ফারিহা হোসেন

  ১৬ জুলাই, ২০১৯

পর্যালোচনা

তথ্যপ্রযুক্তিতে বাড়ছে নারীর অংশগ্রহণ

সরকারি উদ্যোগে এখন হাতের নাগালে প্রযুক্তি সুবিধা। এই সুবিধা সম্প্রসারিত হয়েছে রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। এই খাতে সুযোগ-সুবিধা অব্যাহত ও প্রসারিত হওয়ায় দেশে নানা বয়সি পুরুষের পাশাপাশি নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। একই সঙ্গে নারীদের স্বাবলম্বী হওয়া ও কর্মসংস্থানের পথ সুগম হয়েছে। এতে নিজেদের সম্পৃক্ত করার মধ্য দিয়ে নতুন এক দিগন্তের সূচনা ঘটল আমাদের নারী সমাজের জন্য। পাশাপাশি অর্থ উপার্জনসহ নিজেদের কাজে সম্পৃক্ত থাকার বড় মাধ্যম হিসেবে এ খাতে নারীরা অংশগ্রহণে আকৃষ্ট হচ্ছেন। আইসিটি মন্ত্রণালয় এবং বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী বর্তমানে দেশে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারকারী জনগোষ্ঠীর প্রায় অর্ধেকই নারী। দিন দিন প্রযুক্তি ব্যবহারে নারীর সংখ্যা আরো বাড়বে বলে আশাবাদ সরকারি মহলের।

বিশেষ করে প্রোগ্রাম তৈরি করা, সাইড প্রতিষ্ঠা, বাণিজ্যকভাবে মোবাইল ব্যাংকিং, ইন্টারনেন্ট, ই-মেইল সেবাদান বায়োডাটা প্রস্তুত করা, গ্রাফিকস, ডিজাইন তৈরি, শিক্ষার্থীদের জন্য নোট শিট প্রস্তুত করা, অনলাইন শপিং, তথ্য আদান-প্রদান, স্বাস্থ্য, কৃষিবিষয়ক তথ্যসেবা দিয়ে নারীরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। এজন্য তারা নিজ নিজ বাড়ি বা বাসার পাশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দোকান নিয়ে এ ধরনের ব্যবসা পরিচালনা করছেন। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এ প্রবণতা এখন ব্যাপক হারে চোখে পড়ে। এটা অর্থনীতির জন্য যেমনি কল্যাণকর; তেমনি পরিবারের জন্য, সমাজের জন্য সমানভাবে কল্যাণকর। অর্থনীতিবিদরা মনের করেন, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে ফলে নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার পথ সুগম ও সহজলভ্য হয়েছে। এতে এ খাতের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাও বাড়ছে দিন দিন। এখন প্রয়োজন এই প্রযুক্তিকে টেকই, সহজলভ্য ও সুলভ করা।

এই প্রযুক্তি যতটা টেকসই, সহজলভ্য হবে; ততটাই দেশ, সমাজ, অর্থনীতি সমভাবে উপকৃত ও লাভবান হবে। কারণ ব্যক্তির স্বাবলম্বী হওয়ার মধ্য দিয়ে মূলত পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণ নিহিত থাকে। তাছাড়া আইসিটির বদৌলতে বর্তমান বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তের মানুষের সঙ্গে তথ্যের আদান-প্রদান, ভাব বিনিময়, বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক এমনকি সামাজিকভাবে যোগাযোগ স্থাপন সহজেই সম্ভব হয়ে ওঠেছে।

এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, আধুনিক বিশ্বে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি মাধ্যম হচ্ছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) খাত। বর্তমান যুগে এ খাতে যে দেশ যত সমৃদ্ধ; সেই দেশই বিশ্বে ততটা উন্নত বা সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে। আইসিটির ছোঁয়ায় বিশ্ব এগিয়ে চলছে দ্রুততার সঙ্গে। সুতরাং দেশ তথা সমাজকে উন্নত ও সমৃদ্ধ করতে আইসিটি খাতের উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। আধুনিক এ ডিজিটাল যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে বিশ্বের সব দেশই আইসিটির সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলছে। আশার কথা, বাংলাদেশও এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই।

অবাধ তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে তাল মেলাতে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এজন্য গ্রহণ করা হয়েছে একটি মহাপরিকল্পনা। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী সরকারি-বেসরকারি প্রায় সব ক্ষেত্রেই লেগেছে ডিজিটাল যুগের ছোঁয়া। সরকার আইসিটি খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে এবং নিত্যনতুন প্রযুক্তির সন্নিবেশ ঘটাচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে দেশের উন্নয়ন মানেই ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রের উন্নয়ন। এ গুরুত্ব বিবেচনায় সমাজের মানুষের উন্নয়ন হলেই দেশের উন্নয়ন হবে। বাংলাদেশ এ খাতে অভাবনীয় উন্নয়নে সরকারের প্রচেষ্টার পাশাপাশি ব্যক্তি প্রচেষ্টাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আমাদের দেশে মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই নারী। তাই দেশের উন্নয়নে সব ক্ষেত্রেই নারী সমাজকে সম্পৃক্ত করতে হবে। বর্তমানে দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আইসিটি বিভাগ খোলা হয়েছে। যেহেতু সমাজের অর্ধেক নারী; তাই এ ক্ষেত্রে অর্থাৎ আইসিটি খাতেও নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। তারাও সমাজ তথা দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখছেন। এ ক্ষেত্রে উৎকর্ষতা লাভ করে নারী সমাজও প্রতিষ্ঠা লাভ করছে। তবে সামাজিক বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে অনেক সময় নারী সমাজ যথার্থভাবে এগিয়ে আসতে পারছে না। তাই সব প্রতিবন্ধকতা দূর করে আইসিটি খাতে নারী সমাজকে সম্পৃক্ত করার সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। এজন্য দরকার সরকারি-বেসরকারিভাবে প্রচারণা।

ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে আইসিটি খাতে মেয়েদের এগিয়ে আসার প্রমাণ দিয়েছে বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্ক (বিওএসএন) নামের একটি প্রতিষ্ঠান। তাদের তথ্যমতে, ২০০৫-০৬ শিক্ষাবর্ষে চালানো এক জরিপে দেখা গেছে, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সহ ৯০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার সায়েন্স অথবা তথ্যপ্রযুক্তি-সংক্রান্ত বিষয়সমূহ নিয়ে পড়ছেন প্রায় ২৫ শতাংশ মেয়ে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২৫ শতাংশ ছাত্রীর মধ্যে পড়ালেখা শেষে ১৩ শতাংশ আইসিটি ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। আর মাত্র এক শতাংশ নারী আইসিটি-সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত আইসিপিসি ঢাকা রাউন্ডের প্রাথমিক বাছাই পর্বে ৯৭৯টি টিমের মধ্যে মাত্র পাঁচটি টিম ছিল যেখানে নেতৃত্ব দিয়েছেন নারী। এ প্রতিষ্ঠানটি নারীদের উৎসাহী করতে বিভিন্ন উদ্দীপনামূলক প্রচারণা চালায়। যার ফলে ২০১৬ সালে দেখা যায়, বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত ওই একই প্রতিযোগিতায় ১২৯টি টিমে নারী অংশ নিয়েছেন। সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে মেয়েদের আরো বেশি করে আইসিটি সেক্টরের সঙ্গে সংযুক্ত করা। এ লক্ষ্যে দুটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে : এর একটি হচ্ছে ‘গার্লস ইন আইসিটি’, এবং ‘মিসিং ডটার’। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং গণিতে মেয়েদের অংশগ্রহণের সংখ্যা বাড়ানো। আর এসব ক্ষেত্রে তারা যেন তাদের ক্যারিয়ার গড়ে তুলতে পারেনÑ এটাই এই আয়োজনের উদ্দেশ্য।

অবশ্য এ কারণে এসব সেক্টরে মেয়েদের অংশগ্রহণ ধীরে ধীরে বাড়ছে। ভবিষ্যতে আরো বাড়বে মেয়েদের অংশগ্রহণÑ এ প্রত্যাশা আমাদের। শুধু ছাত্রীদের উৎসাহ দিতেই জনসচেতনতা বাড়াতে প্রয়োজন বেশি বেশি প্রচারণা আর তথ্যপ্রযুক্তির সহজ লভ্যতা। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের তথ্যমতে, প্রতি বছর বাংলাদেশে প্রায় ১ দশমিক ২ মিলিয়ন চাকরি তৈরি হয়। আর এসব চাকরির অধিকাংশই ছেলেদের দখলে থাকে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট পরামর্শ দিয়েছেন, ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে হলে চাকরির ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বর্তমানের চেয়ে আরো বেশি পরিমাণে বাড়াতে হবে। কারণ নারীরা পুরুষের সম্মিলিত অংশগ্রহণে, কর্মকান্ডেই দেশ, মানুষ এগিয়ে যাবে ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে।

পুরুষের পাশাপাশি নারীর অংশগ্রহণ যদি ৩৩ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৮২ শতাংশ করা যায়; তবে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধিও ১ দশমিক ৬ শতাংশ বেড়ে যাবে। অবশ্য সরকারও আইসিটি সেক্টরে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। আইটি সেক্টরে ১০ হাজারেরও বেশি দক্ষ নারী জনবল গড়ে তোলার লক্ষ্যে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের আর্থিক সহযোগিতায় পরিচালিত লিভার্জিং আইসিটি ফর গ্রোথ, এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড গভর্ন্যান্স (এলআইসিটি) প্রজেক্টের অধীনে কমপক্ষে ৩০ শতাংশ নারী যাতে অংশগ্রহণ করেন; সেই লক্ষ্যে বিভিন্ন গণসচেতনতামূলক প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ডিভিশনের অধীনে এবং বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের (বিসিসি) উদ্যোগে পরিচালিত এ এলআইসিটি প্রজেক্ট মূলত গত বছর থেকে চালু হয়। এ পর্যন্ত প্রায় ৫০ হাজার নারী ও পুরুষকে আইসিটি বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। পরবর্তীতে প্রশিক্ষিত ২০ হাজার নারীকে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা হচ্ছে। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস বলছে, অন্যান্য সেক্টরের তুলনায় আইসিটি ইন্ডাস্ট্রি নারীর কর্মক্ষেত্রের জন্য অনেক বেশি উপযোগী। যেসব নারী উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখেন; তারা এ সেক্টরে আসতে পারেন। এই সেক্টরে কাজের অনেক সুযোগ রয়েছে। আইসিটি সূত্র বলছে, ২০২১ সালের মধ্যে দেশের নব্বই ভাগ মানুষকে তথ্যপ্রযুক্তির আওতায় নিয়ে আসতে কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি পাঁচ বছর মেয়াদি একটি মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এ মহাপরিকল্পনার আওতায় ঘরে ঘরে তথ্যপ্রযুক্তি সেবা পৌঁছে দেওয়া ছাড়াও অনলাইন ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিং, স্কুল পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনা হচ্ছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সহজলভ্য করার পাশাপাশি পাঠ্যবইয়ের অনলাইন ভার্সন প্রকাশ, এই খাতে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে নেওয়া হয়েছে বহুমুখী কর্মপরিকল্পনা।

লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও কলাম লেখক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close