মযহারুল ইসলাম বাবলা

  ০৯ জুলাই, ২০১৯

পরিবেশ

বুড়িগঙ্গার শাখা নদীটির হারিয়ে যাওয়া

আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা পুরান ঢাকার ঘনবসতিপূর্ণ লালবাগ এলাকার সরু গলিপথের মাঝামাঝি ইট, চুন-সুড়কির একতলা হাবেলি বাড়িতে। সেই সরু গলিটা শেষে গিয়ে মিশেছে বুড়িগঙ্গার তীরে। পুরান ঢাকার পূর্ব প্রান্তের ফরিদাবাদ আইজি গেট থেকে পশ্চিমের কাঁটাসুর পর্যন্ত বুড়িগঙ্গার তীরঘেঁষে উত্তরের এ অঞ্চলটি একসময় ছিল শহরের প্রধান ও একমাত্র জনপদ। কালের বিবর্তনে তা আজ পুরান ঢাকা নামে অমর্যাদায় অধিষ্ঠিত। ঢাকা বিস্তৃৃত হয়েছে উত্তরদিকসহ প্রায় সবদিকেই। নতুন ঢাকা সেজেছে আধুনিকতার ছোঁয়ায়। পুরান ঢাকা জীর্ণশীর্ণ অবহেলিত তাচ্ছিল্যের মূর্ত প্রতীক। অথচ ঢাকা শহর গড়ে ওঠার মূলেই ছিল আজকের পুরান ঢাকা। একে কেন্দ্র করেই ঢাকার নগরায়ণ শুরু। নগরায়ণের প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয় ছিল নদী ও নদীপথের অবাধ যোগাযোগ ব্যবস্থার সুযোগ। সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা তখন উন্নত ছিল না। এই নদীপথের যোগাযোগ ব্যবস্থার ভিত্তিতেই ঢাকা শহর গড়ে উঠেছিল বুড়িগঙ্গা নদীর উত্তর তীরঘেঁষে।

নদীনির্ভরতায় দেশের সব পাইকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাজার-আড়ত সবই এ অঞ্চলে অবস্থিত। ঢাকা নগরী বেড়ে যাওয়ায় এবং সড়কপথের আমূল পরিবর্তনের ফলে পুরান ঢাকার কদর নানাভাবে কমেছে। নতুন ঢাকায় পর্যায়ক্রমে গড়ে উঠেছে পাইকারি আড়ত-বাজার ইত্যাদি। আরেকটি বিষয় তাৎপর্যপূর্ণ তা হলো বুড়িগঙ্গার শীর্ণ ও মরা নদীতে রূপান্তর। এককালে বিশাল বুড়িগঙ্গায় আমরা সাঁতার কেটে নৌকায় চড়ে কাটিয়েছি প্রতিটি বর্ষা মৌসুম। আজ সে নদী আছে, তবে আয়তনে-গভীরতায় এতই শীর্ণ যে তাকে কোনোভাবেই নদী বলা যাবে না; যেন ময়লা-আবর্জনা প্রবাহের বড় আয়তনের এক ড্রেনবিশেষ।

বুড়িগঙ্গার বুকে কামরাঙ্গীর চর ছিল এক বিস্ময়ের দ্বীপ। যার দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা। সেই বুড়িগঙ্গার ওপর দিয়ে বড় বড় লঞ্চ-স্টিমারসহ সব নৌযান চলাচল করত এবং আজও করে। কামরাঙ্গীর চরের উত্তরের বহমান নদীটি বুড়িগঙ্গার শাখা নদী; বর্ষা মৌসুমে এ শাখা নদীর আকৃতি ও আয়তন বড় নদীর সমান হয়ে যেত। কামরাঙ্গীর চর থেকে উত্তরের পুরান ঢাকার তীর পর্যন্ত দুই কিলোমিটার প্রস্থ শাখা নদীটি এখন কয়েক গজের মরা খালবিশেষ।

প্রতি শীত মৌসুমেই কামরাঙ্গীর চরের উত্তরে বিশাল অঞ্চলজুড়ে চর জাগত। মনে পড়ে দক্ষিণের নদীর তীর থেকে সামান্য দূরত্বের সরু নদীটি নৌকায় চেপে পার হয়ে আমরা সেই বিশাল চরে গিয়ে খেলাধুলা করতাম। এ যেন এক হারানো পৃথিবীর হারানো সময়ের স্মৃতি। লালবাগ কিল্লার মাঠ, আজিমপুর কলোনির মাঠ এবং জেগে ওঠা চর আমাদের মাঠের অভাব পূরণ করত। কামরাঙ্গীর চরের কৃষকরা পাট-ধানসহ রবিশস্য চাষাবাদ করতেন। ফুটবল খেলতে গিয়ে মরা ঝিনুকে কতজনের পা কেটেছে। চরের নরম মাটিকে দুরমুশ দিয়ে পিটিয়ে তৈরি করতাম ক্রিকেটপিচ। চর জেগে উঠলে আনন্দে আত্মহারা হতাম। বর্ষার পানি না আসা পর্যন্ত এই চরই ছিল আমাদের খেলাধুলার মাঠ। এখন এই চর বর্ষার পানিতে ডুবে যায় না। কামরাঙ্গীর চরের উত্তর তীর থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তীর্ণ শাখা নদীটি এখন জনাকীর্ণ বসতি। বেড়িবাঁধের দক্ষিণে কয়েক গজের পতিত নদীটি শহরের ময়লা ড্রেনের পানি বহনের জন্য টিকে আছে মাত্র। সামরিক শাসক এরশাদের শাসনামলে বুড়িগঙ্গা নদীতে বেড়িবাঁধ নির্মাণ, ঢাকা শহরের অভ্যন্তরে অজস্র বুড়িগঙ্গার সংযোগ খালসমূহ কালভার্টে রূপান্তর করা এক চরম সর্বনাশা আত্মঘাতী কাজ ছিল। যার কুফল আমরা জলবদ্ধতায় প্রতি বর্ষা মৌসুমে ভোগ করছি।

ক্ষমতাধর ভূমিদস্যুদের দৌরাত্ম্য সীমা-পরিসীমা অতিক্রম করেছে। আমাদের গলিপথের দক্ষিণের শেষ প্রান্তের নদীতীরের পাকা সরকারি সিঁড়িঘাট আজ আর নেই। বেড়িবাঁধের উত্তর দিকের ঢালু অংশসহ উত্তর প্রান্তের সমতল ভূমি চলে গেছে বেদখলে। সেখানে গড়ে উঠেছে আড়ত-বাজার, কারখানা, বাড়িঘর। বেড়িবাঁধের দক্ষিণের সরু কয়েক গজের খালটি ছাড়া বিশাল বুড়িগঙ্গার শাখা নদীটি ভূমিদস্যুদের অধীনে এখন বিশাল জনপদে পরিণত। এই শাখা নদীটি দিয়ে ১২ মাস সদরঘাট-বাদামতলী থেকে পণ্যবাহী বড় বড় নৌকা গাবতলী-সাভার অভিমুখে যাতায়াত করত। এখন ডিঙ্গি নৌকার চলাচলেরও উপায় নেই। মাটি ভরাট করে বুড়িগঙ্গার শাখা নদীটি বেদখল হয়ে গেছে। বেড়িবাঁধের রাস্তা দিয়ে চলছে বাস-ট্রাকসহ সব ধরনের যান। ভূমি অধিদফতরের যোগসাজশে স্থানীয় দখলবাজ চক্র দখলে নিয়েছে শাখা নদীটি ও তার তীরের বিস্তীর্ণ খাস জায়গা-জমি। নদী-উদ্ধারের নামে মাঝে মাঝে যে তৎপরতা দেখা যায়, তা এক তামাশা মাত্র। অবৈধ দখলদারদের থেকে উৎকোচ গ্রহণের জন্যই চালানো হয় উদ্ধার তৎপরতা। কোনোভাবেই বুড়িগঙ্গা ও আশপাশের এক ইঞ্চি খাস জায়গা-জমি উদ্ধার করা আজও সম্ভব হয়নি।

কামরাঙ্গীর চরের মানুষের জীবন-যাপন-ভাষা শহরতলির নয়, বরং ছিল গ্রামীণ। গাছগাছালি-সমৃদ্ধ গ্রামীণ এই জনপদটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে যেতাম। যেতাম এয়ারগান দিয়ে বালি হাঁস-ঘুঘু শিকার করতেও। কামরাঙ্গীর চরের ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক অতীত এখন কিছুই অবশিষ্ট নেই। নেই গাছপালাসহ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সেই জনপদটি। আমাদের গরুর দুধের চাহিদা পূরণ করত কামরাঙ্গীর চরের গ্রামীণ মানুষ, যাদের অনেকের জীবিকা ছিল গরু পুষে দুধ বিক্রি করা। স্থানীয় বাজারগুলোতে কামরাঙ্গীর চর ও কলাতিয়ার চাষিরা তাদের উৎপন্ন টাটকা সবজি-তরকারি প্রতিদিন সকালে বিক্রি করতে আসতেন। শ্যামবাজার আড়ত থেকে কেনা সবজি তরকারির চেয়ে টাটকা হওয়ার কারণে তাদেরগুলোর চাহিদা ছিল বেশি। উল্লেখ্য যে, বুড়িগঙ্গার শাখা নদীটির খেয়া পারাপারের পেশায়ও যুক্ত ছিল কামরাঙ্গীর চরের অনেক মানুষ। দক্ষিণের তীরঘেঁষে বর্তমানের বেড়িবাঁধের উত্তরে ছিল বিশাল জেলে পল্লী। সারা রাত জেলেরা বুড়িগঙ্গার শাখা নদীতে জাল টেনে সকালে বাজারে তাজা-টাটকা মাছ বিক্রি করতেন। শীর্ণ বুড়িগঙ্গার পানি ট্যানারি-বর্জ্যরে দূষণের কারণে মাছহীন হয়ে পড়েছে। জেলেরা তাদের পেশায় থাকতে পারেননি। জেলে পল্লীও আগের মতো নেই। জোর-জুলুম করে জেলেদের উচ্ছেদ করে জেলে পল্লী সংকুচিত করেছে দখলবাজরা। জেলেরা কেউ কেউ জীবিকার জন্য কারওয়ান বাজার, নিউমার্কেট, সোয়ারীঘাটের আড়ত থেকে মাছ কিনে এনে স্থানীয় বাজারগুলোতে বিক্রি করেন। অন্যরা বেছে নিয়েছেন বিভিন্ন পেশা। বুড়িগঙ্গায় শৌখিন মাছ শিকারিরাও মাছ ধরতেন বড়শি ও জাল দিয়ে। পুঁটি মাছ রোদে পচিয়ে টোপ দিয়ে বোয়াল মাছও ধরতেন। প্রচুর মাছ ছিল শাখা নদীটিতে। দূষণে-দুর্গন্ধে যা আজ কল্পনাও করা যায় না।

শাখা বুড়িগঙ্গা নদীর কয়েক গজের সরু খালটি টিকে আছে কালের সাক্ষী হয়ে। তাও থাকত না, যদি না পয়ঃময়লা ড্রেনের পানি সেখান দিয়ে নির্গত হওয়ার একমাত্র ব্যবস্থাটা না থাকত। এমনকি বৃষ্টির পানিরও। ভারী বৃষ্টিতেও পুরান ঢাকার এই অঞ্চলটিতে কখনো বৃষ্টির পানিতে জলাবদ্ধতার নজির নেই। অথচ নানা আবর্জনায় বেড়িবাঁধের স্লুুইসগেটের পথ বন্ধ হয়ে সেখানে পচা-দুর্গন্ধময় জলাশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। সেই জলাশয়ের পানিতে উৎপন্ন হচ্ছে মশা। মশার তান্ডবে অতিষ্ঠ স্থানীয় মানুষ।

লালবাগের শহীদনগর-ইসলামবাগ নামের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাও বুড়িগঙ্গার শাখা নদীকে ভরাট করেই গড়ে উঠেছে। শীত মৌসুমে শুকিয়ে যাওয়া তীরের অস্থায়ী বেলে মাঠে আমরা খেলাধুলা করেছি। লালবাগ শ্মশান ঘাটের দক্ষিণের খালি জায়গাজুড়ে চৈত্রসংক্রান্তির মেলা বসত। স্থানীয়দের ভাষায় চৈতপূজার মেলা। সেই মেলা আমাদের জন্য ছিল উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সন্ধ্যায় মেলা থেকে বৃষ্টিতে ভিজে বাসায় ফিরতাম। চৈত্রসংক্রান্তির শেষ বিকালে বৃষ্টি ছিল অনিবার্য, আজকে যা দেখা যায় না। প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের নিষ্ঠুর আচরণের কারণে প্রকৃতিও বদলা নিচ্ছে নানাভাবে। এখন শহরজুড়ে পহেলা বৈশাখ উদযাপন হয় ঘটা করে। নিরানন্দ নাগরিক জীবনে ক্ষণিকের আনন্দের স্রোত বয়ে যায় সত্য, তবে তা কেবলই ভোগের পর্যায়ে। সেখানে জাতীয়তার চেতনার গভীরতার চিহ্ন খুঁজে পাওয়া কঠিন। পহেলা বৈশাখে হিন্দু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন ব্যবসা কেন্দ্রে দল বেঁধে মিষ্টি খেতে যেতাম। যেতাম কারো কারো বাড়িতেও। স্থানীয় মুসলমানদের অবশ্য পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন করতে তেমন দেখিনি। একমাত্র ব্যবসা কেন্দ্রে হালখাতার আয়োজন ব্যতীত স্থানীয়দের জীবনাচারে নববর্ষকেন্দ্রিক উৎসব-আনুষ্ঠানিকতা ছিল না।

এখন অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য বটে, বর্ষা মৌসুমে বুড়িগঙ্গার শাখা নদীতে নৌকাবাইচ ও সাঁতার প্রতিযোগিতা হতো এখনকার কয়েক গজের পয়ঃময়লা নিষ্কাশনের সরু খালটিতে। তখন আয়তনে সে ছিল দুই কিলোমিটার প্রস্থ। দূর-দূরান্তের আত্মীয় পরিজনরা নৌকাবাইচ দেখতে আসতেন। স্থানীয় সবার বাড়ি পরিপূর্ণ থাকত উৎসবমুখর আতিথেয়তায়। বাড়িতে বাড়িতে চীনাবাদাম, বুট-ভুট্টার খৈ ভাজা হতো নৌকাবাইচকে কেন্দ্র করে। সব বয়সিরা বাদাম, খৈ খেতে খেতে নদীর তীরের ঘাটে এবং মহিলারা তীরের বিভিন্ন বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে নৌকাবাইচ ও সাঁতার প্রতিযোগিতা উপভোগ করতেন। সবই এখন অতীত স্মৃতি। বর্ষাকালে স্থানীয় যুবকরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে বজরায় পিকনিক করতে যেতেন মিরপুরের বেগুনবাড়িতে। নদীপথে তাদের বজরা-ভ্রমণ ছিল বর্ষায় নিয়মিত। শনিবার বিকালে রওনা হয়ে পরদিন বিকালে ফিরে আসতেন সবাই। রঙিন কাগজ দিয়ে বজরা সাজিয়ে, মাইক বাজিয়ে নদীর বুক চিরে তাদের সেই নৌভ্রমণ এখন অতীত স্মৃতিমাত্র।

অপরিকল্পিত নগরায়ণে আজ আমাদের দুর্ভোগের অন্ত নেই। সীমাহীন নির্লিপ্ততায় পুরান ঢাকা ক্রমেই হারাতে চলেছে তার পরিধি-আলো-বাতাস-নদীর বহমানতাসহ সব নাগরিক সুবিধা। যে যার মতো লুটে চলেছে রাষ্ট্রীয় অর্থ-সম্পদ, নদীসহ খাস জায়গা-জমি। আমাদের ঠেলে দিচ্ছে দূষিত-অস্বাস্থ্যকর আলো-বাতাসহীন এক ভয়ানক নরক জীবনের দিকে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close