হাসান জাবির

  ২০ জুন, ২০১৯

আন্তর্জাতিক

পরমাণুঝুঁকি কমাতে নতুন কাঠামো

আমরা এমন একটি বিশ্বে বসবাস করি যেখানে প্রতিনিয়ত যুক্ত হচ্ছে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ। এসব চ্যালেঞ্জ সামলাতে প্রতিনিয়ত হিমশিম খেতে হচ্ছে আমাদের। লক্ষ করলে দেখা যাবে, গত দুই দশক থেকে পৃথিবীতে ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পেয়েছে বিভিন্ন মাত্রার অস্থিরতা। এ সময় প্রায় সমগ্র দুনিয়াতেই বেড়েছে যুদ্ধের প্রকোপ। মূলত স্নায়ুযুদ্ধ-উত্তর রুশ-মার্কিন সবার্থগত দ্বন্দ্বের নয়া সম্প্রসারণই বৈশ্বিক উত্তেজনা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। বলা চলে বর্তমানে রুশ-মার্কিন সম্পর্ক স্নায়ুযুদ্ধ যুগের চাইতেও ভয়াবহ। এই পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল প্রায় বিস্ফোরণোন্মুখ। সংগত কারণেই প্রতিনিয়ত যুদ্ধ হুমকির মুখে বিদ্যমান দুই পক্ষের মধ্যে মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে অস্ত্র প্রতিযোগিতা।

অন্যদিকে আশির দশক থেকেই এশিয়ার দেশ চীন নিজের পরাশক্তিমূলক উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। যে কারণে আমেরিকার প্রধান বৈশ্বিক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে চীন ও রাশিয়া বেঁধেছে শক্ত গাটছড়া। এ রকম প্রেক্ষাপটে এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগর, কৃষ্ণসাগর, ভূমধ্যসাগর, বাল্টিক সাগর, ক্যারিবীয় সাগর অঞ্চলের বিভিন্ন সংকটে আমেরিকার মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে চীন ও রাশিয়া। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় দক্ষিণ চীন সাগর, তাইওয়ান প্রণালি, ভূমধ্যসাগর, বাল্টিক সাগর, পারস্য উপসাগর ও ক্যারিবীয় সাগর অঞ্চল। এসব অঞ্চলে নতুন করে যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। অতি সম্প্রতি ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে পারস্য উপসাগরে যুদ্ধ যুদ্ধ আবহের অবতারণা করেছে আমেরিকা ও তার মিত্ররা। অন্যদিকে সম্ভাব্য যেকোনো যুদ্ধেই পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার হতে পারে বলে সব পক্ষই উত্তেজনাকর বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। এ আশঙ্কা আরো বাড়িয়ে দেয় সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় স্নায়ুযুদ্ধের শেষ দিকে আমেরিকা ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে সম্পাদিত আইএনএফ চুক্তির কথা। ১৯৮৭ সালে সম্পাদিত এই দ্বিপক্ষীয় চু ক্তির আওতায় আমেরিকা ও রাশিয়া পরমাণু অস্ত্র বহনে সক্ষম মাঝারিপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের উৎপাদন, মজুদ ও ব্যবহার সীমিত করেছিল। যে ঘটনা ইউরোপের পরমাণু নিরাপত্তার গ্যারেন্টর হিসেবে কাজ করে আসছিল। কিন্তু সম্প্রতি মস্কো ও ওয়াশিংটন পরস্পরের প্রতি শর্ত ভঙ্গের অভিযোগ এনে এই চু ক্তির কার্যকারিতা স্থগিত করে। ফলে সংশ্লিষ্ট মাঝারিপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রসমূহের উৎপাদন মজুদ ও ব্যবহার উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। এর ফলে দুই দেশের মধ্যে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ-সংক্রান্ত ক্রিয়াশীল অন্যান্য চুক্তির কার্যকারিতাও দুর্বল হয়ে পড়ে।

ইতোমধ্যে এসব ঘটনার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে ইউরোপ ও এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার সামরিক কৌশলে। আমরা জ্ঞাত যে, এই চুক্তির প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল পশ্চিম ইউরোপের নিরাপত্তার প্রশ্নে। সেসময় অর্থাৎ সত্তরের দশকের শেষ প্রান্তে সোভিয়েত ইউনিয়ন তার পূর্ব ইউরোপীয় ভূখন্ডে স্থাপন করেছিল অত্যাধুনিক প্রতিরক্ষা ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি এসএস-২০। এর ফলে ভড়কে যায় ইউরো আটলান্টিকের উভয় তীর। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে ন্যাটো, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আমেরিকা বহুধাপ অতিক্রম করে ইউএসএসআরের সঙ্গে আইএনএফ চুক্তিতে উপনীত হয়। কিন্তু কয়েক মাস আগে প্রথমে আমেরিকা চুক্তি থেকে সরে আসার পরিপ্রেক্ষিতে নাজুক হয়ে পড়েছে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ প্রক্রিয়া। ক্রমশ আলগা হয়ে পড়েছে পরমাণু অস্ত্র-সংক্রান্ত নিরাপত্তা কাঠামো। এ ক্ষেত্রে রাশিয়ার বিরুদ্ধে চুক্তির শর্ত ভঙ্গের অভিযোগ ছাড়াও আমেরিকার দাবি দ্বিপক্ষীয় চুক্তির পরিবর্তে চীনকে সঙ্গে নিয়ে নতুন কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। কেননা এই চুক্তি শুধু আমেরিকা ও রাশিয়ার অস্ত্র সংবরণ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করে। চীন এই চুক্তির আওতায় না থাকায় বেইজিং নিজের মাঝারিপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র সম্ভার বাড়িয়েই তুলছে। মূলত পরমাণু অস্ত্র বহনে সক্ষম চীনের মাঝারিপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ডিএফ-২৫, ডিএফ-২৬ এর সক্ষমতা নিয়েই চিন্তিত আমেরিকা। এ ক্ষেত্রে আমেরিকার প্রধান বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে- সম্ভাব্য চীন-তাইওয়ান যুদ্ধ, গুয়ামের নিজ সামরিক ঘাঁটির নিরাপত্তা, গুরুত্বপূর্ণ মিত্র জাপানের নিরাপত্তা নিশ্চয়তাসহ এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় নিজের অন্যান্য সামরিক সক্ষমতা সমুন্নত রাখা। তাই চীনের সামরিক সক্ষমতার লাগাম টেনে ধরা আমেরিকার জন্য খুবই জরুরি। এর অন্যথা হলে দেশটিও চীনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সংশ্লিষ্ট অস্ত্র উৎপাদন বাড়াবে। পাশাপাশি এশিয়ার এসব অস্ত্রের মোতায়েন নিশ্চিত করতে হবে আমেরিকাকে। আমেরিকার এই মনোভাব প্রকাশিত হয়ে ক্ষুদ্রাকৃতির পরমাণু অস্ত্র তৈরির ঘোষণা দেওয়ার পর। যুদ্ধক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতি করতে সক্ষম এসব পরমাণু অস্ত্র তৈরির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হলে আমেরিকা বৈশ্বিক সামরিক কৌশলে এগিয়ে থাকবে। এ নিয়ে ইতোমধ্যে দুশ্চিন্তা বেড়েছে চীন-রাশিয়ার। দেশ দুটি একযুগে আমেরিকাকে এ ধরনের তৎপরতার নিন্দা জানিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বসে নেই কোনো পক্ষই। রাশিয়া ও চীন পাল্টা ব্যবস্থা নিতে গ্রহণ করেছে বাড়তি পরিকল্পনা। এ ক্ষেত্রে রাশিয়া ইউরোপ ঘেঁষে পরমাণু অস্ত্রের মোতায়েন বাড়িয়ে দিয়েছে। একই সঙ্গে দেশটি ইউরোপে স্থাপিত আমেরিকার ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করতে সক্ষম বহু অস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়ে আমেরিকা ও ন্যাটোকে চাপে ফেলে দিয়েছে।

কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে প্রতিনিয়ত হুমকির মুখে থাকবে বিশ্বসভ্যতা। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে সভ্যতা নিরাপদ রাখতে প্রয়োজন পরমাণু অস্ত্রের আক্রমণের সম্ভাবনা শূন্যে নামিয়ে আনা। এজন্য সর্বপ্রথম দরকার মতৈক্যের ভিত্তিতে সব ধরনের পরমাণু অস্ত্রের উৎপাদন পর্যায়ক্রমে সীমিত করা। বিদ্যমান অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে দরকার সুদৃঢ় কাঠামো। যে প্রক্রিয়ায় সব পরিস্থিতিতেই সব পক্ষ পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের চিন্তা সংবরণ করবে। হয়তো ব্যাপারটি নিয়ে থাকবে বিস্তর অনিশ্চয়তা। এতদসত্ত্বেও এর বিকল্প আর কিছুই নেই। কারণ জাপানের পরমাণু আক্রমণের বিভীষিকা প্রত্যক্ষ করেছে পৃথিবী। এই ক্ষত সভ্যতাকে কীভাবে ধ্বংস করেছিল বিশ্বকে এই বিবেচনা অগ্রাধিকার দিতে হবে। কিন্তু পরাশক্তিগুলো বিশেষ করে আমেরিকা, রাশিয়া ও চীনের পরমাণু অস্ত্র সম্ভার বিবেচনায় নিলে আমাদের আতঙ্কিত না হয়ে উপায় থাকে না। যে কারণে বৈশ্বিক পরমাণু নিরাপত্তার প্রশ্নে যাবতীয় ঝুঁকি কমানোর লক্ষ্যে আশু প্রয়োজন একটি নতুন নিরাপত্তা কাঠামো। যে কাঠামোর আওতায় পরমাণু আক্রমণের শঙ্কা থাকবে সর্বাপেক্ষা কম। এজন্য বিশ্ব নেতৃত্বের তিন শক্তি আমেরিকা রাশিয়া ও চীন সব পক্ষ একই ধরনের বাধ্যবাধকতা অনুসরণ করবে। আর এমন সমীকরণ নিশ্চিত করতে প্রথমেই দরকার আইএনএফ চুক্তিকে পুনঃজিবিত করা। কিন্তু এখন পর্যন্ত চীন এ ব্যাপারে কোনো ইতিবাচক সাড়া দেয়নি। উল্টো দেশটি সর্বশেষ মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলন ও সাংগ্রিলা নিরাপত্তা সম্মেলনে তারা রুশ-মার্কিন দ্বিপক্ষীয় চুক্তির প্রতি দায়বদ্ধতা দেখাতে অনীহা প্রকাশ করেছে। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে আমেরিকা ও রাশিয়ার সঙ্গে মাঝারিপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র চুক্তিতে নিজের সম্পৃক্ততার সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে চীনের অংশগ্রহণ ছাড়া ভবিষ্যতে আইএনএফ চুক্তি কার্যকর করা কিংবা ওই আদলে আরেকটি চুক্তি বাস্তবায়ন করা অসম্ভব। বিশ্বে স্বীকৃত পরমাণু অস্ত্রধারী দেশ ৯টি। অন্যদিকে পরমাণু অস্ত্র মোতায়েন থাকতে পারে কমপক্ষে ১৪ দেশে। অন্যদিকে আমেরিকা ও রাশিয়ার হাতে আছে প্রায় ১৫ হাজার বিভিন্ন ধরনের পরমাণু যুদ্ধাস্ত্র। আর চীনের এ ধরনের অস্ত্রের সংখ্যা ১ হাজারের কম। এতদসত্ত্বেও আমেরিকা রাশিয়াকে মুক্ত করে চীনকে এত গুরুত্ব দেওয়ার কারণ কী? এ ক্ষেত্রে আমেরিকার প্রধান বিবেচনা অবশ্যই তাইওয়ান। দীর্ঘ সময় থেকেই তাইওয়ান উপকূল ঘেঁষে নিজ ভূখন্ডে চীন ব্যাপকভিত্তিক মাঝারিপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করছে। তাই এখনই চীনের আইনের আওতায় চীনের অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে ওয়াশিংটন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। যে কারণে প্রস্তাবিত ত্রিপক্ষীয় অস্ত্র সংবরণ কাঠামোতে চীনের অন্তর্ভুক্তিকে গুরুত্ব দিচ্ছে আমেরিকা। এই প্রক্রিয়া সফল হলে বৈশ্বিক পরমাণুঝুঁকি কিছুটা হলেও কমে আসবে।

লেখক : আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close