এস এম মুকুল

  ২৬ জুন, ২০১৯

মুক্তমত

নীতিবানের মর্যাদায় দুর্নীতি কমবে

বঙ্গবন্ধু ঠিকই বলেছিলেনÑ যত লোভ-লালসা আর ভোগবিলাসের সবকিছু যেন শিক্ষিত মানুষের মাঝেই বেশি। স্বাধীনতা অর্জনের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গঠনে বহুমুখী কার্যক্রম শুরু করেও বঙ্গবন্ধু পদে পদে বাধাগ্রস্ত হন। তারপর শুরু করেন স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার দ্বিতীয় মিশন। তাই তিনি উৎপাদন বৃদ্ধি, দুর্নীতি উৎখাত ও আত্মশুদ্ধির নির্দেশনা দেন জাতিকে। শিক্ষিত সমাজের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘শিক্ষিত সমাজের কাছে আমার একটা কথাÑ আমরা শতকরা কতজন শিক্ষিত লোক? আমরা শতকরা ২০ জন শিক্ষিত লোক। তার মধ্যে সত্যিকার অর্থে আমরা শতকরা ৫ জন শিক্ষিত। আপনাদের কাছে আমার একটা প্রশ্নÑ আমি এই যে দুর্নীতির কথা বললাম, এসব কারা করে? আমার কৃষক দুর্নীতিবাজ? না। আমার শ্রমিক দুর্নীতিবাজ? না। তা হলে ঘুষ খায় কারা? ব্ল্যাক মার্কেটিং কারা করে? বিদেশে টাকা চালান দেয় কারা? এই আমরা যারা ৫ ভাগ শিক্ষিত। এই আমাদের মধ্যেই রয়েছে ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ। আমাদের চরিত্রের সংশোধন করতে হবে। আত্মশুদ্ধি করতে হবে।’

স্বাধীনতার ৪৮ বছরে বাংলাদেশ অনেকদূর এগিয়েছে। দুর্নীতি না হলে এই দেশ আরো ২০ বছর আগে মালয়েশিয়ার মতো দেশে উন্নীত হতো। দেশে যে পরিমাণ বৈদেশিক সাহায্য আসে সরকারিভাবে সেগুলো জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কথা। এনজিওরা যে সাহায্য পায়, দেশের গরিব জনগণের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামোর উন্নয়নে ব্যয় হওয়ার কথা। উঁচুস্তর থেকে নিচুস্তরে ভাগ-বাটোয়ারা করে প্রায় ৭৫ শতাংশ খেয়ে ফেলেন দায়িত্বপ্রাপ্তরা। বাদ বাকি ২৫ শতাংশ নিয়ে টানাহেঁচড়া করে জনগণ; যা পায় তা দিয়ে কাজের কাজ কিছুই হয় না। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, এসব সাহায্যের ২৫-৩৫ ভাগ যদি যথাযথ স্থানে পৌঁছানো হতো, তা হলে দেশের চেহারা ১০ বছরে পাল্টে যাবে। কিন্তু যুগ যুগ ধরে সাহায্য আসছে আর ভোগবাদীরা খেয়ে-পড়ে যা থাকে তার ছিটেফোঁটা পাচ্ছে আমজনতা। এই দুর্নীতি কবে বন্ধ হবে?

দুর্নীতি না হলে কেমন হতো বাংলাদেশ? রেলে দুর্নীতি না হলে রেল যোগাযোগ হতো গণমুখী নিরাপদ পরিবহন। বিদ্যুৎ, ওয়াসায় দুর্নীতি না হলে আমরা গ্যাস ও বিদ্যুৎ পেতাম ঠিকঠাকমতো। মন্ত্রী, এমপিসহ জনপ্রতিনিধিরা দুর্নীতিবাজ না হলে অথবা তারা দুর্নীতিবাজদের প্রশ্রয় না দিলে এ দেশের রাস্তাঘাট আরো কত উন্নত থাকত সহজেই ভাবা যায়। রোড, ব্রিজ, কালভার্টে ভরপুর থাকত বাংলাদেশ। ঢাকার ফ্লাইওভারগুলো সবচেয়ে কম সময়ে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে দুর্নীতি না হওয়ার কারণেই। দুর্নীতি না হলে সারা জীবন চাকরির সম্বল পেনশনের টাকা তুলতে ফাইল আটকে থাকত না। নিয়োগে দুর্নীতি না হলে সহজে চাকরি পেত নাগরিকরা। নীতিবান মানুষের মর্যাদা সমাজে উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত হলে দুর্নীতির প্রবণতা কমে যেত।

প্রতি বছর দুর্নীতিবাজদের একটা তালিকা প্রকাশ করা দরকার। দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিদের তালিকা প্রকাশ করা দরকার। সামাজিকভাবে তাদেরকে বয়কট করা, ধিক্কার দেওয়া দরকার। বছরের পয়লা তারিখে সারা বছরের সালতামামি প্রকাশিত হয়। সারা বছরের দুর্নীতিবাজদের একটা তালিকা প্রকাশ করলে দেখা যাবে সমাজের মানুষ এদের ধিক্কার দিতে শুরু করেছে। সামাজিকভাবে ব্যক্তি ও পরিবারের এসব দুর্নীতিবাজরা ধিকৃত হবে। সন্তান যখন পিতাকে প্রশ্ন করবে; তখনই তার চারিত্রিক সংশোধনের বাধ্যকতা তৈরি হবে। একই সঙ্গে নীতিবানের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হলেও কমবে দুর্নীতির প্রবণতা।

লোকে বলে এ দেশের সমৃদ্ধির বারো আনাই খেয়ে ফেলে দুর্নীতি। সরকারি কাজে দুর্নীতির ঠেলায় সুনীতি বা নীতিবানদের চরম দুর্দশার শেষ নেই। বেসরকারি খাতেও এ রোগ ছড়িয়ে গেছে ক্যানসারের মতো। আমাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, স্বেচ্ছাচারিতা আর ক্ষমতার অপব্যবহারে কুলষিত হয়ে দেশ দুর্নীতির ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। নীতিভ্রষ্টতা রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে ছড়িয়ে গেছে সর্বসাধারণের মাঝে। ফলে ধ্বংস হয়েছে সব প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে চলছে নিয়ম ভাঙার মহোৎসব। আমাদের জনপ্রতিনিধিরা হরিণ পুষেন মনের সুখে। চড়েন দামি গাড়িতে, থাকেন আলিসান বাড়ি করে। আর ব্যাংকের টাকার কথা কী বলব? তার পরও তাদের ক্ষুধা মেটে না। সাতপুরুষ বসে খাওয়ার মতো সম্পদ ভোগদখল করে থাকলেও লোভ সামলাতে পারেন না তারা। যার ফলে বন খায়, ধন খায়, হাওর-বিল-খাল ও নদী খায়। খাওয়ার লিপ্সার যেন শেষ নেই।

একটি দারিদ্র্যপীড়িত দেশে ব্যাংক থেকে ঋণের নামে যথেচ্ছাভাবে অর্থ লুটপাট হয়। ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে টাকা ফেরত না দেওয়াটা একটা দম্ভের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থমন্ত্রী এক বিবৃতিতে বলেন, দেশে ঋণখেলাপির সংখ্যা ১ লাখ ২৮ হাজারের বেশি। জনগণের টাকা নিয়ে বাড়ি-গাড়ি, বিত্তবৈভবে আয়েশি জীবন কাটাচ্ছেন ঋণখেলাপিরা। ১ লাখ ২৮ হাজার খেলাপির ঋণের পরিমাণ কত হতে পারে? এক-দুটি পদ্মা সেতুর জন্য আমাদেরকে দাতাগোষ্ঠীর কাছে মাথা নত করার দরকার আছে? এসব ঋণখেলাপি রাজনৈতিক মদদ পেয়ে দেশের জনগণের টাকা নিয়ে নিজেরদের আখের গোছায়। তাদেরকে বিচার প্রক্রিয়ার মুখোমুখি হতে হয় না বলেই দুর্নীতি কমে না। দুর্নীতি আর লুটেরা বাণিজ্যের মাধ্যমে দেশের একশ্রেণির কিছু মানুষের কাছে চলে গেছে সব টাকা। তারা দেশে সাত পুরুষের ভোগবিলাসের অঢেল সম্পদ রেখেও তৃপ্ত নন। দুর্নীতির অভিযানে ধরা খেয়ে মারা পড়ার ভয়ে বিদেশ বিভূঁইয়ে গড়ে তুলছেন বাড়ি ও ব্যবসাপাতি।

দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে গোটা বাংলাদেশ। অফিসের কেরানি থেকে বিগবস, বিদ্যুৎ বিভাগ, শিক্ষা বিভাগ, ওয়াসা, ভূমি অফিস থেকে শুরু করে সব দফতদর, অধিদফতর, প্রশাসকি অফিস, সচিবালয় থেকে ইউনিয়ন কাউন্সিলর পর্যন্ত দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। কোনো কোনো অফিসের চেয়ার-টেবিল পর্যন্ত নাকি ঘুষ খায়Ñ এমন কথারও প্রচলন আছে। আমাদের মন্ত্রী-এমপি, তাদের পুত্র, প্রধানমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর পুত্র, উপদেষ্টা মহাশয়রা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত সব পেশার মানুষ। তার পরও কি সৎ মানুষ নেই! সংখ্যাধিক্যে সৎ-নিষ্ঠাবান মানুষই বেশি। কিন্তু অসৎ, দুর্নীতিবাজদের দাপটে তারা কোণঠাসা।

প্রকাশিত এক খবরে জানা যায়, বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের অঢেল গোপন অর্থ আছে ক্যারিবীয় অঞ্চলের ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডসে। বলা হয়েছে, ওই দ্বীপাঞ্চলে বাংলাদেশের কমপক্ষে ২০ জন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ও প্রভাবশালী রাজনীতিকের নাম আছে। রিপোর্টে বলা হয়, সেখানে সারা বিশ্বের ব্যবসায়ী, পুঁজিপতিরা নিজ দেশে কর ফাঁকি ও দুর্নীতির টাকা লগ্নি করছেন। সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্ইুস ন্যাশনাল ব্যাংক প্রকাশিত ‘ব্যাংক ইন সুইজার ল্যান্ড ২০১২‘ প্রতিবেদনে জানা যায়, সুইস ব্যাংকগুলোয় বাংলাদেশিদের অন্তত ২২ কোটি ৯০ লাখ সুইস ফ্রাঁ, যা বাংলাদেশি টাকায় ১ হাজার ৯০৮ আট কোটি টাকার সমান সুইস ফ্রাঁ জমা আছে। আরেক খবরে জানা গেছে, মালয়েশিয়া সরকারের মাই সেকেন্ড হোম প্রোগ্রামের আওতায় এ পর্যন্ত নিজ উদ্যোগে প্লট-ফ্ল্যাট কিনেছেন সাত হাজার বাংলাদেশি। অভিযোগ আছে, হুন্ডির মাধ্যমে এসব ব্যক্তি ১০ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছেন।

দুর্নীতি ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধে আমাদের কিছু করা দরকার। কারণ এ দুর্নীতি আর সামাজিক অবক্ষয়ই বাংলাদেশের উন্নয়নের পথে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান এক বিবৃতিতে বলেছেন, ৫০০ জন দুর্নীতিবাজকে জেলে পুরতে পারলে নিজেকে সফল ভাবতাম। প্রতি বছর অন্তত ১০০ জন দুর্নীতিবাজকে সাজা দেওয়া গেলে সমাজে বড় ধরনের প্রভাব পড়ত। আচ্ছা, দুদক তো পারত বছরে ১০০ জন দুর্নীতিবাজের শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে। কেন হয় না, কারণ আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাচ্ছেন না। আদর্শের রাজনীতি যত দিন প্রতিষ্ঠিত না হবে; তত দিন পুলিশের দুর্নীতি থামানো যাবে না। কারণ পুলিশ তো রাজনীতিবিদদের হাতিয়ার। অতএব এ অবস্থা থেকে বাঁচতে হলে দুর্নীতিকে না বলার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। তরুণ প্রজন্মের মাঝে এ চেতনা জাগিয়ে তুলতে হবে। অনেকে বলেন, এর প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা হিসেবে শিক্ষার্থীদের দুর্নীতিকে না বলার শিক্ষা দিতে হবে। কিন্তু কারা দেবেন সে শিক্ষা? শিক্ষক? শিক্ষকরাই তো এখন দলবাজি আর নৈতিকতা বিমুখ হয়ে টাকার পেছনে দৌড়াচ্ছেন। তার পরও সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। কারণ সমাজে ও দেশে অস্থিরতা এবং অবৈধভাবে সম্পদশালী হওয়ার যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে, এ অবস্থার পরিবর্তন আনতেই হবে। সে জন্য রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন সবার আগে জরুরি। সব পেশার ক্ষেত্রে পেশাগত সততা প্রদর্শন খুবই জরুরি। দেশের প্রতি ভালোবাসা, পরিবারের প্রতি ভালোবাসার মনোজগৎ তৈরি করা জরুরি। ধর্মীয় মূল্যবোধ জাগ্রত হওয়া জরুরি। আসুন আমরা সবাই মিলে দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি।

লেখক : উন্নয়ন গবেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close