রায়হান আহমেদ তপাদার

  ১২ জুলাই, ২০১৯

মুক্তমত

মহত্ত্বকে বিকশিত করার জন্যই সমাজ

মানুষ অপরাধপ্রবণ প্রাণী। তার স্বভাবে নির্যাতন স্পৃহা রয়েছে। অন্যকে আঘাত করে, কষ্ট দিয়ে নির্যাতন করে, এমনকি হত্যা করে সে তার ক্ষোভ প্রশমিত করে। কখনো এমনও হয়, যে তার শত্রু নয়, তাকেও হত্যা করতে সে দ্বিধা করে না। ক্ষেত্রবিশেষে মুহূর্তের উত্তেজনাবশত মানুষ তার সবচেয়ে প্রিয়পাত্রকেও হত্যা করে। অন্যায় ও জঘন্য অপরাধের সামাজিকভাবে প্রতিবাদ হওয়াই উচিত। কিন্তু যা কাম্য, তা হলো রাষ্ট্র অপরাধীদের আইনের আওতায় আনবে এবং বিচার করে উপযুক্ত শাস্তি দেবে। অপরাধীর শাস্তি হবে আদালতে এবং তা দেবেন বিচারক। এবং সেটা তিনি দেবেন কারো কোনো দাবির চাপে নয়, আইন অনুযায়ী সমাজে আমরা পাপ-পুণ্যের কথা শুনি। সেটা ভিন্ন ব্যাপার। পাপ-পুণ্য ব্যক্তিগত। অপরাধ সামাজিক। আসলে অপরাধের বীজ রয়েছে স্বভাবের ভেতরেই। সেটা ঠিক। কিন্তু ঠিক এটাও যে, মানুষের মধ্যে মহত্ত্বও রয়েছে। সেই মহত্ত্বকে বিকশিত করার জন্যই সমাজ। পরিবারই প্রথমে দায়িত্ব নেয়, কিন্তু পরিবার সমাজেরই অংশ, সমাজ দ্বারাই সে নিয়ন্ত্রিত। আর রাষ্ট্রের হাতে রয়েছে আইন, আছে আইন প্রয়োগের ব্যবস্থা। সমাজ যদি মানুষকে মানুষ করে না তোলে, তবে সে অপরাধী। সমাজে যদি অন্যায় থাকে এবং অন্যায়ের যদি শাস্তি না হয়, তা হলে মানুষের মানুষ হওয়া কঠিন হয়। সহজ হয় অপরাধী হওয়া। আজকের দিনে আমরা একটি বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অধীনে বসবাস করছি। এ ব্যবস্থা মানুষ চেনে না, মুনাফা চেনে। আর এই মুনাফার অর্থই হলো অন্যের বঞ্চনা। বঞ্চনাকারীরাই ধনী হয়, ক্ষমতাবান হয়। সুবিধাবাদী ব্যবস্থা মস্ত বড় অপরাধী; তার অধীনে যেসব রাষ্ট্র আছে তারাও অপরাধী। অপরাধীর পক্ষে অপরাধ দমন সম্ভব হবে কী করে? হচ্ছে না। হবে না।

অপরাধ মাত্রেই একটি কার্য বটে, কিন্তু কার্য তো ঘটে না, কারণ না থাকলে। রাষ্ট্রের পক্ষে তাই দ্বন্দ্বের লিপ্ত হওয়ার কথা উভয়ের সঙ্গেই যেমন কার্যের সঙ্গে, তেমনি কারণের। রাষ্ট্র বলে সমাজে অপরাধ থাকবে না, সব অপরাধ নির্মূল করা হবে। তার অর্থ নিশ্চয়ই এই যে, কার্য থাকবে না, কারণও থাকবে না। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে দেখা যায়, রাষ্ট্র ব্যস্ত শুধু অপরাধের ঘটনা নিয়ে। অপরাধীদের ধরে আনে, শাস্তি দেয়। কিন্তু পেছনের কারণটা দেখে না কিংবা দেখতে চায় না। বরঞ্চ বলা যাবে, রাষ্ট্রের কর্তারাই কেউ কেউ অপরাধ দেখলে দুঃখিত না হয়ে খুশিই হন। অপরাধের শাস্তি দাও, অপরাধীকে করুণা করো। এই বাণী ধর্মগ্রন্থে আছে। সমাজেও প্রতিনিয়ত পাওয়া যায়। কিন্তু বাস্তবে ব্যবস্থা ভিন্ন রকম। সমাজে মানুষ অপরাধীকেই ধরে এবং পারলে মারে। রাষ্ট্রও ওই একই কাজ করে। ধরে শাস্তি দেয়। কারাগারে পাঠায়। প্রশ্ন থেকে যায়, অপরাধ এবং অপরাধীকে কি আলাদা করা সম্ভব? হ্যাঁ, সম্ভব বৈকি। অপরাধ ও অপরাধীর সম্পর্কটা নর্তক ও নৃত্যের মতো সম্পর্ক নয়, অপরাধীর পেছনে কার্যকারণ অনুসন্ধান করলে অপরাধের কারণ দেখা যাবে। এবং অপরাধের শাস্তি দেওয়া বলতে যা বোঝায় তা আসলে ওই কারণকে নির্মূল করা ছাড়া অন্য কিছু নয়। দেখার কাজটা সহজে হয় না। প্রধান অন্তরায় আগ্রহের অভাব। অপরাধীকে পাকড়াও করা যে সহজ তা নয়, কিন্তু অপরাধের কারণ অনুসন্ধান এবং তার নির্মূলকরণ অবশ্যই কঠিন। অপরাধী দেখলে সমাজ চিৎকার করে, রাষ্ট্র তাকে ধরে । যদিও সব সময় নয়। ওদিকে অপরাধের ক্ষেত্রটা কিন্তু রয়েই যায়। মোটামুটি অক্ষত। সেখানে নতুন নতুন অপরাধ ও অপরাধীর জন্ম হয়।

দ্বন্দ্বের মীমাংসা হয় না। জয় হয় না রাষ্ট্রের। দূর হয় না অপরাধ। রাষ্ট্রের জন্য সেটা বড় রকমের ব্যর্থতা। কেননা রাষ্ট্র অঙ্গীকারবদ্ধ অপরাধ দমনে। তার অস্তিত্বের প্রধান শর্তগুলোর একটি হচ্ছে ওই দমন। নাগরিকদের নিরাপত্তা দেবে। তারা যাতে নিশ্চিন্তে থাকতে পারে তার ব্যবস্থা করবে। এটা রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি। কিন্তু রাষ্ট্র সেটা পারছে না করতে। ব্যর্থতা নয়, বলতে হয় এ হচ্ছে অপরাধ। রাষ্ট্র অপরাধী হয়ে পড়ে নাগরিকদের কাছে। কেননা অপরাধ তো কমছেই না, বরঞ্চ শুধুই বাড়ছে। রাষ্ট্র যেন প্রকারান্তরে আনুকূল্য দিচ্ছে অপরাধকে। উৎসাহিত করছে তার বৃদ্ধিকে। যে রাষ্ট্রে যত বেশি অপরাধ, সে রাষ্ট্র তত বেশি অপরাধী। বাস্তব ক্ষেত্রে এ জাতীয় ঘটনা ঘটে সবচেয়ে কম। জেলখানা সংশোধনের প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে না। বরঞ্চ উল্টো দায়িত্ব পালন করে। কয়েদির গায়ে এমন দুরপনেয় ছাপ মেরে দেয় যে, সে যখন বেরিয়ে আসে তখন উন্নত নয়, অবনত হয়েই বের হয়। সমাজে সে সম্মান পাবে আশা করে না। কেউ তাকে বিশ্বাস করতে চায় না। কাজ দেয় না। ফলে আবার সে অপরাধ করে।

রাষ্ট্রক্ষমতা অপহরণ অপরাধ নয়, অপরাধ পকেট মারা এই যদি হয় রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি, তা হলে কে কার বিচার করে, শাস্তি দেয়! নাট্যকার জর্জ বার্নার্ড শ পরিহাসপ্রিয়তার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। কারাগার প্রসঙ্গে একবার তিনি বলেছিলেন, খুব ভালো হতো বিচারকরা যদি অপরাধী সেজে ছয় মাস কারাবাস করে আসতেন। তা হলে তারা জেলে পাঠাতে দ্বিধা করতেন। জেলখানার অবস্থার উন্নতি না হলে শাস্তি দেবেন না বলে অনমনীয় হয়ে থাকতেন। প্রস্তাবটা মন্দ নয়। কিন্তু সমস্যা আছে। আর সেটা যে শুধু প্রস্তাব বাস্তবায়নের, তা নয়। সমস্যা এখানেও যে, কারা সংস্কার যতই করা হোক, কারাগার কারাগারই থাকবে, ওপরে তুললেও নিচে নেমে যাবে। ঘুষ, দুর্নীতি, বরাদ্দ অপহরণ, স্থানাভাবÑ এসব সহজেই থাকবে। ছয় মাসের মধ্যে যে-কে সেই। কারা সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়, কারা কমিশন গঠিত হয়। কিন্তু কারাগার যেখানে ও যে অবস্থায় থাকার, সেখানেই থাকে। ওঠাতে চাইলেও ওঠানো যায় না। শাস্তি তো দিতেই হবে এবং শাস্তি দিতে হলে জেলে পাঠানো ছাড়া উপায় কী। যত বেশি পাঠাবেন, ততই অবনতি হবে কারাবন্দিদের অবস্থার। রাষ্ট্রের জন্য নিশ্চয়ই আরো বড় বড় কাজ রয়ে গেছে। পরিশেষে বলতে হয়, কারা সংস্কার জরুরি, আরো জরুরি সমাজ সংস্কার। সংস্কারে যে কাজ হবে তাও নয়, প্রয়োজন হচ্ছে সমাজ বিপ্লব। অর্থাৎ সেই রকম সমাজ প্রতিষ্ঠার, যেখানে অন্যায় থাকবে না, বৈষম্যের অভাব ঘটবে এবং মানুষ তার মনুষ্যত্বকে বিকশিত করে উচ্চতর সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারবে। শত্রুতা থাকবে না, থাকবে মৈত্রী। নির্মূল হবে অপরাধের কারণ। যে রাজনীতিকরা একসময় জেল খেটেছেন, বাইরে এসে তারাও জেলখানার দুরবস্থার বিষয়টি ভুলে যান। সেটাই স্বাভাবিক। কেননা তাদের জন্য আরো জরুরি কাজ রয়ে গেছে।

সমাজের এ পরিবর্তনের জন্য আবশ্যক হবে রাষ্ট্রের চরিত্রে পরিবর্তন আনা। অপরাধীদের বিষয়ে সব সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি এক নয়। তলস্তয় খুবই ব্যথা পেয়েছিলেন লন্ডন শহরে আসামিদের প্রতি পথচারীদের আচরণ দেখে। তিনি দেখলেন লোকে পারলে মারে, ঢিল ছুড়তে চায়, শাস্তি দিতে আগ্রহী। রুশ দেশে তিনি দেখেছেন ভিন্ন ব্যাপার। সেখানে অপরাধী দেখলে লোকে করুণা করে, বিষণœ হয়, ভাবে ওই বিপৎগামীরা শাস্তির নয়, সহানুভূতির পাত্র। এসব পার্থক্য নানা ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক কারণেই ঘটে। যেমন আমরা। আমরা অপরাধী দেখলে মারতেও যাই না, চোখের পানিও ফেলি না। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিটা মোটামুটি উদাসীনতার। এর কারণ রয়েছে। কারণ যাই হোক, এতে অপরাধ কমে না। এই অপরাধীদের সৃষ্টি করেছে আমাদের সমাজ। কারণ ছাড়া কার্য হয় না। প্রতিটি কর্ম-সুকর্ম হোক বা অপকর্ম হোক; বাহ্যিক ও অন্তর্নিহিত কারণ ছাড়া ঘটে না। নষ্ট সমাজের জন্য দায়ী নষ্ট রাজনীতি। দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির কারণে প্রশাসন ভেঙে পড়ে বা দুর্বল হয়। সুতরাং একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ নির্মাণ করতে চাইলে বদলাতে হবে বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থা। একাংশ তো অবশ্যই। সেই অংশে যে অংশ অপরাধ নিবারণের সঙ্গে যুক্ত। পুলিশ কী করবে যদি চোর না থাকে? আদালতপাড়ায় যাদের সরব ও সদর্প আনাগোনা উকিল, পেশকার, টাউট তাদের পেশা ও ব্যবসায়ের কী হবে অপরাধ যদি দূর হয়ে যায় সমাজ থেকে? মামলা-মোকদ্দমা নেই, ঘুষ উঠে গেছে, তদবির অপ্রয়োজনীয় ও কারাগার পরিণত হয়েছে অতীতের স্মৃতিতেÑ এমন অবস্থা মোটেই সুখকর হবে না অপরাধ দমন ও শাস্তি বিধানের দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকদের জন্য। বেকার হওয়ার আশঙ্কা। এরা চায় এবং চাইবে অপরাধ থাকুক, বাড়তে থাকুক। কেননা বৃদ্ধিতেই তাদের সমৃদ্ধি। ভাব করে বিরক্তির, আসলে হয় প্রসন্ন। অনেক সময় নিজের অজান্তে। আসলে স্বার্থ বড়ই কঠিন নিয়ামক। বিবেকহীন।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close