সাধন সরকার

  ২৬ জুন, ২০১৯

পর্যবেক্ষণ

মৃত্যুর মুখে কপোতাক্ষ নদ

বাংলা সাহিত্যে অনন্য প্রতিভার অধিকারী মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের স্মৃতিবিজড়িত কপোতাক্ষ নদের এখন মরণদশা। মধুকবি বিদেশ বিভূঁইয়ে বসে এ নদের কথা ভেবে লিখেছিলেন, ‘সতত হে নদ, তুমি পড় মোর মনে /—- বহু দেশ দেখিয়াছি, বহু নদ দলে/ কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে?’ কপোতাক্ষ নদ যশোর, সাতক্ষীরা আর খুলনার ২০টিরও বেশি উপজেলা দিয়ে বয়ে গেছে। ব্রিটিশ আমলে এ নদটির দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ২৫০ কিলোমিটার। একসময়ের প্রমত্তা কপোতাক্ষ নদটি ৭৫০ মিটার পর্যন্ত প্রশস্ত ছিল। কিন্তু দখল, দূষণ আর ভরাটের কবলে পড়ে বর্তমানে কপোতাক্ষ নদটির দৈর্ঘ্য দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৮০ কিলোমিটার।

যশোর, সাতক্ষীরা আর খুলনার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া এ নদের অবস্থা এখন প্রাণহীন। কিন্তু একসময় এসব অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকার অন্যতম প্রধান উৎস ছিল এই কপোতাক্ষ। এ নদটি ছিল এ অঞ্চলের মানুষের আশা-ভরসা। এ নদ দিয়ে আশপাশের নদ-নদীর সঙ্গে নৌকা ও লঞ্চযোগে পণ্য আনা-নেওয়া করা হতো। এটি শুধু স্থানীয় জেলেদের জীবন-জীবিকার সঙ্গে জড়িত ছিল না, এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের অন্যতম ভিত্তিও ছিল এ কপোতাক্ষ। সময়ের ব্যবধানে নদটির দুইপাশ দখল করে গড়ে উঠেছে শত শত অবৈধ স্থাপনা। নদের ওপর দিয়ে কয়েক কিলোমিটার পরপর তৈরি করা হয়েছে স্থায়ী-অস্থায়ী সেতু। যশোরের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া নদের অংশে বিভিন্ন স্থানে বাঁশের পাটাতনের বেড়া দেওয়া হয়েছে। আবার এর কোনো কেনো অংশে কচুরিপানায় ভরে গেছে! এতে নদটির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ধীরে ধীরে এতে জমছে পলি। নদের কোনো কোনো স্থান বিভক্ত করে মাছের ঘের করাসহ ব্যাপকভাবে মাছ চাষ করা হচ্ছে। কেউবা আবার নদ দখল করে গড়ে তুলেছেন ঘরবাড়ি। কেউবা করছেন সবজির চাষ। নদ দখল করে কেউ বানিয়ে ফেলেছেন পুকুর। মোটকথা যে যেভাবে পারছেন নদকে দখল করছেন এবং এখনো নামে-বেনামে নদ দখল চলছে!

নদটির বেশির ভাগ অংশে পলি পড়ে চর পড়ে গেছে। ফলে নদটি মারাত্মকভাবে নাব্য সংকটে ভুগছে। গ্রীষ্মকালে নদের পানি শুকিয়ে গেলেও বর্ষাকালে নদের পানি ধারণক্ষমতা কমে যাওয়ায় তা আশপাশের বসতবাড়ি ও ফসলের খেত প্লাবিত করে। সাতক্ষীরার তালা উপজেলায় নদের বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ থেকেও মাটি লুট করা হচ্ছে। খুলনার পাইকগাছার মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া কপোতাক্ষ নদের কোনো কোনো অংশ ভাঙনের কবলে পড়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অনেক পরিবার। এখনো নদের ভাঙনের কবলে বিভিন্ন সময় কপোতাক্ষের দুই পাড়ের মানুষের দুঃখের অন্ত থাকে না। অনেক প্রতিষ্ঠান কপোতাক্ষের ভাঙনে বিলীনও হয়ে গেছে। এ ছাড়া নদের মধ্যে আবার ফেলা হচ্ছে বর্জ্য। এতে করে নদটি যেমন ভরাট হচ্ছে; তেমনি নদটি দূষিত হয়ে পড়ছে।

নদটি খনন করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে খনন করা মাটি নদটির দুই পাশে রাখার ফলে বর্ষার সময় সেই মাটি আবার নদে এসে পড়ছে। পূর্বপরিকল্পনা না থাকার ফলে এমনটি হচ্ছে। আবার চাহিদাভিত্তিক যেখানে খনন করার কথা, সেখানে খনন না করে অন্য স্থানে করা হচ্ছে। মূল কপোতাক্ষ নদটি ছিল অনেক প্রশস্ত। কিন্তু নদটি কম প্রশস্ত করে খনন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ফলে বর্তমানের কপোতাক্ষ নদ অনেক সরু হয়ে গেছে। কপোতাক্ষ একসময় এ অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকার অন্যতম প্রধান উৎস ছিল। পরিবহনে পণ্যের পাশাপাশি মানুষের যাতায়াতের জন্য ছিল লঞ্চ ও নৌযান। তাই যেকোনো মূল্যে এ নদের নাব্য সংকট দূর করাসহ দখল ও দূষণের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। বিশাল অঞ্চলব্যাপী বিস্তৃত এ নদকে মুমূর্ষু অবস্থা থেকে বাঁচাতে না পারলে তার বিরূপ প্রভাব এ অঞ্চলের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর পড়বে।

নদটি রক্ষাসহ স্থানীয় মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর নেতিবাচক ঠেকাতে নদটি পরিকল্পিত খননের ওপর জোর দিতে হবে। এককথায়, কপোতাক্ষ এ অঞ্চলের পরিবেশ-প্রতিবেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। নদের ওপর দখল-দূষণ চলতে থাকলে তার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব হবে মারাত্মক। সবার আগে নদ-তীরবর্তী মানুষের নদ বিধ্বংসী কার্যকলাপ বন্ধ করতে হবে। এ ব্যাপারে নদ রক্ষা ও এর উপকারিতার কথা নদতীরবর্তী মানুষের সচেতনতা রক্ষায় কাজে লাগাতে হবে। সর্বোপরি নদটির হারানো যৌবন ফিরিয়ে আনতে সবার ইতিবাচক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এ ছাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নদ রক্ষার ব্যাপারে আরো বেশি আন্তরিক হতে হবে।

লেখক : পরিবেশ কর্মী ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close