অলোক আচার্য

  ২৮ জুন, ২০১৯

পর্যবেক্ষণ

যানজট : রাজধানীর ভবিষ্যৎ কী

তিলোত্তমা নগরী ঢাকা এখন বহুমুখী সমস্যায় ঘোরপাক খাচ্ছে। এসব সমস্যা সমাধানে বারবার উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও কোনোটারই সুষ্ঠু বাস্তবায়ন না হওয়ায় সমস্যাগুলো এখন মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এগুলোর তালিকা তৈরি করলে অনেক লম্বা হবে। এবং কোনটির আগে কোনটি সমাধান করা হবে; তা নিয়েই ভজঘট লেগে যাবে। এসব সমস্যা কার্যত এ শহরটাকে অকার্যকর করে ফেলছে। এই শহরে থাকা মানুষগুলো প্রতিদিন সমস্যা নিয়েই বাসা থেকে বের হচ্ছে আবার সমস্যার মাঝেই বাসায় ফিরছে। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ জীবিকার সন্ধানে ঢাকামুখী হচ্ছে। এদের অনেকেই আবার সেখানে স্থায়ী বসবাস করার জন্য চেষ্টা করছে। অনেক আগেই ঢাকার জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে মেগাসিটি হয়েছে। সেই জনসংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। কয়েক দিন আগেই ওয়াসার পানিতে ময়লা থাকা নিয়ে যে ব্যতিক্রমী প্রতিবাদ হয়েছে, তা দেখেছি। এটা কি শুধু সেই এলাকার চিত্র। বাইরে বের হয়েই প্রথম যে সমস্যায় পড়তে হয়, তা হলো যানজট। ঢাকার মানুষ দৈনিক রাস্তায় চলতে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করছে রাস্তায় গাড়িতে। প্রতিদিন যানজটে পড়ে ঢাকার মানুষের লাখ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। এত কর্মঘণ্টা নষ্ট হওয়ায় বিপুল আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এক জরিপে দেখা গেছে, ঢাকায় বর্তমানে ঘণ্টায় গড় গতি ৬ কিলোমিটার। আর কিছুদিন পর এই গতি ৪ কিলোমিটারে নেমে আসবে। যানজট কেবল ঢাকার সমস্যা নয়, বরং এশিয়ার কয়েকটি দেশসহ অনেক দেশেই যানজট মারাত্মক সমস্যা হয়ে বসে আছে। বিশেষ করে যেসব শহরের জনসংখ্যা ধারণক্ষমতা অতিক্রম করেছে এবং শহরটি ঢাকার মতো অপরিকল্পিত। যার যেভাবে খুশি বড় বড় বিল্ডিং তৈরি করে রেখেছেন। রাস্তার ভেতর গাড়ি পার্ক করে রাখা হয়। তবে ঢাকার মতো এত প্রকট আকার ধারণ করা শহরের সংখ্যা এত নেই। কিছু কিছু এলাকায় তো গাড়ির গতির চেয়ে মানুষের হাঁটার গতিই বেশি!

তা হলে একসময় কি ঢাকা স্থবির হয়ে যাবে? যদি যানজট পরিস্থিতি বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণ না করে, তা হলে সত্যিই ঢাকা স্থবির হয়ে যাবে। তখন মানুষ হাঁটবে আর যানবাহন দাঁড়িয়ে থাকবে। এখনই অবশ্য সেই অবস্থার কিছুটা আঁচ পাওয়া যায়। যানজট নিরসনে বহুবার বহু উদ্যোগ নেওয়া হলেও কার্যত তা ব্যর্থ হয়েছে। প্রতিদিন ঢাকায় গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে। ব্যক্তিগত গাড়ির চাপে ঢাকার ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। দেখা যায়, এক পরিবারে একটি গাড়ি হলেই চলছে, সেখানে একাধিক গাড়ি কিনে রাস্তায় নামাচ্ছে। এসব টাকার কুমিররা নিজেদের আরাম-আয়েশের জন্য জনগণের ভোগান্তি বাড়াচ্ছেন। যানজটের এ অবস্থার জন্য ওয়ার্ল্ড ট্রাফিক ইনডেক্স ২০১৯-এ প্রকাশিত তথ্যে আমরা আছি প্রথম অবস্থানে। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে কলকাতা। গত বছর ও তার আগের বছর এই অবস্থান ছিল যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয়। ২০১৫ সালে এই অবস্থান ছিল অষ্টম। আমরা খুব দ্রুতই নিজেদের জায়গা পরিবর্তন করেছি। এখন যেহেতু আমরা প্রথম অবস্থানে উঠে এসেছি, তাই অবনতি হলেও অবস্থান বদলাবে না। পরিস্থিতি যে খুব ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, তা বোঝার জন্য কোনো অবস্থান জানার দরকার হয় না। প্রতিদিনকার অবস্থা দেখলেই স্পষ্ট হওয়া যায়। ঢাকার রাস্তায় ব্যক্তি মালিকানাধীন গণপরিবহন, প্রাইভেট কার, মাইক্রো বাস, মোটরসাইকেলÑ এসব যানবাহন প্রতিদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঢাকা যেন থমকে আছে। এই অবস্থার উন্নতি না হলে কী হবে, তা সময়ই বলে দেবে। ঢাকার যানজট বৃদ্ধির জন্য বাস্তবিকপক্ষে পারস্পরিক কয়েকটি বিষয় দায়ী। যানবাহনের সংখ্যা যেমন লাফিয়ে লাফিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে, ঢাকার রাস্তার অবস্থা সেই আগের মতোই রয়ে গেছে। ট্রাফিক সিগন্যাল আর ১০টা সাধারণ আইনের মতোই মেনে চলার তেমন কোনো আগ্রহ নেই। তাই কয়েকবার ডিজিটাল ট্রাফিক সিগন্যাল চালু করেও সাফল্য পাওয় যায়নি। বাধ্য হয়েই ট্রাফিক পুলিশকে রাস্তায় কঠোর হতে হয়। লোকাল বাসগুলো সব সময় একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে চলেছে। উল্টোপথেও চলছে দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের গাড়ি। একবার জ্যাম তৈরি হলে তা আর যেন ছাড়ার নাম থাকে না। কারণ ততক্ষণে পেছনে শত শত গাড়ির বহর। ফলে খুব অল্প ভুলে এভাবে যানজট ভোগান্তি সৃষ্টি করছে।

যানজট নিরসনের জন্য ঢাকায় নির্মাণ করা হয়েছে কয়েকটি ফ্লাইওভার। কিন্তু এসব ফ্লাইওভার তৈরি করেও সমস্যা সেই গোড়াতেই থেকে গেছে। পরিস্থিতির খুব বেশি উন্নতি সাধন হয়নি। এখন ভরসা মেট্রোরেল চালুর। এতে যাত্রীর চাপ গণপরিবহনের ওপর কমবে। ফলে স্বস্তি ফিরবে আশা করি। শহরের ভেতরে গাড়ি চালানোর নিয়মকানুনের কোনো তোয়াক্কা করছেন না চালকরা। আর তোয়াক্কা করেই কী হবে! আইন না মেনেই যদি গাড়ি ইচ্ছামতো চালানো যায়; তা হলে আইন মানার দরকার থাকে না। ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ভেতর আনতে হবে। একটি ছোট পরিবারের জন্য একটি গাড়ি থাকতে হবে। সড়ক পরিবহন খাতের বিশৃঙ্খলা ফেরাতে হবে। স্বল্প দূরত্বে সাইকেলের মতো যানবাহন জনপ্রিয় করে তুলতে হবে। এতে একদিকে যেমন যানজটের মাত্রা কমানো যাবে; অন্যদিকে দূষণের মতো বিষয় থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে। প্রতি মাসে যে যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেসব গাড়ি রাখার মতো জায়গা ঢাকায় নেই। ইতোমধ্যেই এই শহরের ধারণক্ষমতার চেয়েও বেশি পরিমাণ যানবাহন চলাচল করে। বলাই বাহুল্য, এর বেশির ভাগই ব্যক্তিগত। কারো আরাম-আয়েশের জন্য প্রতিনিয়ত কষ্ট পেতে হয় পাবলিক বাসে যাতায়াত করা মানুষগুলোকে।

মূলত যানজট নিরসনের জন্য দেশের বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি পরিকল্পনা দরকার; যা ঢাকা শহরের মতো একটি সমস্যাপূর্ণ শহরের ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন দীর্ঘমেয়াদি হলেও তা যেন কার্যকরী হয়। এর মধ্যে কয়েকটি উদ্যোগ বা পরিকল্পনা আলোর মুখ দেখেনি। গোড়া থেকে সমস্যার সমাধান করতে হবে। কোনো সমস্যার আপাত সমাধান না করাই ভালো। এতে সমস্যা আরো বৃদ্ধি পায়। ঢাকার বর্তমান পরিস্থিতিতে বাস্তবিকপক্ষে যেকোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন বেশ কঠিন। কারণ এর সঙ্গে আইন মেনে চলার বিষয়টি জড়িত রয়েছে। আর আমাদের দেশে সাধারণ মানুষ বা চালক কেউ আইন মেনে চলতে ইচ্ছুক নই। বিশেষ করে যখন বড় বড় সরকারি কর্মকর্তার গাড়ি উল্টো পথে চলতে গিয়ে রাস্তার মাঝে ভজঘট অবস্থা তৈরি করে; তখন বেশ কষ্ট হয় এই ভেবে যে, যাদের সাধারণ চালকরা অনুকরণ করবে তারাই নিয়ম ভাঙছেন। সাধারণ মানুষ যখন-তখন গাড়ির সামনে দিয়ে পার হচ্ছেন। জীবনের ঝুঁকি আছে জেনেও সে তা করছে। তাকে বাঁচাতে গাড়ি থামতেই যানজট তৈরি হচ্ছে। তাই পাবলিকেরও কিছু কথা মাথায় রাখতে হবে। একজনের জন্য পেছনের গাড়িতে বসা হাজার হাজার মানুষের বিড়ম্বনার কারণ হওয়া যাবে না। হাত তুলে ইশারা করেই রাস্তার মাঝ দিয়ে দৌড় দিলেই সব শেষ হয় না। নিয়ম মানতে হয়। উন্নত দেশে সাধারণ জনগণ ট্রাফিক আইন মেনে চলে। যারা মানে না তাদেরও মানার ব্যবস্থা করে কর্তৃপক্ষ। এমনকি আপনি যেখানে-সেখানে আপনার থুথু ফেলতেও পারবেন না। তাতেও আপনার জরিমানা হবে। ফলে বাধ্য হয়েই সে আইন মানে। আমাদেরও সেই ব্যবস্থা করতে হবে। না মানলে মানাতে হবে। আর যারা এই কাজটি করবে, তাদের একই সঙ্গে কঠোর এবং সৎ হতে হবে। সাধারণ মানুষের বেলায় এক আইন আর কোনো হোমড়া-চোমড়া দেখলেই ছাড় পাবে, তা হবে না। সবাই সমানভাবে রাস্তায় চলবে। মোদ্দাকথা, প্রতিনিয়ত গাড়ির সংখ্যা এত দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে যে, অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা এই শহরের সঙ্গে তা অসামঞ্জস্যপূর্ণ। ঠিক যেভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেভাবেই যেন গাড়ির সংখ্যাও বেড়ে চলেছে। ফলে সমস্যার মূল কারণ চিহ্নিত করে ধীরে ধীরে তা সমাধান করতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close