রায়হান আহমেদ তপাদার

  ২১ জুন, ২০১৯

মুক্তমত

বাজেট : জাতীয় উন্নয়নের দর্শন

যেকোনো দেশের ক্ষেত্রে বাজেট হচ্ছে ব্যক্তি, সমাজ, দেশ ও জাতীয় উন্নয়নের দর্শন। বিশেষ করে আমাদের মতো পোড় খাওয়া অর্থনীতির দেশে। বাজেট যেহেতু সরকারের, রাষ্ট্র পরিচালনা, উন্নয়ন কর্মকান্ডের দিকনির্দেশন, তাই এর গুরুত্ব সর্বাধিক। বাজেটের গতিপ্রকৃতি ভালো-মন্দ দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়। তবে এ আলোচনায় অংশ নেন দেশের শিক্ষিত, উচ্চশিক্ষিত জনগোষ্ঠী অর্থনীতিবিদরা। বিভিন্ন গণমাধ্যমে সরকারের মন্ত্রী-এমপি, নেতা, বিরোধী মহলের নেতা, দেশের সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা টকশোতে অংশ নেন। তারা বাজেটের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে তাদের অভিমত ব্যক্ত করেন এবং তা দেশবাসী শোনেন এবং দেখেন। প্রতিটি শাসক দলই বাজেটকে দেশের উন্নয়ন, দারিদ্র্যবিমোচন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি অর্জনের সহায়ক বলে প্রচার করে থাকেন। পক্ষান্তরে বিরোধী রাজনৈতিক দল বাজেটকে গরিব মারার লুটপাটের বলে অভিহিত করে থাকে। প্রকৃত বাস্তবতা হচ্ছে কেউ কারো ভালো দেখতে পারে নাÑ এটা আমাদের রাজনীতির একটা সংস্কৃতি। যাহোক যারা যেভাবেই যে নামেই বাজেটকে অভিহিত করুক না কেন, প্রতিটি বাজেটের ভালো-মন্দ দুটি দিক থাকে। বাজেট শুধু সরকারের আয়-ব্যয়ের হিসাবই নয়; এর সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকে আর সে লক্ষ্য অর্জনের কৌশল ও কর্মপন্থা থাকে। আর সে লক্ষ্য হচ্ছে দেশের স্বার্থে দেশের কল্যাণ, জনস্বার্থ রক্ষা করা দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়া এবং মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করাসহ বিভিন্ন ইতিবাচক দিক। একই সঙ্গে সামাজিক নিরাপত্তা, রাজনীতির অবকাঠামো উন্নয়ন সব কিছুই বাজেটে দৃশ্যমান থাকে।

একটি রাষ্ট্রের সার্বিক উন্নয়নে সুষ্ঠু কর্মপরিকল্পনা দরকার। পূর্বপরিকল্পনা ছাড়া কোনো কাজের শতভাগ সাফল্য আশা করা যায় না। এ নতুন বাজেটে বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মবার্ষিকী পালনের পাশাপাশি গ্রামকে শহরে উন্নীতকরণের লক্ষ্যে ইন্টারনেট, বিদ্যুৎ, গ্যাস, গ্রামীণ অবকাঠামোসহ সব ধরনের নাগরিক সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি থাকছে; যা বিগত নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষণা ছিল। যাহোক বিগত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের যে উন্নয়নের গতি দৃশ্যমান, সেই গতিধারাকে আরো বেগবান করবে আগামী এ বাজেট এমন প্রত্যাশা রাজনীতিক, অর্থনীতি বিশ্লেষকদের। আমরা মনে করি, আসন্ন বাজেট হবে উন্নয়নের জনপ্রত্যাশা পূরণের। সাধারণ মানুষকে যেন করের বোঝা টানতে না হয়। সার্বিক দিক থেকে বাজেট হবে দারিদ্র্যমুক্ত, ধনী-গরিবের মধ্যে বৈষম্য কমানোর বাজেট, কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণের বাজেট। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করবে। শিক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তি যোগাযোগ ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। বেকারত্বের অবসান ঘটবে। জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন, আয় ও গড় আয়ু বৃদ্ধি, অপুষ্টি দূরীকরণ, শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার কমানোসহ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার বৈশিষ্ট্যগুলো অর্জিত হবে। নিত্যপণ্যের মূল্য যেন নিয়ন্ত্রণে থাকে, সে বিষয়ে পদক্ষেপ থাকবে বাজেটে। এমনকি বাজেট হচ্ছে রাষ্ট্রের সার্বিক উন্নয়নের দিকনির্দেশক ও কর্মপরিধি। রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয় সংশ্লিষ্ট খাতের উন্নয়নের জন্য। তাই বাজেটে খাতওয়ারি অর্থ বরাদ্দ থাকে। একটি রাষ্ট্রের উন্নয়ন হয় সরকারি-বেসরকারি প্রচেষ্টায়। শুধু সরকারি উদ্যোগে প্রত্যাশিত উন্নয়ন আশা করা যায় না। তাই সরকারি বাজেটে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হয়।

২০২১ সালের মধ্যে দেশকে মধ্যম আয়ে উন্নীত করতে হলে সরকারি বিনিয়োগের পাশাপাশি বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে এবং একই সঙ্গে বিনিয়োগের সুষ্ঠু পরিবেশকে আরো উন্নত করতে হবে। প্রতিটি সরকারের আমলে বাজেট ঘোষিত হয়। তাই সাধারণভাবে সরকার যে বাজেট ঘোষণা করে থাকে তাকে বলা হয় সরকারি বাজেট। আর এ বাজেট একান্ত সরকারের চিন্তাভাবনার ফল। কিন্তু সাধারণ মানুষ মনে করে তাদের প্রয়োজন প্রত্যাশার বাজেট। যে বাজেটে তাদের সার্বিক উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখবে। কোন খাতে কত টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলো, সেটা তারা বোঝে না, কত কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করা হলো, সেটাও তাদের বিবেচ্য বিষয় নয়। অর্থাৎ বাজেট সম্পর্কে তাদের ধারণা নেই বললেই চলে। তারা শুধু বুঝতে চায় সরকারি বাজেটে যেন তাদের কল্যাণ হয় মঙ্গল হয়। সমাজের বিভিন্ন পেশা শ্রেণির মানুষের জীবনযাত্রা উন্নত হয়। বাজেট জনগণের কাছে সরকারের দায়বদ্ধতার দলিল। আবহমান কাল থেকে বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষিই হচ্ছে অর্থনীতির মূল ভিত্তি। আর এ খাতের মূল কারিগর হচ্ছেন কৃষক যারা পোড় খাওয়া মানুষ। রোদ, বৃষ্টি উপেক্ষা করে তারা সারা বছর কৃষিপণ্য উৎপাদন করেন। কৃষক মনে করেন তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পান। সুদখোর, ঘুষখোর, ফড়িয়া, মজুদদারের হাত থেকে তারা যেন রক্ষা পান। ধান, গম, আলু, সরিষাসহ কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য পান। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বাংলার কৃষক সমাজ চিরকালই অবহেলিত। তারা অধিকাংশ সময় কৃষিপণ্যের উপযুক্ত মূল্য পান না। তাদের লোকসান গুনতে হয়। উপরন্তু দ্রব্যমূল্য যেন সহনীয় পর্যায়ে থাকে।

গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে, সাধারণ মানুষের যেন কষ্ট না হয়; এজন্য চাল-ডাল পেঁয়াজ, রসুন, আদা, ভোজ্যতেল, মসলাসহ নিত্যপণ্যের বাজার যেন স্থিতিশীল থাকে। কোনোভাবেই দ্রব্যমূল্য যেন একজন ভ্যানচালক, রিকশাচালক, অটোচালক, কৃষকশ্রমিক, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ক্রয়ক্ষমতার বাইরে না যায়। সাধারণ মানুষের বাজার স্বস্তির বাজার হয়। বাজেট যেহেতু সাধারণ মানুষের দায়বদ্ধতার দলিল; সে বাজেট যেন দায়িত্বহীনতার দলিলে পরিণত না হয়। বিভিন্ন পেশার মানুষ প্রস্তাবিত এ বাজেট থেকে উপকৃত হয়। তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সিন্ডিকেটের শৃঙ্খল থেকে জনগণকে মুক্ত করতে হবে। শিক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তি ও যোগাযোগ খাত যেকোনো রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দিক। এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে, শিক্ষা ক্ষেত্রে আমাদের অর্জন অনেক। তথ্যপ্রযুক্তির সফলতাও রয়েছে। মাত্র কয়েক বছরে তথ্যপ্রযুক্তির খাতে যে সাফল্য তা চোখে পড়ার মতো। শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটেছে, নারী শিক্ষার ক্ষমতায়ন, বাংলাদেশ উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে শিক্ষায় দেশ এগিয়ে গেলেও বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা আত্মকর্মসংস্থান ও বেকারত্বের অবসানের কোনো সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা নেই। লাখ লাখ টাকা ব্যয় করে একজন কৃষক বা শ্রমিকের সন্তান বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে আজ তারা বেকার। তাদের কোনো কর্মসংস্থান হচ্ছে না। বাজেটে বেকার সমস্যার সমাধানের দিকনির্দেশনা থাকা উচিত। অপরদিকে দুর্নীতি স্বজনপ্রীতির ঊর্ধ্বে থেকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির সঙ্গে বাজেট বাস্তবায়ন করতে পারলে প্রকৃতপক্ষে জনগণ ও দেশের উন্নয়ন হবে, জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হবে এবং ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয় ও ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে একটি সমৃদ্ধি আত্মমর্যাদাশীল রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি অর্জন করবে।

আমাদের মনে রাখতে হবে, তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের সুখ, দুঃখ আনন্দ-বেদনার কথা বাজেটে থাকতে হয়। তাদের চাহিদা ও দাবির প্রতিফলন ঘটিয়ে বাজেট প্রণয়ন করা হলে সত্যিকার অর্থে সে বাজেট হবে গণমুখী এবং বাস্তবায়নযোগ্য। বাজেট প্রণয়ন করা যতটা কঠিন, তার চেয়েও কঠিন বাজেটের বাস্তবায়ন ঘটানো। বাজেট নিয়ে বিভিন্ন মহল যে মিশ্রপ্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবেন; সে বিষয়গুলোর দিকে নজর দেওয়া দরকার। মানুষের আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সামঞ্জস্য না হলে তা অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। শিক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তি, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন খাতে বরাদ্দকৃত অর্থের সুষ্ঠু ব্যয়-বণ্টন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। খাতওয়ারি যে বরাদ্দ তা যদি স্বচ্ছতার ভিত্তিতে বণ্টন করা হয়; তা হলে বাজেটে সাধারণ মানুষের ভাগ্যের দুয়ার অনেকাংশে খুলে যাবে। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যায়ে রাষ্ট্রীয় অর্থ অপচয় দুর্নীতি হয় তা রোধ করতে পারলে বাজেট বারবার সংশোধনের প্রয়োজন পড়ে না। বাজেট বারবার সংশোধন করা এতে বিরোধী মহল সুযোগ পায় সরকারের সমালোচনার। দলীয় নেতাকর্মীদের আরো সংযত হওয়া উচিত। বাজেটের সম্পূর্ণ অর্থ স্বচ্ছতার সঙ্গে ব্যয় করতে হবে; যাতে করে হতদরিদ্র প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, অটো রিকশাচালক, ভ্যানচালক, নি¤œবিত্ত সাধারণ জনগণ উপকৃত হয়। তাদের ব্যয়ের চেয়ে আয় বেশি হয়, জীবনযাত্রা উন্নত হয়; যা হবে তাদের প্রত্যাশিত বাজেট। উল্লেখ্য, অনেক ক্ষেত্রেই বাস্তবায়ন চিত্র কাক্সিক্ষত মাত্রার চেয়ে দূরেই থেকে যায়। তাছাড়া রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলনের বিষয়টিও অনস্বীকার্য। রাজনীতিতে বাহবা পাওয়া কিংবা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে লাভের হিসাব কষে নয়, বরং অর্থনৈতিক উন্নয়নের নীতিমালা অনুযায়ী বাজেট প্রণয়ন করা উচিত।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close