছে তারা যেমনি দায়ী, তেমনি দায়ী আমরাও। অথচ প্রকাশ্যে একদল তরুণ দল বেঁধে অপর এক তরুণকে যখন কুপিয়ে হত্যায় লিপ্ত হয়। আর হত্যার শিকার তরুণের পক্ষে তার সহধর্মিণী একাই মাঠে অস্ত্রধারীদের সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছেন স্বামীকে বাঁচাতে। অথচ নির্বিকারভাবে আমরা অদূরে দাঁড়িয়ে এই অমানবিক তান্ডবলীলা প্রত্যক্ষ করছি! কিন্তু এই মহা-অন্যায়ের বিরুদ্ধে সামাজিক শক্তির নির্লিপ্ততা অমানবিকতা ছাড়া আর কী হতে পারে?

এ ধরনের পৈশাচিকতায় যারা জড়িত কিংবা যারা এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে; তারা যদি সামাজিক প্রতিরোধের মুখে পড়ত তা হলে আর এমন ঘটনা সৃষ্টি হতো না। বরং তা নিয়ে অন্য কিছু লেখা হতো। কিন্তু কেন তা আমরা পারছি না, একবার কি বিবেককে সেই প্রশ্ন আমরা করেছি? একবারও কি এ ব্যর্থতার জন্য আত্মসমালোচনা করেছি? নিশ্চয়ই না, যদি তাই হতো তা হলে আজ সহিংসতার মাত্রা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে থাকত। ঘাতকরা এমন দুঃসাহস দেখানোর সুযোগ পেত না। এ ক্ষেত্রে বলা যায়, পরিবার থেকে এসব নিয়ে নিজ সন্তান, আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের নজরদারি এবং শাসন যদি থাকত; তা হলে তরুণদের মধ্যে এমন বেপরোয়াভাব তৈরি হতো না। এর জন্য আমরা কম দায়ী নই। এর ফলে নয়ন বন্ড একজন অতি সাধারণ তরুণ থেকে স্থানীয় রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী চক্রের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে দাবড়িয়ে বেড়িয়েছে। তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করেও কাজ হয়নি, বলা যায় কেউ পার পায়নি। এভাবে বাধাহীনভাবে নয়ন বন্ডদের উত্থান ঘটে। এরই ধারাবাহিকতায় ঘটল বরগুনার এই পৈশাচিক হত্যাকান্ড। আমরা গণমাধ্যম তথা সংবাদপত্রের সঙ্গে যারা জড়িত তারা প্রতিদিন হত্যা, খুন, জখমের খবর কম্পাইল করতে করতে ক্লান্ত। প্রতিদিন অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করছি খুনিরা অভিনব কায়দায় একের পর এক খুন করে চলেছে। ফেনীর নুসরাতকে হাত-পা বেঁধে, শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়ে পোড়ানো হয়েছে। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে ঢাকার অদূরে নরসিংদীতে, বরিশালে, পঞ্চগড়ে।

আমেরিকান কবি মায়া অ্যাঞ্জেলুর মতে, ‘আমরা যখন পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও ভালোবাসা হারিয়ে ফেলি, তখনই আমাদের চূড়ান্ত মৃত্যু হয়।’ মৃত্যুকে চমৎকারভাবে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন তিনি। মৃত্যু সম্পর্কে কবির সংজ্ঞা অনুযায়ী এ কথা আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি, বর্তমানে আমরা এক বিবেকহীন, বোধহীন মৃত সমাজের বাসিন্দা। আমাদের প্রাজ্ঞ ঋষি স্বামী বিবেকানন্দ প্রতিটি মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের সন্ধান পেয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘জীবে দয়া করে যেজন, সেজন সেবিছে ঈশ্বর।’ অর্থাৎ জীবকে দয়া করলে স্রষ্টাকে পাওয়া যায়। আর আমাদের এ জামানায় উঠতি তরুণ-তরুণী ও যুবক-যুবতীরা বরং উল্টো স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছে। মানবপ্রেম ও মানবসেবার মধ্য দিয়ে যেখানে স্রষ্টাকে সেবার কথা, বরং তা না করে উল্টো বিপৎগামী হচ্ছে। এ বৈরী পরিবেশ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ জরুরি। এজন্য প্রয়োজন পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে কঠোর বিধিবিধান ও নীতিনৈতিকতার চর্র্চা। পাশাপাশি ধর্মীয় মূল্যবোধের অনুসরণ, অনুকরণ। প্রয়োজন এসবের পক্ষে ব্যাপক জনসচেতনতা। পাশাপাশি সামাজিক এই অবক্ষয় রোধে পাড়া-মহল্লায় নাগরিক কমিটি, কমিউনিটি পুলিশিং, নিকটস্থ থানা পুৃলিশ, প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলের জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে তদারকি এবং প্রকাশ্যে এসব চক্রকে প্রতিহত করার জন্য প্রতিরোধ দুর্গ গড়ে তোলা। এসব করতে ব্যর্থ হলে খুনিদের দায়ের কোপ থেকে কোনোভাবেই আমাদের পরিত্রাণের সম্ভাবনা নেই!

আমরা খুনি ইমদুর কথা জানিÑ মানুষের কাটামুন্ডু নিয়ে যে কি না ফুটবল খেলত। আমরা জানি খুনি এরশাদ শিকদারের কথা। যে প্রতিটি খুনের পর দুধ দিয়ে গোসল করত পবিত্র হওয়ার জন্য। আমরা তাদের শেষ পরিণতিও জানি। বলা প্রাসঙ্গিক, আগে কোথাও কেউ আক্রান্ত হলে আশপাশের লোকরা তাকে রক্ষা করতে এগিয়ে যেত। চেষ্টা করত তার প্রাণরক্ষা বা বিরোধ মোটানোর; তারপর বিচার-আচার। আর এখন কোনো এলাকায় অচেনা কাউকে ঘুরতে দেখা গেলে ‘চোর সন্দেহে’ পিটিয়ে মারার কর্মযজ্ঞে সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ি। একইভাবে টাকার লোভে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করে শিশুদের নির্মমভাবে হত্যা করছে আত্মীয়স্বজন তথা আপনজনরা। এমনই ঘটছে, কারণ আমরা একে অপরের ওপর শ্রদ্ধাবোধ হারিয়ে ফেলেছি। এসবই হচ্ছে মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ও নৈতিক অধঃপতনের লক্ষণ। এ ক্ষেত্রে সমাজবিজ্ঞানীদের মত হচ্ছে, যৌথ পরিবারে ভাঙন, ইন্টারনেট প্রযুক্তির ব্যাপক বিস্তার ও এর অপব্যবহার, সর্বনাশা মাদকের কালো থাবা এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাওয়া। অথচ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নানা আবিষ্কার মানবকল্যাণের লক্ষ্যে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আমরা সেটা ব্যবহার করছি নেতিবাচক কাজে। এর ফল হচ্ছে বর্তমানে সৃষ্ট সামাজিক অস্থিরতা। অবশ্য এর নেপথ্যে আরো কারণ রয়েছে। যেমনÑ আমরা শিশুদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছি খেলার মাঠ, সাংস্কৃতিক মঞ্চ। তাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছি বইয়ের বোঝা আর জিপিএ ফাইভের দৌড়। পাশাপাশি তাদের হাতে তুলে দিয়েছি অত্যাধুনিক ‘স্মার্টফোন’। যা তাদেরকে বিপৎগামী করছে। এজন্য প্রয়োজন সরকারের বিধিমালা। পরিবার ও প্রশাসনের ভূমিকা। আসুন দেশের সম্ভাবনাময় তরুণ যুবশক্তিকে বাঁচাতে জনসচেতনতা গড়ে তুলি।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close