আবু আফজাল সালেহ

  ২০ জুন, ২০১৯

আলোচনা

ওষুধ অপবাণিজ্যে কঠোরতা জরুরি

সম্প্রতি ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের উপপরিচালক মঞ্জুর শাহরিয়ার এক অনুষ্ঠানে রাজধানীর ৯৩ শতাংশ ওষুধের দোকানে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ পাওয়া গেছে বলে অভিযোগ করেন। বিষয়টি গণমাধ্যমে আসার পর মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এটি আতঙ্কেরই বিষয়। আমরা কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছি না! বা কিছু নিচ্ছি। কিন্তু তাতে ফলপ্রসূ কিছু আসছে না! আমরা এক ধরনের জিম্মি হয়ে পড়েছি। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওষুধ কো¤পানিগুলোর মালিকদের সংগঠন ওষুধশিল্প সমিতির পক্ষে সভাপতি নাজমুন হাসান পাপন সংবাদ সম্মেলন করে মানুষকে আতঙ্কিত না হওয়ার এ আহ্বান জানান। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ওষুধের দোকানে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ থাকতে পারে। সেজন্য মানুষের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ সংশ্লিষ্ট কো¤পানিকে দিলে তা বদলে দেওয়া হয়। যেহেতু দোকান মালিকদের কোনো লোকসান গুনতে হয় না। তাই মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি করারও প্রয়োজন পড়ে না বলে মত দেন তিনি। এরপরও কেউ মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি করলে, তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে তিনি জানান।

মানুষের মৌলিক অধিকারের একটি হচ্ছে চিকিৎসা। আর এ ক্ষেত্রে প্রাণ হচ্ছে ওষুধপত্র। কিন্তু ভেজাল, নিম্নমানের, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধে সয়লাব দেশ। আর ভেজাল ওষুধে চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে গ্রামের মানুষ। গ্রামের মানুষ সচেতনতার অভাবের কারণেই এ দুর্ভোগের শিকার বেশি। এখনই লাগাম টেনে ধরতে না পারলে ভয়াবহভাবে বেড়ে যাওয়া এ প্রবণতা মারাত্মক রূপ ধারণ করবে।

পত্রিকা সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, বাংলাদেশে বছরে উৎপাদন হয় ২৫ হাজারের বেশি ওষুধ। এর মধ্যে মাত্র ৪ হাজার ওষুধ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার ব্যবস্থা বা সামর্থা আছে প্রশাসনের। আর এর ২-৩ শতাংশই ভেজাল। আর বাইরে থাকা ওষুধের মান স¤পর্কে ধারণা করা কঠিন। ভয়াবহ চিত্র হচ্ছে, ২০১২ থেকে ২০১৫ সালেÑ এই তিন বছরের ব্যবধানে মানহীন ও ভেজাল ওষুধের সংখ্যা বেড়ে গেছে দ্বিগুণ। এখন এ হার আরো বেশি বলে মনে হয়। বাংলাদেশ ওষুধ প্রশাসনের সঙ্গে জড়িত বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, দেশে মোট উৎপাদিত ওষুধের অন্তত ২ শতাংশ পরিমাণ ভেজাল। নকল ও মানহীন হয়ে থাকে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সবচেয়ে হতবাক হওয়ার বিষয় হচ্ছে কেবল রোগী নয়, অনেক সময় চিকিৎসকদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়, কোনটি ভেজাল ওষুধ। ফলে ওইসব প্রতিষ্ঠানের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ অল্পই রয়েছে। অভিজ্ঞতার অভাবে রোগীরা নির্ভর করছে কমিশননির্ভর ডাক্তারদের প্রেসক্রিপশনের ওপর। অন্যদিকে ডাক্তারদের খেয়ালখুশিমতো ওষুধ কো¤পানিগুলোর চাপিয়ে দেওয়া ওষুধ লিখে দিচ্ছেন। ওষুধ কো¤পানিগুলো দাবি করছে, গণমাধ্যমগুলোতে ওষুধের প্রচারের সুযোগ না থাকায় তারা মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভ দিয়ে ওষুধের মার্কেটিং করান। ১৯৮২ সালের ওষুধনীতিতে ওষুধ বিপণনে প্রচারের আইনের সুযোগ করে তা রোহিত করা হয়। পাশাপাশি আইন লঙ্ঘন করে বিজ্ঞাপন দিলে জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।

পরিসংখ্যান মোতাবেক বিশ্বের ১৫ শতাংশ ওষুধ নকল। এশিয়া ও আফ্রিকার কোনো কোনো দেশে নকল ওষুধের পরিমাণ ৫০ শতাংশ। অ্যাঙ্গোলায় নকল ওষুধের পরিমাণ মোট ওষুধের ৭০ শতাংশ। ২০০৫ সালে ওইসিডি (অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) হিসাবমতে, সারা বিশ্বে নকল ওষুধের বিক্রীত অর্থের পরিমাণ ছিল প্রায় ২০০ বিলিয়ন ডলার। নকল ওষুধ উৎপাদনে শীর্ষস্থানীয় দেশগুলো হলোÑ পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ, লাতিন আমেরিকা, পূর্ব-মধ্য ইউরোপের অনেক দেশ, আফ্রিকা এবং ভূতপূর্ব সোভিয়েত ইউনিয়ন। এসব দেশে বেশি নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদিত হয়। যেসব দেশে ওষুধশিল্পে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত শিথিল এবং আইনগত বাধ্যবাধকতার অভাব রয়েছে। অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর সরকার ও নীতিনির্ধারকদের দুর্নীতির কারণে নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ ও পণ্যের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয় না। অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপান, নিউজিল্যান্ড, পশ্চিম ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোয় নকল, ভেজাল নিম্নমানের ওষুধের পরিমাণ ১ শতাংশেরও কম। কারণ এসব দেশে ওষুধ এবং ওষুধশিল্পের ওপর সরকারের কঠোর আইন ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত আছে। চীনে ওষুধ ও খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল এবং নকলের অপরাধে মৃত্যুদন্ড দেওয়ার বিধান আছে।

স্বাস্থ্য হলো মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম, দেশের যেকোনো সরকারের অন্যতম অঙ্গীকার জনগণের দোরগোড়ায় চিকিৎসা সুবিধা পৌঁছে দেওয়া, কিন্তু আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষ এখনো আধুনিক চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত। শুধু তাই নয়, পদে পদে হচ্ছে প্রতারণার শিকার, এর ওপর অপচিকিৎসা, ওষুধে ভেজাল ও খাদ্যদ্রব্যে বিষাক্ত রাসায়নিক মিশ্রণ মানুষকে চরম হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। সব ভেজাল ওষুধ আর ভুয়া চিকিৎসক এ দুয়ে মিলে আজ মানুষের জীবন বিপন্ন। এ ব্যাপারে আমাদের সবাইকে সচেতন হওয়া জরুরি।

পাশাপাশি সরকারকে অধিক কঠোর হওয়া দরকার। প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে যথেষ্ট কঠোর। দুর্নীতির বিষয়ে তার কোনো আপস নেই। সম্প্রতি তিনি এ বিষয়ে স্পষ্ট করে বক্তব্যও দিয়েছেন। তার কঠোর অবস্থানের জন্য ধন্যবাদ জানাতেই হবে। আমরা কিন্তু তাকে ঠিকমতো সহযোগিতা করতে পারছি না! হতে পারে অজানা কারণে পারছি না! এ না পারার বিষয়ে যে জট, তা খুলতে হবে সরকারকেই। একই সঙ্গে আমজনতাকেও এগিয়ে আসতে হবে। আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠতেই হবে। না হলে জাতি হিসেবে আমরা আমাদের অস্তিত্বকে বিপন্ন করব; যা হবে আত্মহননের শামিল। তাই মালিক-বিক্রয় প্রতিনিধি-ক্রয়কারীসহ জনগণকেও এগিয়ে এসে সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করতে হবে। সম্ভবত তা হলেই সম্ভব হবে। রেহাই পাওয়া যাবে এ অবক্ষয়ের হাত থেকে।

লেখক : কবি ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close