রায়হান আহমেদ তপাদার

  ২৭ জুন, ২০১৯

বিশ্লেষণ

পরিবেশ সুরক্ষা ও টেকসই উন্নয়ন

বাংলাদেশ দরিদ্র দেশ। এ দেশের সম্পদের ভিত্তি নিম্ন, ভূমি-জন অনুপাত নিম্ন, সামাজিক শোষণ ও বঞ্চনার হার সর্বাধিক এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিপর্যয়ের অবস্থা আশঙ্কাজনক। জনগণের জীবিকা সম্পূর্ণরূপে প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভরশীল। কর্মসংস্থানের জন্য, রাজস্ব আয় ও বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের জন্য একমাত্র উৎস হচ্ছে প্রাকৃতিক সম্পদ। ৫০ শতাংশেরও বেশি লোকের জীবিকার প্রধান উৎস হচ্ছে কৃষি। কিন্তু কৃষি সেক্টর সম্পূর্ণরূপে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিপর্যয়ের হুমকির সম্মুখীন। কৃষির টেকসই উন্নয়নের জন্য কাক্সিক্ষত পরিবেশগত পরিকল্পনা অপরিহার্য। জীববৈচিত্র্য রক্ষার লক্ষ্যে গাছ কাটার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে বহুবার। এ আদেশবলে কোনোক্রমেই বনভূমি থেকে কোনো গাছ কাটা যাবে না। এমনকি ঝড়ের কবলে অথবা মড়কে আক্রান্ত হয়ে বনাঞ্চলে যেসব গাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়, সেগুলোও কেউ সংগ্রহে নিতে পারার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাংলাদেশে প্রায় ৪৪ লাখ হেক্টর জলাভূমি রয়েছে। অন্যতম বৃহৎ জলাধার চলনবিলের আয়তন আগের চেয়ে অনেক সংকুচিত হয়েছে। আবার দেশের বিভিন্ন স্থানের জলাধারগুলো বিভিন্ন সময় লিজ বা ইজারা দেওয়া হয়েছে, ফলে লাভের চেয়ে জলাধারগুলোর বৈশিষ্ট্য নষ্ট হয়েছে বেশি! ফলে উদ্ভিদ ও জলজপ্রাণীর বংশবৃদ্ধি ও বেঁচে থাকার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি দেশি মাছের বিচরণ ও প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস হয়েছে, বেড়েছে বিদেশি মাছের উৎপাদন। দেশের জলাভূমি রক্ষায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দফতর কাজ করলেও যতই দিন যাচ্ছে; ততই জলাভূমির সংখ্যা কমে যাচ্ছে! এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাজের মধ্যে সমন্বয় থাকা অত্যন্ত জরুরি।

এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের এই পরিবর্তনশীল বাস্তবতায় জলাধারগুলো রক্ষা করা এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয়, আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ে জলাভূমিগুলো সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনার কথা গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। দেখা যায়, জলাধার থেকে আয়-রোজগার কম হওয়ার কারণে অনেকে এগুলো ভরাট করে বিল্ডিং করে ঘর ভাড়া দিয়ে বেশি আয়ের চিন্তা করে থাকেন। এ ব্যাপারে জলাধারের উপকারিতা, গুরুত্ব ও অন্যান্য সুবিধার কথা সবাইকে বোঝাতে হবে। জলাধার থেকে ব্যক্তি, স্থানীয় জনগণ ও সরকার যাতে লাভবান হতে পারে এবং জলাধারও রক্ষা পায়Ñ এমন সব উদ্যোগের কথা ভাবতে হবে। যেমনÑ জলাধারগুলো ছোট ছোট পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা যেতে পারে। আবার এগুলোতে মাছ ধরার লাইসেন্স দিয়ে শৌখিন মানুষদের আকর্ষণ করা যেতে পারে। তাছাড়া দেশি-বিদেশি মাছ চাষের মাধ্যমে জলাধার থেকে লাভবান হওয়া যেতে পারে। ২০১০ সালে যখন ঢাকার ড্যাপ অর্থাৎ ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল, তখন ভাবা হয়েছিল ঢাকার চারপাশের জলাভূমিগুলো রক্ষা পাবে। কিন্তু অপরিকল্পিত নগরায়ণের চাপে একের পর এক জলাভূমি হারিয়ে গেছে এবং যাচ্ছে। রাজধানীতে একসময় প্রায় ২ হাজার পুকুর, ৫২টি খাল ও অসংখ্য ঝিল ছিল। কিন্তু এর বেশির ভাগই এখন আবাসনের চাহিদা মেটাতে নিচু জায়গা ভরাট করতে করতে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে এবং হচ্ছে। তথ্যমতে, শুধু ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকা থেকে বছরে প্রায় ৫ হাজার একর জলাভূমি হারিয়ে যাচ্ছে। আর এভাবে সারা দেশে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৪২ হাজার একর জলাধার ভরাট করা হচ্ছে। রাজধানী ঢাকা শহরে জলাভূমি ভরাটের বিরূপ প্রভাব পড়েছে।

এমনকি বেশির ভাগ খাল ও নিচু জায়গা ভরাট করে ফেলার ফলে এখন একটু বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতায় পড়তে হয় নগরবাসীকে। চারপাশের নদীগুলোর সঙ্গে খালগুলোর সংযোগ কাটা পড়েছে। ময়লা-আবর্জনায় ভরে গিয়ে খালগুলো যেন মশা তৈরির কারখানায় পরিণত হয়েছে! অথচ পরিকল্পনামাফিক উদ্যোগ গ্রহণ করলে খালগুলো হতে পারত বিনোদনের এক একটি ক্ষেত্র। একটি জলাধারকে যে কত সুন্দর, আকর্ষণীয় ও পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা যেতে পারে, তা ঢাকার ভেতরে হাতিরঝিলের মতো বিনোদনকেন্দ্রের দিকে তাকালে বোঝা যায়। বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নদ-নদী, খাল-বিল, পুকুর-ডোবা, হাওর-বাঁওড়সহ প্রাকৃতিক জলাধারগুলো এ দেশের প্রাণ। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে শহরে-গ্রামে এমন অনেক জলাভূমি হারিয়ে যাচ্ছে আবার এগুলো অনেকে নিজেদের খেলায়খুশিমতো ভরাট করছেন। জলাভূমিগুলো পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলের টিকে থাকার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর-ডোবা, হাওর-বাঁওড়ের অভাব নেই এ দেশে। তবে শুধু এগুলো সংরক্ষণ করার যথেষ্ট অভাব রয়েছে! গ্রাম, ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা ও শহর পর্যায়ে একের পর এক জলাভূমি ভরাট করা হচ্ছে। নগরায়ণের চাপেও জলাভূমিগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন-২০০০ অনুযায়ী কোনো পুকুর-জলাশয়, নদী-খাল ভরাট করা বে-আইনি। আবার বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-২০১০ অনুযায়ী জাতীয় অপরিহার্য স্বার্থ ছাড়া কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সরকারি বা আধা সরকারি, এমনকি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের বা ব্যক্তিমালিকানাধীন পুকুর বা জলাধার ভরাট করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

কিন্তু আইন অমান্য করে বহু প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান প্রাকৃতিক জলাভূমিগুলো ধ্বংস করে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছেন। এক তথ্যমতে, বিংশ শতাব্দী থেকে এখন পর্যন্ত বিশ্বের প্রায় ৬৩ শতাংশের বেশি জলাভূমি ধ্বংস করা হয়েছে। এর ফলে জলাভূমির ওপর নির্ভরশীল মানুষ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এ ছাড়া নদী, খাল, বিল, পুকুর ইত্যাদি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ব্যাপক ভূমিকা পালন করে থাকে। এ ছাড়া চারপাশের বাতাসকে শীতল রাখা, বর্ষা মৌসুমে বন্যা প্রতিরোধ, শহরে জলাবদ্ধতা নিরসন, পানির চাহিদা পূরণ ও আবর্জনা পরিশোধনে জলাভূমিগুলোর গুরুত্ব অনেক। শহরাঞ্চলে সুষ্ঠুভাবে বসবাসের জন্য ও নাগরিক জীবনকে বাসযোগ্য করার জন্য জলাভূমিগুলোর ভূমিকা রয়েছে। যদি জলাধারগুলো নষ্ট হয়ে যায় এবং শহরে বড় ধরনের অগ্নিকান্ড ঘটে; তা হলে তাৎক্ষণিকভাবে এক ফোঁটা পানিও কি পাওয়া যাবে! জলাভূমিগুলো তো নগরের তাৎক্ষণিক পানি সরবরাহের সবচেয়ে বড় উৎস। জলাভূমিকে কেন্দ্র করে বিনোদন কেন্দ্রের মধ্যে রয়েছে এ দেশের অনেক হাওর। টাঙ্গুয়ার হাওর, হাকালুকি হাওরসহ অনেক হাওর জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীসহ অর্থনৈতিক ক্ষেত্র হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। আবার অনেক হাওর বিভিন্ন কারণে ধ্বংসও হয়ে যাচ্ছে! পদ্মা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র নদের পার্শবর্তী বনভূমির অনেক জায়গায় বন্যানিয়ন্ত্রণ, নিষ্কাশন, বাঁধ, সেচ খালের ফলে অনেক জলাভূমি হারিয়ে গেছে। অনেক জলাভূমি বদ্ধ জলাশয়ে রূপ নিচ্ছে, কোনোটা আবার কৃষিজমিতে রূপান্তর করা হচ্ছে। দেশের সংবিধানের ১৮(ক) অনুচ্ছেদে জলাভূমি সংরক্ষণ ও দেখাশোনার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

কিন্তু জলাভূমির দেশ হিসেবে খ্যাত বাংলাদেশ থেকে একের পর এক জলাভূমি হারিয়ে যাওয়া মানে জেনে-বুঝে দেশের ক্ষতি ডেকে আনা। তাই জলাভূমি রক্ষায় প্রচলিত আইনের প্রয়োগ ঘটাতে হবে। জলাভূমিগুলো হারিয়ে যাওয়ার ফলে জলাভূমিনির্ভর প্রান্তিক মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। জলাভূমিগুলো আমাদের সম্পদ, জীববৈচিত্র্যের আধার। অপরদিকে ২০০২ সালে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে পলিথিন উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ নিষিদ্ধ করা হয়। সেখানে বলা হয়, সরকার নির্ধারিত পলিথিন সামগ্রী উৎপাদন, আমদানি ও বাজারজাতকরণে প্রথম অপরাধের দায়ে অনধিক দুই বছরের কারাদন্ড বা অনধিক ২ লাখ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন এবং পরিবেশ সংরক্ষণ সংশোধিত ২০১০ সালের আইনের ৭(১) ধারায় বলা আছে, কোনো ব্যক্তির কারণে পরিবেশ বা প্রতিবেশের ক্ষতি হলে সেই ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণপূর্বক তা পরিশোধ করতে হবে এবং সংশোধনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ বা উভয় প্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কেবল ঢাকা শহরে যদি এ অবস্থা হয়, তা হলে সারা দেশের চিত্রটি কেমন হবে? প্রতিদিন এ বিপুল পরিমাণ পলিথিনের স্থান হচ্ছে আমাদের নদ-নদী, খাল-বিল এবং মাটি বা জমি। জমিতে বছরের পর বছর পড়ে থেকে মাটির উর্বরতার সর্বনাশ করছে পলিথিন। কারণ মাটিতে পড়েই ধীরে ধীরে এর বিষাক্ত উপাদান মাটিতে ছড়াতে থাকে। আমাদের শিগগিরই পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। প্রায় দেড় যুগ আগে নিষিদ্ধ হলেও আজও পলিথিন আমাদের দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার করা হয়। পলিথিন ক্ষতিকর জানা সত্ত্বেও স্বেচ্ছায় আমরা তা ব্যবহার করি। আইনের প্রয়োগের শিথিলতা এবং আমাদের পরিবেশ রক্ষার প্রতি চরম উদাসীনতা পলিথিন নামের এ পরিবেশের বিষ আজও বহাল তবিয়তে টিকিয়ে রেখেছে।

বিজ্ঞানের অন্যান্য কল্যাণকর আবিষ্কারের মতোই পলিথিন আবিষ্কার ছিল একটি চমৎকার। কিন্তু অনেক আবিষ্কারের মতোই আজ পলিথিন আমাদের মানবসভ্যতাকেই হুমকির ভেতর ফেলেছে। পলিথিনের বিরূপ প্রভাব থেকে পরিবেশকে মুক্ত করার জন্য আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে। পলিথিনের ব্যবহার কমাতে আমাদের নিজেদেরও পরিবর্তন করতে হবে। যেহেতু আমরা এখন জানি যে, পলিথিন আমাদের নিজেদের জীবনব্যবস্থার জন্য হুমকি; তাই আমাদের উচিত হবে নিজে থেকেই পলিথিনের ব্যবহার কমিয়ে দিতে। অভ্যস্ত হতে হবে পাটের ব্যাগ, কাগজের ব্যাগ ইত্যাদির ওপর। কেবল আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর ওপর নির্ভর না করে নিজে থেকেই সচেতন হয়ে কাজটি করা যেতে পারে। পরিবেশ বাঁচাতে পলিথিনকে না বলার কোনো বিকল্প আমাদের হাতে নেই। নিজে সচেতন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্য সদস্যদের নিরুৎসাহিত করতে হবে পলিথিন ব্যবহারে। পলিথিন উৎপাদন এবং বাজারজাতকরণ যদি কঠোর হাতে দমন করা যায়, তা হলে এর ব্যবহার অনেকটাই কমে আসবে। সুতরাং শিল্পোন্নয়নের পাশাপাশি সৃষ্টি করতে হবে নতুন বনাঞ্চল। এ ব্যাপারে ব্যাপক জনসচেতনতা জাগিয়ে তুলতে হবে। উন্নয়নের সঙ্গে পরিবেশের রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। পরিবেশের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মানুষের বাঁচা-মরার প্রশ্ন। প্রতিকূল পরিবেশে মানুষ কেন, জীববৈচিত্র্যই অস্তিত্বহীন। দেশের বনাঞ্চলকে রক্ষা করেই উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। সারা বিশ্ব টেকসই উন্নয়ন নিয়ে উদ্বিগ্ন। আমরা জানি যে, সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যের অধীনে বিশ্বের নেতারা পরিবেশের টেকসই উন্নয়ন সুনিশ্চিত করার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close