রায়হান আহমেদ তপাদার

  ২৬ জুন, ২০১৯

বিশ্লেষণ

উন্নয়ন প্রশ্নে কৃষকদের মূল্যায়ন জরুরি

আমাদের দেশ কৃষিপ্রধান হলেও এখানকার পানি সেচব্যবস্থা তেমন উন্নত নয়। দেশের আবাদযোগ্য জমির যে সামান্য অংশে পানি সেচের ব্যবস্থা রয়েছে তার অধিকাংশই প্রাচীন পদ্ধতির আওতাধীন। এ ছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন এবং বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড সেচের ব্যাপারে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করায় দেশে কিছু কিছু আধুনিক পানি সেচ পদ্ধতি গড়ে উঠেছে। কৃষি ফসল উৎপাদনে আমরা প্রকৃতিনির্ভর। তবে বিভিন্ন সময়ে সেচব্যবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার বহুমুখী সেচ প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এ প্রকল্পগুলোর অনেক ক্ষেত্রেই পানি সেচ, বন্যানিয়ন্ত্রণ এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। রাসায়নভিত্তিক কৃষিব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে, টেকসই ও ঝুঁকিমুক্ত কৃষিব্যবস্থা নিশ্চিত করতে কৃষকদের জৈব কৃষিব্যবস্থায় ফিরে আসতে হবে। তবে এ দেশের কৃষি খাতকে টেকসই ও ঝুঁকিমুক্ত রাখার ক্ষেত্রে সরকার সত্যি সত্যিই উদ্যোগী হলে এ দেশের সব কৃষি কর্মকর্তাকে ৬৮ হাজার গ্রামের কৃষকদের দোরগোড়ায় পাঠাতে হবে। সরকারকে কড়া নজরদারি রাখতে হবে।

পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি মানুষ খাদ্যশস্য হিসেবে চালের ওপর নির্ভরশীল। চাল বাংলাদেশেরও প্রধান খাদ্যশস্য। চালে রয়েছে শ্বেতসার, প্রোটিন, ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ। কিন্তু অজ্ঞতাবশত চালের দানাকে অতিরিক্ত মসৃণ করার কারণে এর পুষ্টিমান কমে যাচ্ছে। বস্তুত অধিক মুনাফার আশায় চালকে মসৃণ করে চালকল মালিকরা এর পুষ্টিমান যেমন নষ্ট করছেন, তেমনি সম্প্রতি ধানের বিভিন্ন রোগবালাই ধান উৎপাদনে কৃষকদের মাঝে সৃষ্টি করেছে হতাশা।

দরিদ্র কৃষক টাকার অভাবে মান্ধাতার আমলের কঙ্কালসার গরু আর নড়বড়ে কাঠের লাঙলের সাহায্যে জমি চাষ করেন। চাষিরা বীজতলায় বীজ বপন থেকে শুরু করে ফুল আসা পর্যন্ত শ্রম ও মূলধন খাটিয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে কাক্সিক্ষত ফসল ঘরে তোলার জন্য। ধানগাছে ফুল আসার সঙ্গে সঙ্গে কত স্বপ্ন, কত আশা জন্ম নেয় কৃষকের মনে। এ বছর সারা দেশে উচ্চফলনশীল জাতের বোরো ধানের আবাদ তুলনামূলক বেশি হলেও ধানগাছের মূল শিষ ও শাখা শিষগুলো যখন ফুলে পরিপূর্ণ, ফুলগুলো দানায় পূর্ণ হয়ে শিষগুলো নিচের দিকে ঝুঁকে পড়ছে, ঠিক এমন সময় হঠাৎ করে ধানখেতে দেখা দেয় একধরনের রোগ, যা শ্রীপুরের কৃষকদের ভয়াবহ আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রাথমিক অবস্থায় দু-একটি ধানের শিষ সাদা হয়ে গেলেও অতিদ্রুত তা সব আবাদি জমিতে ছড়িয়ে পড়ে। দূর থেকে তাকালে মনে হবে ধান পেকে রয়েছে; কিন্তু একটি দানাও নেই কোনো শিষের মধ্যে। চট্টগ্রামের মানুষ এমনিতেই অর্থনৈতিকভাবে অন্যান্য জেলার মানুষের চেয়ে অধিক সচ্ছল। এ ছাড়া চট্টগ্রামের অনেক এলাকায় স্থানীয় দিনমজুর পাওয়াও কঠিন। রাউজানে দিনমজুর, রিকশাচালক হিসেবে উত্তরবঙ্গের বিশেষ করে রংপুর, দিনাজপুর, কুড়িগ্রামের লোক কাজ করেন। বর্তমানে এদের পারিশ্রমিক অনেক বেশি। এত বেশি পারিশ্রমিক দিয়ে জমিতে কাজ করিয়ে একজন কৃষক যে ধান উৎপাদন করেন, বিক্রি করে তিনি লাভ করা তো দূরের কথা অনেক সময় উৎপাদন ব্যয়ও তুলতে পারেন না। ধানের দাম কম অন্যদিকে কৃষিশ্রমিকের মজুরি বেশি।

লক্ষ্মীপুর জেলাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় একই অবস্থা। দুই মণ ধানে এক কেজি ইলিশ কিনতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় কৃষক। এ বছর লক্ষ্মীপুর জেলায়ও বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। কৃষিজাত পণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এ বছর চাল রফতানির জন্য সরকারের কাছে আবেদনও করেছে রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান। ধান ছাড়াও মাছ, সবজি, ফল, ফার্মের মুরগি ও গরু-ছাগল উৎপাদনেও আশাতীত সাফল্য অর্জন করেছে দেশ। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের আগে-পরে এ দেশের জনসংখ্যা ছিল ৭ থেকে ৮ কোটি। তার পাশাপাশি দেশে তখন আবাদি জমির পরিমাণ ছিল বর্তমান সময়ের চেয়ে ৩৫ শতাংশ বেশি। তার পরও দেশের খাদ্য উৎপাদন মোট চাহিদা পূরণ করতে পারত না। খাদ্য আমদানিকারক দেশের শীর্ষে ছিল বাংলাদেশের নাম। তখন দেশের অনেক জেলায় মঙ্গা। বেশ কয়েক মাস দেশজুড়ে থাকত প্রবল খাদ্যাভাব। ধীরে ধীরে সে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানে জনসংখ্যা ১৬ কোটির অধিক। নদীভাঙন, নগরায়ণ, শিল্পায়ন, বাণিজ্যিক ও আবাসিক ভবন নির্মাণের কারণে আবাদি জমির পরিমাণ অন্তত ৩৫ শতাংশ কমেছে। তার পরও দেশ ধান উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এমনকি বিদেশে রফতানির কথাও ভাবছে। বর্তমান শেখ হাসিনার সরকার শুরু থেকেই কৃষি ও কৃষকবান্ধব সরকার। কৃষি উৎপাদন বাড়াতে শেখ হাসিনার সরকার সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে। কৃষকদের জন্য সার-কীটনাশক ও সেচের ব্যবস্থা করেছে। ১০ টাকায় কৃষকদের ব্যাংক হিসাব খোলার সুযোগ করে দিয়েছে সরকার, সে হিসাবে সরকারের ভর্তুকির টাকা পৌঁছে যায়। তাছাড়া কৃষি মন্ত্রণালয়ের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় দেশে কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে ধান উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য কৃষিজাত পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ছাড়া কৃষিজাত অন্যান্য পণ্য নিয়ে বিপাকে না পড়লেও কৃষক ধানের ব্যাপক উৎপাদন নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। সরবরাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় দাম কমে গেছে ধানের। এ বিষয়টি সরকারকেও বেশ বেকায়দায় ফেলেছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রধান খাদ্য চালের দাম বাড়তে দেয় না সরকার। অন্যদিকে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে গিয়ে চালের প্রকৃত দাম পাচ্ছেন না কৃষক। এ পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার প্রতি বছর নির্ধারিত দামে ধান-চাল ক্রয় করে কৃষকদের কাছ থেকে। এ লক্ষ্যে প্রতি উপজেলায় গড়ে তোলা হয়েছে সরকারি ক্রয়কেন্দ্র। বর্তমান পরিস্থিতি দেখে কৃষি অধিদফতরের কর্মকর্তারা সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, সরকারিভাবে ধান-চাল কেনা শুরু হলে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হবে। কিন্তু কৃষকের অভিজ্ঞতা সেক্ষেত্রে ভিন্ন। অধিকাংশ সরকারি ক্রয়কেন্দ্র এবং এর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে স্থানীয় কৃষকদের বিস্তর অভিযোগ আছে। কৃষক অভিযোগ করে বলেন, ফড়িয়া বা মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে তারা সরাসরি ক্রয়কেন্দ্রে ধান-চাল বিক্রি করতে পারেন না। একটা চক্র সব সময় ক্রয়কেন্দ্রগুলোতে সক্রিয় থাকে। যা হোক, ধানের দাম ও অভাব এবং ধান উৎপাদনে কৃষকের অনীহা ইত্যাদি বিষয় হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। মনে রাখতে হবে, এই কৃষকই ১৬-১৭ কোটি মানুষের মুখে ভাতের সংস্থান করে দিচ্ছেন। অনন্ত খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে দেশের ভাবমূর্তি বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকারের মনোবলও শক্ত হয়েছে। তা না হলে রফতানিকারক দেশগুলোর মর্জির ওপর আমাদের নির্ভর করতে হতো। সে অভিজ্ঞতা কখনো সুখের ও সম্মানের নয়। সরকার তৈরি পোশাক শিল্প মালিক, শিল্প-কারখানার মালিক এবং ঋণখেলাপিদের জন্য অনেক সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে আসছে। এবার দেশের কৃষক বাঁচাতে, খাদ্য উৎপাদন অব্যাহত রাখতে, খাদ্যে পরনির্ভরশীলতা কমাতে কৃষকের স্বার্থ সংরক্ষণে এগিয়ে আসুক। আমাদের দেশ এখনো কৃষিপ্রধান দেশ। ফলে সব কিছুর আগে কৃষি ব্যবস্থাপনা অগ্রাধিকার পাক। আগে অন্নের চিন্তা, পরে অন্য কিছু। যে অন্নের সংস্থান করে দিচ্ছেন তার ভালো-মন্দ ভাবতে হবে আগে। যে কৃষক এক দিনের জন্যও কোনো হরতাল-ধর্মঘট করেননি, এক ঘণ্টার জন্যও কখনো কর্মবিরতি করেননি, রোদে পুড়ে, জলে ভিজে, নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়েও খাদ্য উৎপাদন বন্ধ করেননি, এখন সময় এসেছে তাদের কথা ভাবার। তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা দেওয়ার।

আমাদের দেশের কিংবা একেবারেই অক্ষরজ্ঞানহীন হতদরিদ্র কৃষকের পক্ষে জেলা কিংবা উপজেলা সদরে গিয়ে কৃষি অফিস থেকে আধুনিক কৃষি তথ্য সংগ্রহ করা একেবারেই সম্ভব নয়। সুতরাং কৃষি কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরই কৃষকের দোরগোড়ায় যেতে হবে দেশের কৃষি খাতকে টেকসই ও ঝুঁকিমুক্ত রাখার বৃহৎ স্বার্থেই। অবশ্য এ ক্ষেত্রে আমাদের ইউনিয়ন পরিষদগুলোও অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। আর সে লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার এ স্তরে (ইউপি) যুগের চাহিদানুসারে নতুনত্ব আনয়ন করা জরুরি। দেশের প্রতিটি ইউনিয়নের ওয়ার্ড প্রতিনিধিকে যদি স্থানীয় কৃষকের কৃষি সমস্যা সমাধানের বাড়তি দায়িত্ব দেওয়ার ব্যবস্থা সরকার থেকেই করা হয়; তা হলে দেশের কৃষি খাত অনেকটাই যে উপকৃত হবে, সে ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ থাকে না।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close