নিতাই চন্দ্র রায়

  ২৮ জুন, ২০১৯

পর্যালোচনা

আম উৎপাদনে সফলতার শীর্ষে বাংলাদেশ

গত ১০ বছরে বাংলাদেশে আম চাষে ঘটে গেছে এক বিস্ময়কর বিপ্লব। উৎপাদন বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ। আজ থেকে ১০ বছর আগে দেশে আমের উৎপাদন ছিল ১২ লাখ ৫৫ হাজার টন। আর ২০১৮-১৯ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩ লাখ ৭২ হাজার টনে। আম উৎপাদন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে মাথাপিছু বার্ষিক ভোগের পরিমাণ। স্বাদে, গন্ধে ও পুষ্টিগুণে আম অতুলনীয়। তাই আমকে বলা হয় ফলের রাজা। আমের সঙ্গে বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও মহান মুক্তিযুদ্ধের রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন, পলাশীর আম্র কাননে বাংলা, বিহার ও ওড়িশার স্বাধীনতার যে সূর্য অস্তমিত হয়েছিল, স্বাধীনতার সেই সূর্য আবার উদিত হয় ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল, মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে।

দেশের ফল থেকে আসা পুষ্টি চাহিদার একটা বড় অংশের জোগান দেয় আম। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাবে গত ১৮ বছরে বাংলাদেশে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি হারে আমের চাষ বেড়েছে। বছরে ১৬ শতাংশ হারে ফলটির উৎপাদন বাড়ায় মাথাপিছু ভোগের পরিমাণ ১০ বছরে দ্বিগুণ হয়েছে। আজ থেকে ১০ বছর আগে বিশ্বে আম উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল দশম। আমের নতুন নতুন উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন, সারা দেশে চাষ সম্প্রসারণ, কৃষকের অক্লান্ত পরিশ্রম ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যহারের কারণে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ আম উৎপাদনে সপ্তম স্থানে উঠে এসেছে।

আগে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, দিনাজপুর, নাটোর, নওগাঁ, পাবনা, মেহেরপুর ও সাতক্ষীরার মতো কয়েকটি জেলাতেই আম চাষ সীমাবদ্ধ ছিল। আম্রপালি, বারিআম-৪ ও মল্লিকাÑ এসব উচ্চফলনশীল জাতগুলোর কারণে আঞ্চলিক সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে ফলের রাজা আম সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। স্থান করে নিয়েছে দেশের ৩০টি জেলায়। আম চাষ বিস্তৃতি লাভ করেছে দেশের উপকূলীয় দক্ষিণাঞ্চল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলে। বৃহত্তর সিলেট, ঢাকা ও ময়মনসিংহের লাল মাটি অঞ্চলেও হচ্ছে সুস্বাদু আমের চাষ। আম চাষের এ বিপ্লবের পেছনে যে জাতটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার পালন করে, তার নাম আম্রপালি ( বারিআম-৩)। বিদেশ থেকে জাতটি সংগ্রহ করে আমাদের দেশের জলবায়ুতে চাষ উপযোগিতা যাচাই করার পর ১৯৯৬ সালে সারা দেশে চাষের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়। এ জাতটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলোÑ প্রতি বছরই এ জাতের গাছে আম আসে। গাছের আকার মাঝারি। অল্প জমিতে অনেক বেশি চারা লাগানো যায়। চারা লাগানোর ৩ থেকে ৪ বছরের মধ্যেই ফল পাওয়া যায়। ফলের রং ও আকার আকর্ষণীয়। স্বাদ, গন্ধ ও পুষ্টিমাণ উৎকৃষ্ট। ফলের শাঁস গাঢ় কমলা রঙের। ফলের গড় ওজন ২০০ থেকে ২৫০ গ্রাম। মৌসুম শেষে আষাঢ়ের তৃতীয় সপ্তাহে ফল পাকে, যখন অন্যান্য জাতের আম শেষ হয়ে যায়। ফলে কৃষক এ জাতের আম অনেক বেশি দামে বিক্রি করার সুযোগ পান।

পুষ্টি ও ভেষজগুণে আমের সঙ্গে অন্য ফলের কোনো তুলনা নেই। কাঁচা আমে আছে প্রচুর ভিটামিন ‘সি’। ভিটামিন ‘সি’ ত্বককে মসৃণ করে। দাঁতের মাড়িকে মজবুত করে। সর্দি-কাশি থেকে রক্ষা করে। পাকা আমে পাওয়া যায় প্রচুর ভিটামিন ‘এ’। চোখের দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি ও রাতকানা রোগ নিরাময়ে যার কোনো জুড়ি নেই। আমের রয়েছে নানারকম ভেষজগুণ। পাকা আম কিডনি, পরিপাকতন্ত্র ও ত্বকের জন্য উপকারী। শরীরের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে আম বড় ধরনের ভূমিকা পালন করে।

রাজশাহী চেম্বার অব কমার্সের নেতারা বলেন, এবার চাঁপাইনবাগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ ও নাটোরÑ এ চার জেলায় ৬৭ হাজার হেক্টর আমবাগান থেকে ৮ থেকে ৯ লাখ টন আম উৎপাদিত হবে। আগামী চার মাস চলবে আম বাণিজ্য। এ বছর আমের দাম মোটামুটি সন্তোষজনক। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে এই চার জেলায় এবার কমপক্ষে ২ হাজার কোটি টাকার আম বিক্রি হবে। এ আম বাণিজ্যের সঙ্গে প্রায় ৫ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িত। আমপাড়া, প্যাকিং, পরিবহন, ঝুড়ি তৈরি, বেচাকেনা এবং দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা আম ব্যবসায়ীদের থাকা-খাওয়াসহ বিভিন্ন কাজে এই এলাকার বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে ফলের রাজা আম। অন্য এক সূত্র থেকে জানা যায়, এ বছর রংপুর জেলায় ৩ হাজার হেক্টর জমিতে আমবাগান রয়েছে। এর মধ্যে হাঁড়িভাঙা জাতের জমির পরিমাণ ১ হাজার ৪৫০ হেক্টর। এই পরিমাণ জমি থেকে এবার ১৫ হাজার টন আম উৎপাদিত হবে এবং শুধু হাঁড়িভাঙা জাতের আম বিক্রি করে ২০০ কোটি টাকা আয় করবেন এখানকার কৃষক।

আম উৎপাদনে আমের রাজধানী চাঁপাইনবাবগঞ্জকে পেছনে ফেলে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে বরেন্দ্র অঞ্চলের আর এক জেলা নওগাঁ। দেশের মোট উৎপাদিত আমের সিংহভাগই আসছে এখন নওগাঁ থেকে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সারা দেশে মোট আমের উৎপাদন ছিল ২৩ লাখ ৭২ হাজার টন। এর মধ্যে নওগাঁ থেকে আসে ৩ লাখ ৩৩ হাজার ৪৮৬ টন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আসে ২ লাখ ৭৫ হাজার এবং রাজশাহী থেকে আসে ২ লাখ ১৩ হাজার ৪২৬ টন। অথচ ২০১৬-১৭ অর্থবছরেও নওগাঁতে আমের উৎপাদন ছিল ১ লাখ ৬১ হাজার ৯১০ টন। সে বছর চাঁপাইনবাবগঞ্জে আম উৎপন্ন হয়েছে ২ লাখ ৪ হাজার টন আর রাজশাহীতে উৎপন্ন হয় ২ লাখ ৮ হাজার ৬৬৪ টন। জানা যায়, বরেন্দ্র অঞ্চলের একফসলি জমিতে ধান চাষের চেয়ে আম চাষই বেশি লাভজনক। সেখানে আমন মৌসুমে বিঘায় ১০ থেকে ১৪ মণ ধান পাওয়া যায়। খরচ বাদ দিয়ে ধান চাষে তেমন লাভ হয় না। এক বিঘা জমিতে ধান চাষ করে বছরে আয় হয় মাত্র ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা। অন্যদিকে এক বিঘা জমিতে ৩০টি আমগাছের চারা লাগানো যায়। চারা লাগানোর ৪ থেকে ৫ বছরের মধ্যে প্রতিটি গাছ থেকে দেড় থেকে দুই মণ আম পাওয়া যায়। সে হিসাবে প্রতি বিঘা জমির আমবাগান থেকে বছরে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকার আম বিক্রি করা যায়। এ কারণে প্রতি বছর নওগাঁ জেলায় গড়ে ২ হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে আমবাগান গড়ে উঠছে। এই জেলাতে ল্যাংড়া, ফজলি, নাগফজলি, ক্ষীরসাপাতি, মোহনভোগ, গোপালভোগ, আশ্বিনা, আম্রপালি, মল্লিকা, গৌড়মতি, বারি আম-৪ ও বারি আম-১১ জাতের চাষ হচ্ছে বেশি। অন্যান্য জাতের চেয়ে উৎপাদন ও দাম বেশি হওয়ায় কৃষক বর্তমানে আম্রপালি, বারিআম-৪ ও বারিআম-১১ চাষে ঝুঁকে পড়েছেন। আজ থেকে সাত বছর আগে নওগাঁ জেলায় মাত্র ৬ হাজার হেক্টর জমিতে আমের বাগান ছিল। সেখানে বর্তমানে প্রায় ২০ হাজার হেক্টর জমিতে আমবাগান গড়ে উঠেছে।

বাংলাদেশে উৎপাদিত আমের তুলনায় রফতানির পরিমাণ খুবই কম। সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, সাতক্ষীরা থেকে ২০১৭ সালে ৩১ দশমিক ৮৩ টন এবং ২০১৮ সালে ২৭ টন নিরাপদ ও বালাইনাশকমুক্ত আম ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রফতানি হয়। গত বছর ইসলাম এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড, এনআর ইন্টারন্যাশনাল, এনএইচ করপোরেশনসহ ১৪টি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান ফ্রান্স, ইতালি, যুক্তরাজ্য, স্পেনসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এসব আম রফতানি করে। ২০১৫ সাল থেকে কৃষকের সঙ্গে সাতক্ষীরায় আম রফতানিতে কাজ করে যাচ্ছে সলিডারিডাড। এ বছর যাতে আরো বেশি পরিমাণ বিষমুক্ত আম রফতানি করা যায়, সেজন্য বেশিসংখ্যক কৃষককে প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হয়।

ম্যাংগো ড্রিংকস, জুস ও ম্যাংগোবারসহ বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রী তৈরি করতে প্রতি বছরের ন্যায় এবারও আম সংগ্রহ ও পাল্পিং কার্যক্রম শুরু করেছে দেশের সর্ববৃহৎ কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণ প্রতিষ্ঠান প্রাণ। চলতি বছর ৬০ হাজার টন আম সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে প্রাণ গ্রুপ। প্রাণ কারখানায় ২৮ মে থেকে গুটি আম সংগ্রহ ও পাল্পিং কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে, যা চলবে জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত। এরপর আশ্বিনা আম থেকে পাল্প সংগ্রহ শুরু হবে। চলতি মৌসুমে নাটোর, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, দিনাজপুর, মেহরপুর এবং সাতক্ষীরা থেকে আম সংগ্রহ করবে প্রাণ। সংগ্রহের পর এসব আম পাল্পিংয়ের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হবে রাজশাহী ও নাটোরের কারখানায়। এ পাল্প থেকেই সারা বছর তৈরি করা হবে ম্যাংগো ড্রিংকস, জুস ও ম্যাংগো বারসহ বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রী। প্রাণের মতো দেশের আম উৎপাদনকারী বিভিন্ন এলাকা আরো আমকেন্দ্রিক শিল্প-কারখানা গড়ে উঠুক এবং উৎপাদিত পণ্য বিদেশে রফতানি হোকÑ এটাই আমচাষিদের প্রত্যাশা।

আমের অনিষ্টকারী পোকামাকড় ও রোগবালাই দমনের জন্য এ দেশে কৃষক মাত্রাতিরিক্ত বালাইনাশক ব্যবহার করেন। কখনো কখনো অপরিপক্ব আম পাকানোর জন্য মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর ক্যালসিয়াম কার্বাইড ব্যবহার করা হয়। আম রফতানি ও পরিভোগের ক্ষেত্রে এটি একটি বড় অন্তরায়। তাই নিরাপদ ও বিষমুক্ত আম উৎপাদনের জন্য আমাদেরকে রাসায়নিক বালাইনাশকের পরিবর্তে ফেরোমন ফাঁদ, হলুদ ফাঁদ ও ফ্রুটব্যাগিং পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে। ফ্রুটব্যাগিং পদ্ধতি ব্যবহারে একদিকে যেমন গুণগত মানের বিষমুক্ত ও রফতানিযোগ্য আম উৎপাদন করা যায়, অন্যদিকে আমের উৎপাদন খরচও হ্রাস পায়। এ ছাড়া ব্যাগিং করা আম সংগ্রহের ১০ থেকে ১৪ দিন পর্যন্ত ঘরে রেখে খাওয়া যায় এবং আমের রংও থাকে উজ্জ্বল- আকর্ষণীয়।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের ক্ষীরসাপাতি আম সম্প্রতি দেশের তৃতীয় জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায় এই আমে আলাদা স্টিকার ব্যবহার করা যাবে। ক্ষীরসাপাতি বিশেষ আমের জাত হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে বেশি দাম পাওয়া যাবে। জিআই সনদ অর্জনের ফলে দেশে ক্ষীরসাপাতি আম উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি আমকেন্দ্রিক অর্থনীতি জোরদার হবে এবং দেশ-বিদেশে এ আমের ব্যাপক চাহিদা ও বাণিজ্যিক সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে। আম চাষের ক্ষেত্রে এটা বাংলাদেশের জন্য এক বিশাল অর্জন ও গৌরবের বিষয়।

লেখক : সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি)

নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস লিমিটেড, নাটোর

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close