সাধন সরকার

  ২৯ জুন, ২০১৯

সতর্কতা

বজ্রপাতে মৃত্যুর মিছিল থামাতে হবে

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বজ্রপাতে মৃত্যুর মিছিল লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে! ঝড়-বৃষ্টির সঙ্গে বজ্রপাত নতুন আতঙ্কের নাম হয়ে দেখা দিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগসমূহের মধ্যে বজ্রপাত সবচেয়ে আলোচনার নাম। বিশে^ বজ্রপাতের কারণে যত মানুষের মৃত্যু হয় তার চার ভাগের এক ভাগ মানুষের মৃত্যু হয় বাংলাদেশে। তথ্যমতে, বাংলাদেশে গত ৮ বছরে ২ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে বজ্রপাতে। ২০১৬ সালে বজ্রপাতে প্রায় ৩৫০ জন মানুষের মৃত্যু হয়। ২০১৭ সালেও ৩০০-এর বেশি মানুষের মৃত্যু হয় বজ্রপাতে। ২০১৮ সালে বজ্রপাতে ১৬০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। আহত হয় শতাধিক। বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকায় ২০১৬ সালে সরকার বজ্রপাতকে ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগ’ হিসেবে ঘোষণা করে। এরপর থেকে বজ্রপাত রোধে নেওয়া হয় বিশেষ পরিকল্পনা ও সতর্কীকরণ কর্মসূচি। কিন্তু মৃত্যুর মিছিল তাতে থামানো যায়নি! এখন বর্ষা মৌসুম চলছে। ২০১৯ সালে বর্ষা মৌসুমের শুরুতে ও কালবৈশাখীর তান্ডবে বজ্রপাতে এখন পর্যন্ত ১০ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। পৃথিবীর উন্নত ও উন্নয়নশীল অনেক দেশে বাংলাদেশের থেকে বজ্রপাতের সংখ্যা বেশি হলেও সেসব দেশে মৃত্যুর সংখ্যা নগণ্য। তথ্যমতে, বিশে^র মোট বজ্রপাতের ৭৮ শতাংশ হয় ক্রান্তীয় অঞ্চলে। বাংলাদেশ যেহেতু ক্রান্তীয় অঞ্চলে অবস্থিত, এখানে বজ্রপাত বেশি হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বিশে^র অন্য সব দেশের মতো বজ্রপাত নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ ও সতর্কতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করার ফলে মৃত্যুর সংখ্যা কমিয়ে আনা সম্ভব। মৌসুমি বায়ু আগমনের (এপ্রিল-মে-জুন) সঙ্গে সঙ্গে আর কালবৈশাখীর তান্ডবলীলা বজ্রপাত শুরুর মৌসুম বলা হয়। বজ্রপাতে যারা মারা যাচ্ছেন, তাদের বড় একটি অংশই খেটে খাওয়া অতিসাধারণ কর্মক্ষম মানুষ। যদি পরিবারের একমাত্র রোজগারের মানুষটা বজ্রপাতে মারা যায়, তা হলে সে পরিবারের কী অবস্থা হয়, তা শুধু ভুক্তভোগী পরিবারই জানে।

দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর থেকে আসা আর্দ্র বায়ু আর হিমালয় থেকে আসা শুষ্ক বায়ুর মিলনে বজ্রপাত সৃষ্টির সম্ভাবনা তৈরি হয়। গবেষকরা বলছেন, পরিবেশে এখন যে পরিমাণ কার্বন আছে তা যদি কোনোভাবে দ্বিগুণ হয়ে যায়, তা হলে বজ্রপাতের পরিমাণ প্রায় ৩২ ভাগ বেড়ে যাবে। বায়ুদূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে বজ্রপাতের সম্পর্ক রয়েছে বলে বলা হচ্ছে। বাংলাদেশ বিশে^র বায়ুদূষণজনিত প্রথম সারির দেশগুলোর একটি। আবার বজ্রপাতপ্রবণ অঞ্চলগুলোর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়া অন্যতম। যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ সংস্থা নাসা ও মেরিল্যান্ড বিশ^বিদ্যালয়ের এক গবেষণায় উঠে এসেছে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয় সুনামগঞ্জে। সত্যিই হাওরাঞ্চল ও এর আশপাশের জেলাগুলোতে বজ্রপাতে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটছে। হাওর এলাকায় উঁচু গাছপালা কম। এ ছাড়া যেসব এলাকায় গ্রীষ্ককালে স্বাভাবিকের চেয়ে তাপমাত্রা বেশি থাকে, সেসব এলাকায় বেশি মেঘ তৈরি হয়। ফলে বজ্রপাতের আশষ্কা বেশি থাকে। নদী বা জলাভূমি শুকিয়ে যাওয়া, গাছপালা ধ্বংস হওয়াসহ প্রভৃতি প্রকৃতি বিনাশী কর্মকান্ডের ফলে বায়ুমন্ডলে তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। ফলে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। আবহাওয়ার এমন অনভিপ্রেত পরিবর্তন বজ্রসহ ঝড়-বৃষ্টির জন্য বেশি দায়ী। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্ট সেন্ট বিশ^বিদ্যালয়ের এক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্যমতে, হিমালয়ের পাদদেশ হতে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ অতিমাত্রায় বজ্রপাতপ্রবণ দেশে পরিণত হচ্ছে। আবার গবেষকদের মতে, বিশে^র গড় তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেলে বজ্রপাত অন্তত ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। শহরের চেয়ে গ্রামে বজ্রপাতের পরিমাণ বেশি। অল্প ব্যবধানে বিদ্যুতের খুঁটি, বিভিন্ন টাওয়ার, বিল্ডিংয়ে বজ্র নিরোধক দন্ড থাকায় শহরে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা কম। কিন্তু গ্রামে এসব বস্তু যেমন কম, তেমনি বড় বড় গাছ ধ্বংস করে ফেলার কারণে গ্রামাঞ্চল অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। তাল, নারিকেল, বট, সুপারিসহ নানা ধরনের বড় বড় গাছ বজ্রপাতের আঘাত নিজের শরীরে নিয়ে নেয়। ফলে বজ্রপাত হলেও মানুষ বেঁচে যেত। কিন্তু গ্রামাঞ্চলে বড় বড় গাছ কমে যাওয়াসহ কৃষিতে যন্ত্রপাতির ব্যবহার ও মুঠোফোনের ব্যবহার বৃদ্ধি বজ্রপাতকে যেন স্বাগত জানাচ্ছে!

বজ্রপাত যেহেতু প্রাকৃতিক এটা হবেই, তবে কম অথবা বেশি। বজ্রপাত রোধে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পিত ব্যবস্থা গ্রহণ করার পাশাপাশি জনসাধারণের মধ্যে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণই বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা কমিয়ে আনা যেতে পারে। সরকার বজ্রপাত রোধে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায় ২৮ লাখ তালগাছ লাগানোর পরিকল্পনা নিয়েছে এবং তা বাস্তবায়নে কাজও চলছে। কিন্তু যেহেতু তালগাছ বড় হতে সময় লাগে, সেহেতু দ্রুত লম্বা হয়Ñ এমন গাছ লাগানো দরকার। তাছাড়া একটি গাছে বজ্রপাত হলে সে গাছ মারা যায়, সেক্ষেত্রে বিকল্প ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে হবে। বজ্রপাতে গাছ মরে যাওয়া জায়গায় দ্রুত আবার গাছ লাগানোর ব্যবস্থা করতে হবে। ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ডসহ পৃথিবীর উন্নত দেশসমূহ বজ্রপাত নিয়ন্ত্রণে প্রযুক্তিনির্ভর ‘লাইটেনিং ডিটেকটিভ সেন্সর’ কাজে লাগাচ্ছে। এ ছাড়া আরো উন্নত প্রযুক্তি আছে, যার সেন্সরের সাহায্যে বজ্রপাতে আধা ঘণ্টা আগে সতর্কবার্তা পাওয়া যায়। এসব প্রযুক্তি কাজে লাগানো যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে ‘কমিউনিটি রেডিও নেটওয়ার্কগুলো’ কাজে লাগানো গেলে ভালো কাজ দেবে। গ্রামাঞ্চলে বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে ফাঁকা জায়গায় বাবলা, হিজল, সুপারি, নারিকেল, বটসহ বড় ও লম্বা দ্রুতবর্ধনশীল গাছ লাগাতে হবে। মাঠের মাঝখানে খাম্বা বসিয়ে আর্থিং করলে বজ্রপাতে প্রাণহানি কমবে। এ ছাড়া বায়ুমন্ডলে কার্বন বৃদ্ধিসহ সার্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়Ñ এমন প্রাণ-প্রকৃতি বিনাশী কর্মকান্ড থেকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশসহ পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোকে আরো যত্নশীল হতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে সরকারের যেসব কর্মসূচি আছে; সেগুলো যথাযথ প্রক্রিয়ায় শেষ করা গেলে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা করা যেমন সম্ভব হবে; তেমনি বজ্রপাত নিয়ন্ত্রণেও ভূমিকা রাখবে।

লেখক : পরিবেশকর্মী ও কলামিস্ট

[email protected]

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close