মো. কায়ছার আলী

  ২৭ জুন, ২০১৯

স্মরণ

তেভাগা আন্দোলন ও হাজী মোহাম্মদ দানেশ

শেরে বাংলা, বঙ্গবন্ধু, দেশবন্ধু, নেতাজী, ভাসানী, বিশ্বকবি, জাতীয় কবি, পল্লীকবি, নোবেলজয়ী, শিল্পাচার্য, জ্ঞানতাপসÑ এসব কারো নাম নয়। ব্যক্তির চেয়ে কীর্তি যখন বড় হয়, তখন নামের চেয়ে উপাধিটাই বড় হয়ে ওঠে। সেসময় নামে নয়, খেতাবেই তিনি সার্বজনীন হয়ে যান। একজন মানুষের নাম যা-ই থাকুক তিনি যে পদ-পদবিরই অধিকারী হন, সেটা ছাপিয়ে যখন তার বীরত্ব, কৃতিত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব, পদের গন্ডি ছাড়িয়ে যায়; তখন ওই জনপদের মানুষ তাকে বিশেষ বিশেষণে বা বিশেষ উপাধিতে ভূষিত করেন। সেসময় থেকে তিনি ওই বিশেষণে বা বিশেষ পদবিতেই পরিচিত হয়ে যান।

যিনি বড়, তিনি তার মহত্ত্ব, বড় কর্ম, বড় আত্মত্যাগের জন্য বড়। বড়কে বড় বলেই মেনে নিতে হয়। কালজয়ী, কীর্তিমানরা মেধা, যোগ্যতা ও কীর্তি দিয়ে ইতিহাস গড়েছেন। সেসব ইতিহাস গড়া মানুষের মধ্যে তেভাগা আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ত্যাগী রাজনীতিক হাজী মোহাম্মদ দানেশ। উত্তরবঙ্গই ছিল তেভাগা (তিন ভাগ জমির মালিক, কৃষক বা শ্রমিক এবং উৎপাদন খরচ) আন্দোলনের সূতিকাগার। উত্তরবঙ্গে এই আন্দোলনের উদ্ভব হওয়ার কারণ ছিল উত্তরবঙ্গ বরাবর জোতদার প্রধান তথা জোতদার শাসিত এলাকা, যারা এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং শত সহস্র বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে আন্দোলনকে সার্থকতার উদ্দিষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে নেওয়ার মরণপণ সংগ্রাম করেন; সেই নেতারা অধিকাংশই ছিলেন উত্তরবঙ্গবাসী। দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ, গুরুদাস তালুকদার, বরদা চক্রবর্তী, রূপনারায়ণ রায়, হেলেকেতু সিং প্রমুখ বিপ্লবী নেতারা ছিলেন আন্দোলনের স্বাপ্নিক রূপকার। এর মাঝে তেভাগা আন্দোলনের সর্বাধিক ত্যাগী ও তেজস্বী নেতারূপে হাজী মো. দানেশের নামটি ‘প্রবাদ পুরুষে’ পরিণত হয়। দুই কন্যা ও এক পুত্রসন্তানের জনক হাজী মোহাম্মদ দানেশ ১৯০০ সালের ২৭ জুন দিনাজপুর জেলার বোচাগঞ্জ থানার সুলতানপুর গ্রামে এক বড় জোতদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। নিজ গ্রামে শৈশবে লেখাপড়ার হাতেখড়ি হলে সেতাবগঞ্জ থেকে প্রবেশিকা, রাজশাহী কলেজ থেকে আইএ এবং বিএ পাস করেন। পরবর্তীতে ভারতের উত্তর প্রদেশে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে এমএ এবং আইনে বিএল ডিগ্রি লাভ করেন। ঠাকুরগাঁও আদালতে প্রথম উকিল হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে দিনাজপুর এস এন কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষকতা করেন। একপর্যায়ে দিনাজপুর জেলা আদালতে আইন ব্যবসা শুরু করেন।

কৃষক বর্গাচাষি, ভাগ চাষি, ক্রান্তি চাষিদের ওপর জমিদার ও জোতদারের সীমাহীন অত্যাচার দেখে শিশু বয়সে মোহাম্মদ দানেশের মানসিক চিন্তায় বিপ্লব ঘটে। তিনি ছাত্রজীবনেই কৃষকের ওপর অত্যাচারের প্রতিকারকল্পে কৃষক আন্দোলনে আকৃষ্ট হন। হাজী দানেশ ১৯৩৮ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিউনিস্ট পার্টির অঙ্গসংগঠন কৃষক সমিতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন এবং কৃষক আন্দোলন সংঘটিত করেন। তার নেতৃত্বে দিনাজপুর জেলায় টোল আদায় বন্ধ ও জমিদারি উচ্ছেদের দাবিতে কৃষক আন্দোলন জোরদার হয় এবং আন্দোলনকালে তিনি কারাভোগ করেন। নীলফামারী জেলার ডোমারে ১৯৪২ সালে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় কৃষক সম্মেলনে অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন হাজী দানেশ। সম্মেলনের পরপরই তিনি গ্রেফতার হন এবং দীর্ঘদিন কারাভোগ করেন। বর্গাচাষিদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে তিনি উত্তরবঙ্গে তেভাগা আন্দোলন সংঘটিত করেন। তেভাগা আন্দোলনের প্রস্তুতি পর্বে দাবি ছিল : ১. উৎপন্ন ফলের তিন ভাগের দুই ভাগ চাই। ২. জমিতে চাষির দখলস্বত্ব দিতে হবে। ৩. শতকরা সাড়ে ১২ ভাগের বেশি অর্থাৎ মণপ্রতি ধানের ৫ সেরের বেশি সুদ নেই। ৪. হরেক রকমের আবোয়ারসহ বাজে কোনো কর আদায় করা চলবে না। ৫. রসিদ ছাড়া কোনো আদায় নেই। ৬. আবাদযোগ্য সব পতিত জমি আবাদ করতে হবে। ৭. জোতদারের পরিবর্তে ভাগচাষিদের খোলানে ধান তুলতে হবে। তারা তিনটি সেøাগান নিয়ে এগিয়ে এসেছিল (ক) নিজ খোলানো ধান তোল। (খ) আধা নয় তেভাগা চাই। (গ) কর্জ ধানে সুদ নাই।

পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলা, তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার দুর্গাপুর থানার বাহের খালী গ্রামের রাসমনি, দিনাজপুরের কৌশলা কার্মায়নী, যশোদা রানী, ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈলের ভান্ডারিয়া, দিনাজপুরের ঠুমনিয়ার সুরমা সিং, সুকুর চাঁদ, নবাবগঞ্জের রামচন্দ্রপুরের জমিদারবাড়ির রাজবধূর নেতৃত্বে নাচোলের সাঁওতাল, মুড়িয়াল সর্দার, রাজবংশী মাহাতো হিন্দু-মুসলিম সব সম্প্রদায়ের বর্গাচাষিরা অস্তিত্বের প্রশ্নে একাত্ম হয়েছিলেন। এ আন্দোলন বিস্তার লাভ করে বেশির ভাগ ভাবপ্রবণ কোচ রাজবংশী ও সাঁওতাল আদিবাসীদের মধ্যে। তারাই ছিল বেশির ভাগ শোষিত ও বঞ্চিত সম্প্রদায়। নেতাদের উসকানিতে যখন থেকে জোতদারের সম্মতি ব্যতিরেকে কাটা ধানের পুঞ্জ জোতদারের খামারের পরিবর্তে আধিয়ারে নিজ নিজ বাড়ির উঠানে তুলতে শুরু হয় এবং মাড়াই ধান তিন ভাগ করে দুই ভাগ নিজের জন্য রেখে বাকি ভাগ জোতদারদের দিতে শুরু করে; তখনই জোতদার শ্রেণির কলিজায় আঘাত পড়ে। কিন্তু জোতদারদের পক্ষে কিছু করার উপায় ছিল না সমবেত ক্রুদ্ধ আধিয়ারগণের উত্থানের বিরুদ্ধে। তেভাগা আন্দোলনের ফলে ইংরেজ সরকার দলন নীতির পথে অগ্রসর হয়। রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার ৩০-৩৫ হাজারের মতো উত্তেজিত কৃষক শ্রমিক জনতার ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ দেয় ফলে কমপক্ষে ৩৫ জন নিহত এবং বহু মিছিলকারীর আহত হওয়ার মধ্য দিয়ে তেভাগা আন্দোলনের প্রথম সশস্ত্র বিপ্লবটি সংগঠিত হয়। ১৯৫০ সালে দ্বিতীয় বিপ্লব সংগঠিত হয়। সরকার তখন নাচোলের ১২টি গ্রাম আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে ফেলে। অসংখ্য রমণীকে বলাৎকার করে, গুলি করে হত্যা করে নির্বিচারে, ইলা মিত্র গ্রেফতার ও নির্যাতনের শিকার হন। ১৯৫০ সালে পূর্ববঙ্গ অধিগ্রহণ ও প্রজাতন্ত্র আইন প্রজাস্বত্ব আইন প্রণয়নে প্রভাব বিস্তার করেছিল তেভাগা আন্দোলন। আজীবন সংগ্রামী হাজী দানেশ জেল-জুলুম অত্যাচার সহ্য করে মোট ২৮ বছর কারাগারের অভ্যন্তরে থেকেছেন।

সব সময় দেশের মানুষের কথা চিন্তা করে গেছেন। কোনো ধরনের লোভ-লালসার ফাঁদে তিনি পা দেননি। তিনি তার বংশধরদের জন্য কিছুই রেখে যেতে পারেননি। কৃষকের স্বার্থের বিরুদ্ধে তিনি কোনো সময়ই আপস করেননি। তিনি সংসদ সদস্য হয়েও ট্রেনে তৃতীয় শ্রেণিতে যাতায়াত করতেন এবং সেভাবেই ভ্রমণ ভাতা গ্রহণ করতেন এবং ডেডিকেটেড রাজনৈতিক ব্যক্তি ছিলেন। যা মুসলমান নেতাদের অনেকের মধ্যেই দেখা যেত না। ১৯৩৮ থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত তিনি তোলাবাটি আন্দোলন, সুসংবদ্ধ আন্দোলন, গান্ডি আদায় বন্ধ আন্দোলন, ‘জাল যার জলা তার’ আন্দোলন করেন ও গ্রেফতার হন। ১৯৩৮ সালে তিনি কৃষক আন্দোলন সংগঠিত করেন। ১৯৪২ সালে তিনি বঙ্গীয় কৃষক সম্মেলনের অন্যতম উদ্যোক্তা এবং ১৯৪৫ সালে মুসলিম লীগে যোগদান করেন। তিনি ১৯৪৬ থেকে ১৯৪৭ সালের মাঝামাঝি বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ১৯টি জেলায় ৬০ লাখ বর্গাচাষি নিয়ে তিন ভাগের দুই ভাগ আদায়ের জন্য জমিদার ও জোতদারদের বিরুদ্ধে মুখোমুখি সংগ্রাম করেন। ১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগ থেকে বহিষ্কৃত হয়ে তিনি কারাভোগ করেন এবং ১৯৪৭ সালে মুক্তি লাভ করেন। ১৯৫২ সালে গণতন্ত্রী দল নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন এবং ওই দলের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৫৩ সালে গণতন্ত্রী দল যুক্তফ্রন্টে যোগ দিলে তিনি ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে দিনাজপুর জেলা থেকে পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। অতঃপর কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক ৯২-ক ধারা জারি করে পূর্ববঙ্গ যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে দিলে তিনি গ্রেফতার হন এবং ১৯৫৬ সালে মুক্তি লাভ করেন। ১৯৫৭ সালে গণতন্ত্রী দলের অস্তিত্ব বিলোপ করে তিনি ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত ন্যাপে যোগ দেন এবং সহসভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৫৮ সালে দেশে সামরিক আইন জারি হলে তিনি কারারুদ্ধ হন। ১৯৬৪ সালে ন্যাপের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৬৫ সালে পুনরায় দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে তিনি ন্যাপ থেকে পদত্যাগ করেন এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুজিবনগর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেন। তিনি ১৯৭৩ সালে ডিসেম্বর মাসে জাতীয় গণমুক্তি ইউনিয়ন নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। ১৯৭৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাকশালে যোগ দেন এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নিযুক্ত হন। অবিভক্ত ভারত বর্ষের কৃষক আন্দোলনে হাজী মোহাম্মদ দানেশ একটি শ্রদ্ধা মিশ্রিত নাম। ১৯৮৬ সালে ২৮ জুন ঢাকায় পিজি হাসপাতালে তিনি মুত্যুবরণ করেন।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close