এস এম মুকুল

  ২০ জুন, ২০১৯

মুক্তমত

না ঘরে না বাইরে মধ্যবিত্ত

প্রতি বছরই রাষ্ট্র পরিচালনা ও জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্য নিয়ে বাজেট ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশ এগিয়ে চলছে উন্নত দেশের স্বপ্ন সোপানে। আর এই স্বপ্নপূরণের লক্ষ্য নিয়ে প্রতি বছরই বড় হচ্ছে বাজেটের আকার। বাস্তবায়ন হচ্ছে আর বাস্তবায়ন হচ্ছে বলেই ঘুরছে দেশের অর্থনীতির চাকা। কিন্তু বাজেটের তালে যে চাকাটি মন্থরগতিতে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে তার নাম মধ্যবিত্ত। প্রতি বছর বাজেটের পর জীবনযাত্রার ব্যয়ের ওপর যে প্রভাব পড়েছে তার প্রধানতম শিকার মধ্যবিত্ত সমাজ। এবারের বাজেটেও মধ্যবিত্ত সমাজের জন্য তেমন কোনো সুখবর নেই বলে বিভিন্ন মহল থেকে আলোচনা-সমালোচনা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে অধ্যাপক বারাকাত বলেন, বাড়ি ভাড়া, ‘ডাক্তারের ফি, হাসপাতাল খরচ, সাংসারিক খরচ, অনুষ্ঠানে কমিউনিটি সেন্টার ও হোটেল ভাড়া এসবের খরচ মধ্যবিত্তের জীবনে প্রভাব ফেলে।’ বাজেটে মধ্যবিত্তকে চাপে রেখে ধনীদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। তার মতে, এই বাজেটে ধনীদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখানো হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির সমৃদ্ধির পেছনে যারা মূল শক্তি সেই কৃষক, শ্রমিক, নারী উদ্যোক্তারা অবহেলিতই রইলেন।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক প্রতিবেদনে জানা যায়, বাংলাদেশে দ্রুত মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ হচ্ছে। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিশাল অংশ চাকরি করে। তারা এখন ফ্ল্যাটে বা জমির মালিক। তারা ইন্টারনেটও ব্যবহার করে। টাকা-পয়সা রাখে ব্যাংক হিসাবে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের ২০ শতাংশ জনগোষ্ঠী এখন মধ্যবিত্ত। ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ মধ্যবিত্ত হবে। গবেষক সম্পর্কে বিনায়ক সেন বলেন, মধ্যবিত্ত শ্রেণির আরো বিকাশ হলে প্রবৃদ্ধির জন্য ভালো হবে। এতে উদ্যোক্তা, শ্রমিক ও চাকরিজীবীর সংখ্যা বাড়বে। যত বেশি চাকরিজীবী বাড়বে, প্রবৃদ্ধিও সুসংহত হবে। বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির চরিত্রটি সম্পর্কে গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে যত মধ্যবিত্ত রয়েছে, এর ৪৮ দশমিক ৪ শতাংশ বা প্রায় অর্ধেকই বেসরকারি চাকরি করে। আর ২০ শতাংশের বেশি সরকারি চাকরি করে। মধ্যবিত্তদের প্রায় ২২ শতাংশ ব্যবসা করে। নি¤œ মধ্যবিত্তের মধ্যে ৫১ দশমিক ৬ শতাংশ বেসরকারি চাকরি করে। আর ব্যবসায় সম্পৃক্ত মাত্র ১৭ শতাংশ। একসময় ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করা শুধু উচ্চবিত্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরাও এখন ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করে। গবেষণায় ফলাফলে দেখা গেছে, ২৩ দশমিক ৪৯ শতাংশ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরা ইংরেজি মাধ্যমে পড়ে। আর বাংলা মাধ্যমে পড়ে দুই-তৃতীয়াংশ মধ্যবিত্তের ছেলেমেয়েরা। তবে নি¤œমধ্যবিত্ত পরিবারে সবচেয়ে বেশি প্রায় ৭৫ শতাংশই বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করে।

দি ইকোনমিস্ট পত্রিকায় প্রকাশিত মধ্যবিত্ত সম্পর্কে বলা হয়েছে, উপার্জনের দিক থেকে মধ্যবর্তী স্থলে অবস্থানের জন্য অথবা সামগ্রিকভাবে স্থায়ী সমষ্টি হিসেবে। অনেক নতুন মধ্যবিত্তের অবস্থান ধনী এলিট ও গ্রামের দরিদ্র এ দুয়ের মধ্যে কোথাও। অনেকের আয় মোটামুটি উন্নত দেশে মধ্যবিত্তের গড়পড়তা আয়ের সমান। একথা সত্যি যে, বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বেড়েছে, বেড়েছে গড় আয়ু। তবে উন্নতির চাকচিক্যতা সমাজের উঁচু আর নিচুস্তরে যতটা লক্ষ করা যায়, তার সিকি ভাগও যেন মধ্যবিত্তের ভাগ্যে জুটেনি। এর কারণ হিসেবে বিশ্লেষকরা বলছেন, মধ্যবিত্তের বিকাশে জরুরি প্রয়োজনীয় বিষয়সমূহে সরকারের মনোযোগ কম। মধ্যবিত্তের বিকাশে যে বিষয়গুলোতে জোড়া দেওয়া প্রয়োজন, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো শিক্ষা, চিকিৎসা, কর্মসংস্থান, সংস্কৃতিচর্চা। মধ্যবিত্ত পরিবারের প্রধান শক্তি শিক্ষা-সংস্কৃতি-ধর্মীয় মূল্যবোধ। মধ্যবিত্ত সমাজের প্রত্যাশা সীমিত জীবনযাত্রার ব্যয়, সন্তানের জন্য শিক্ষার সুব্যবস্থা এবং শিক্ষা শেষে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলোÑ দেশে ভোগবাদী আর নি¤œবিত্তের অবারিত সুযোগ-সুবিধায় অনেকটা কোণঠাসা হয়ে না ঘরের, না বাইরের অবস্থায় ঝিম মেরে আছে মধ্যবিত্ত সমাজ। সমাজে উচ্চবিত্তদের অভাব নেই। বরং তারা বিত্তের প্রভাবে বাজারমূল্যকেও প্রভাবিত করে। যার জের টানতে হয় মধ্যবিত্তকে। আর নি¤œবিত্তদের চাহিদা কম, খরচ কম, আয় বেশি; আয়ের ক্ষেত্র বেশি। অন্যদিকে মধ্যবিত্তরা সামাজিকতা, দেশপ্রেম, মানবীয় ও ধর্মীয় মূল্যবোধ এমন কিছু আদর্শ অনুসরণে জীবনযাপন করে অভ্যস্ত। তাই তারা যা খুশি তা করতে পারে না। তাদের স্বপ্ন ও উচ্চাকাক্সক্ষা উচ্চবিত্তের মতো হলেও তা পূরণের সাধ্য নেই। আবার তারা নি¤œবিত্তের মতো জীবনযাপন করতেও অপরাগ। জীবনযাত্রার ঊর্ধ্ব মূল্যের সঙ্গে তারা পার পেয়ে উঠছেন না। সন্তানের শিক্ষার ব্যয়ভার বহন করা কষ্টকর হয়ে পড়ছে। আবার শিক্ষা শেষে ঘুষ ছাড়া চাকরিও মিলছে না। চিকিৎসা ব্যয় তুঙ্গে ওঠার কারণ রোগে-শোকে শোকাগ্রস্ত। এমতাবস্থায় কোথায় যাবে মধ্যবিত্ত। বাস্তবতা অনেকটা রকমই। প্রতি বছরই বাজেটের পর অনেক পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন ব্যবসায়ীরা। আর এই চাপে পড়ে পিষ্ট হতে হয় বিশেষকরে মধ্যবিত্ত সমাজকে। কারণ দ্রব্যমূল্যর পাশাপাশি বেড়ে যায় পরিবহন খরচ, মোবাইল বিল, শিক্ষা ও চিকিৎসা খরচ, তার উপর বাড়িওয়ালারা বাড়িয়ে দেন বাড়ি ভাড়া। বরাবরই এমন চতুর্মুখী চাপে পড়তে হয় তাদেরকে। ক্রমাগত এই চাপের ফলে ভেঙে যাচ্ছে মধ্যবিত্ত সমাজের আদর্শের শেকড়। আদর্শ বিচ্যুত হতে বাধ্য হচ্ছে মধ্যবিত্তরা। অথচ একটি দেশের সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও সভ্যতার ধারক-বাহক হিসেবে মধ্যবিত্ত সমাজের ভূমিকাই প্রধান। মধ্যবিত্ত শ্রেণি ছাড়া একটি সুস্থ সমাজকে কল্পনা করাও কঠিন। এবারের বাজেটে সাধারণ কৃষক ও শিক্ষিত বেকার জনগোষ্ঠী সর্বাধিক চাপে আছে। এবার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে ১০০ কোটি টাকা এবং ব্যবসার শুরু করতে আরো ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এ ধরনের বরাদ্দ ইতোপূর্বেও ছিল তবে সহায়তার নামে লুটপাট হয়েছে। বিশ্লেষণ অনুযায়ী, এই বাজেটের পর ছোট ফ্ল্যাট কিনতে গেলে খরচ বাড়বে। নতুন গাড়ি কেনার সামর্থ্য নেই, রিকন্ডিশন্ড গাড়িতেই ভরসা মধ্যবিত্তের। সেখানেও দুঃসংবাদ। রিকন্ডিশন্ড গাড়ির অবচয়ন সুবিধা কমিয়ে দেওয়ায় গাড়ির দাম বাড়বে। দুঃসময়ের জন্য ভরসা হিসেবে মধ্যবিত্ত পরিবারের কর্তারা সঞ্চয় করেন। কিন্তু শিগগিরই সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর কথা বলা হয়েছে। আবার সঞ্চয়পত্র কেনার সুযোগও কমানো হয়েছে। বিশেষ করে মধ্যবিত্তের ভরসা যে সঞ্চয়পত্র, সেই সঞ্চয়পত্রের ওপর কর দ্বিগুণ করা হয়েছে। অথচ সাধারণ মানুষের কাছে এটি একটি সামাজিক নিরাপত্তা খাত। এটি সাধারণ আয়ের অবসরপ্রাপ্ত মানুষের শেষ অবলম্বন। এ ছাড়া মধ্যবিত্তের মধ্যে যারা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেন, তারাও এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তাই সঞ্চয়পত্রে বর্ধিত করহার প্রত্যাহার করা উচিত।

বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে বাড়ছে যুবক প্রজন্মের সংখ্যা, যাদের বয়স ৩০ থেকে ৪০-এর মধ্যে। এদের সুযোগ বৃদ্ধির জন্য এখন প্রয়োজন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সময়মতো নির্বাচন, গ্রহণযোগ্য ও সবার অংশগ্রহণে সরকার নির্বাচন। অর্থনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, একটি পরিশীলিত সমাজ ব্যবস্থার জন্য মধ্যবিত্তের সুখী অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তারা একটি নির্দিষ্ট মানের জীবনযাত্রা পরিচালিত করে। মধ্যবিত্তের দেশপ্রেম, চেতনা ও মূল্যবোধ সমাজকে দারুণভাবে আলোড়িত করে। কিন্তু মধ্যবিত্তের সেই জৌলুসকে ম্রিয়মাণ করে দেয় রাষ্ট্রের অবহেলা। মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশে বিনিয়োগ বা প্রণোদনা নেই। তাদের সীমিত সঞ্চয় বিকাশে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। উপরন্তু জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে মানসিকভাবেও তাদেরকে পদে পদে ধাক্কা খেতে হয়। অথচ দেশে মধ্যবিত্তরাই এখন উন্নয়নের বড় অংশীদার। কারণ তারাই পণ্য বাজারজাতের বড় ভোগীদার। মধ্যবিত্তে প্রসারণের ফলেই নগরায়ণ বাড়ছে, বাড়ছে মাধুর্যতা। বিভিন্ন বিশ্লেষণ থেকে দেখা গেছে, শুধু বাজার অর্থনীতি নয়, স্থিতিশীল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও মধ্যবিত্তের অপরিসীম ভূমিকা রয়েছে। এ কারণে বলা হয়ে থাকে, মধ্যবিত্ত শ্রেণির সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে সমাজের সব কিছুতেই আমূল পরিবর্তন আসতে পারে। মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশ প্রসঙ্গে ভারতীয় অর্থনীতিবিদ সুরজিৎ ভাল্লার মত দিয়েছেন, ‘মধ্যবিত্ত শ্রেণি যত বড় হবে ততই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার বাড়তে থাকবে।’ জাতীয় প্রবৃদ্ধি যতই বাড়বে মধ্যবিত্ত শ্রেণির আকার কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেতে থাকবে। অন্যদিকে নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিল ইস্টার্লি মনে করেন, ‘মধ্যবিত্ত শ্রেণির মতের মিল থাকলে দেশের উপার্জনের মাত্রা ও প্রবৃদ্ধি বেশি হয়। সমানতালে গণতন্ত্র প্রসার লাভ করে। ফলে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা হ্রাস পায়। হিউম্যান ক্যাপিটাল বা মানব পুঁজি সৃষ্টি হয়। অবকাঠামোর সমাহার হতে থাকে। অর্থনৈতিক নীতি উত্তম হয়। আধুনিক কাঠামো তৈরি ও নগরায়ণ প্রসার লাভ করে।’ তিনি সত্যিই বলেছেন, মধ্যবিত্ত সমাজের সরব উপস্থিতি এবং প্রবৃদ্ধি একই সঙ্গে চলে। কারণ উভয়ে অর্থনৈতিক নীতির ফল। বিশ্লেষকদের মতে, বিগত তিন দশকে চীনে সম্পদের প্রাচুর্য বিশাল আকারে বৃদ্ধি হওয়া মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তাই আমরা যে উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্œ দেখছি, মধ্যবিত্তের উপস্থিতি ছাড়া সে বাংলাদেশ প্রত্যাশা করাই অলীক বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। কারণ মধ্যবিত্তরা উচ্চ ও নি¤œবিত্তের ভারসাম্য রক্ষা করে। সমাজ ও রাষ্ট্রের আদর্শিক চেতনার প্ল্যাটফরম এই মধ্যবিত্ত সমাজ।

লেখক : কৃষি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close