রেজাউল করিম খোকন

  ১৮ জুন, ২০১৯

মুক্তমত

নিরাপত্তাঝুঁকিতে ডিজিটাল ব্যাংকিংসেবা

আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে প্রযুক্তিনির্ভর সেবায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন ব্যাংকের সব গ্রাহক। আজকাল প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে পড়েছে ব্যাংকগুলোও। আর এ সুযোগ কাজে লাগাতে তৎপর হয়ে উঠেছে সংঘবদ্ধ নানা চক্র। সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানী ঢাকা শহরের কয়েকটি এটিএম বুথ থেকে একদল বিদেশির জালিয়াতির মাধ্যমে টাকা চুরির চাঞ্চল্য ঘটনা ধরা পড়েছে। যা জনমনে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। ইতোমধ্যে তদন্তের মাধ্যমে উদ্ঘাটিত হয়েছে অনেক অজানা তথ্য। দেশের ব্যাংকিং খাতকে টার্গেট করে এটিএম বুথের যন্ত্র সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগসাজশের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক হ্যাকার গ্রুপের সদস্যরা ডিজিটাল জালিয়াতির মাধ্যমে এটিএম বুথ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার দুঃসাহসী কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়েছে। নীলনকশা অনুযায়ী তারা একের পর এক হানা দিচ্ছে বিভিন্ন এটিএম বুথে। ফলে ভয়াবহ নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়েছে দেশের ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবা। দেশের বিভিন্ন এটিএম বুথে ডিজিটাল জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা এবারই নতুন নয়। এর আগেও জালিয়াত চক্র বিভিন্ন সময়ে হানা দিয়ে সুকৌশলে হাতিয়ে নিয়েছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। জানা গেছে, এটিএম যন্ত্র সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে আন্তর্জাতিক হ্যাকার গ্রুপ জালিয়াতি চক্রের গোপন যোগাযোগ রয়েছে। এসব কারণে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে দেশের ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবা। সাপ্লাই সোর্সকে ধরতে না পারলে শুধু হ্যাকার গ্রুপের সদস্যদের আটক করে এ ধরনের ডিজিটাল জালিয়াতি রোধ করা সম্ভব হবে না। এর আগে এটিএম কার্ড ক্লোন করে জালিয়াতির মাধ্যমে বুথ থেকে অবৈধভাবে অর্থ আত্মসাতের অনেক ঘটনা ঘটেছে। এ ধরনের অর্থ আত্মসাতের ঘটনা কেবল ব্যাংকের গ্রাহকদের জন্যই নয়, তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার জন্যও উদ্বেগজনক। যদিও বহু আগে থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ ধরনের ডিজিটাল জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংক থেকে অর্থ চুরির ঘটনা ঘটে আসছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে শুরু করায় সংশ্লিষ্ট সবাই নড়েচড়ে বসছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার কর্মকর্তা, ব্যাংক কর্তৃপক্ষ, গ্রাহক সবাই দারুণ এক উৎকণ্ঠার মধ্যে পড়ে গেছেন। এ ক্ষেত্রে আরো উৎকণ্ঠার বিষয় হলো এ ধরনের ঘটনায় বিদেশিদের জড়িত থাকা। যদিও ইতোমধ্যে এটিএম বুথ থেকে ডিজিটাল জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার কাজে জড়িত একদল বিদেশিকে পুলিশ আটক করতে সক্ষম হয়েছে। তাদের কাছ থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন এটিএম বুথ থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার মহাপরিকল্পনার চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে।

একসময় বিভিন্ন ব্যাংক শাখার ভল্টের তালা ভেঙে কিংবা সিঁধ কেটে ব্যাংকের ভল্ট থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ চুরি, ডাকাতির ঘটনা সবাইকে চমকে দিলেও আজকাল তেমন ঘটনা অনেক কমে এসেছে। সময়ের বিবর্তনে ব্যাংকগুলো নতুন করে সাইবার তথা ডিজিটাল ঝুঁকির মধ্য পড়েছে। ব্যাংক ব্যবস্থার মতো ব্যাংক ডাকাতির ইতিহাসও পুরোনো। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যাচ্ছে অপরাধের ধরন। আজকাল বিশ্বব্যাপী ব্যাংকের নিরাপত্তা বিধানে আধুনিক প্রযুক্তির উদ্ভব হলেও বাংলাদেশে তার প্রচলন ও প্রয়োগ সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশের অপরাধ চক্রের সঙ্গে বিদেশি সংঘবদ্ধ চক্র জোট বেঁধে সেই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে এখন নানা ধরনের ডিজিটাল জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ চুরির স্পর্ধা দেখাচ্ছে। এ ধরনের ঘটনার পর ব্যাংকিং সেক্টরে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে স্বাভাবিকভাবেই। ইতোমধ্যে সজাগ হয়ে উঠেছেন সংশ্লিষ্ট সবাই।

সারা দুনিয়ায় ব্যাংক খাতে ডিজিটাল জালিয়াতির মাধ্যমে সাইবার অপরাধী কর্তৃক বড় অঙ্কের অর্থ চুরির ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বৈশি^ক আর্থিক খাতে নিয়ন্ত্রকরা ব্যাংকের সাইবার নিরাপত্তা জোরদার করার তাগিদ দিয়েছেন অনেক আগেই। সাইবার অপরাধীরা অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং লেনদেন সংক্রান্ত তথ্য আদান-প্রদানের নেটওয়ার্কে ভুয়া নির্দেশনা পাঠিয়ে বিভিন্ন ব্যাংকের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে।

বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার শুরু নব্বইয়ের দশকে। যদিও শুরুতে প্রযুক্তি এতটা আধুনিক ছিল না আজকের মতো। তখন ছোট ছোট সফটওয়্যার ব্যবহার করা হতো। কেন্দ্রীয়ভাবে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার অনেকগুণ বেড়েছে। এই প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য বিপুল বিনিয়োগ হয়েছে। দেশের সব ব্যাংকই এখন ডিজিটাল সেবা প্রদান করছে গ্রাহককে। এতে খুব সহজে কম সময়ে দ্রুত আধুনিক ব্যাংকিং সেবা প্রদান সুনিশ্চিত হয়েছে। আমাদের এখানে কিছু দেশীয় ব্যাংক রয়েছে; যাদের আইটি উৎকর্ষ আন্তর্জাতিক মানের। আইটি ব্যবহারের দিক থেকে আমরা যতটা এগিয়েছি, তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্য বিষয়গুলো ঠিক সেভাবে এগোয়নি। আমাদের ব্যাংক খাতে আইটির ক্ষেত্রে বড় সমস্যা অভিজ্ঞ ও দক্ষ লোকের অভাব। এর পাশাপাশি সচেতনতারও যথেষ্ট অভাব রয়েছে। প্রযুক্তির কিছু ঝুঁকি সব সময়ে থাকবে। প্রতিনিয়ত প্রযুক্তি বদলাচ্ছে বিশ্বজুড়ে। তাই সাইবার ঝুঁকি মোকাবিলা করতে হলে পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। একটা সময়ে আইটির জন্য আলাদা নিরাপত্তা বিভাগ বলতে কিছু ছিল না ব্যাংকগুলোতে। আমরা সাধারণত তথ্যপ্রযুক্তির সুযোগ-সুবিধা, সাফল্যগুলো ভোগ করেই পরিতৃপ্তি ও সন্তুষ্টিতে আচ্ছন্ন থাকছি। সাইবার নিরাপত্তার ঝুঁকি নিয়ে তেমন সিরিয়াস না হওয়ায় এই দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে সংঘবদ্ধ জালিয়াত চক্র। ব্যাংক খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি; যার কারণে ব্যাংকিং কর্মকান্ডে দারুণ গতির সঞ্চার হয়েছে। সেই আইসিটিকে ব্যাংক খাতের প্রধান একটি ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো ভিন্ন। এখনো আইসিটিকে ব্যাংক খাতের মূল ব্যবসা থেকে আলাদা করে দেখার একটি মানসিকতা বহাল রয়েছে। ব্যাংক ও আর্থিক খাতের নতুন গতি সঞ্চারকারী আইসিটি খাতকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব না দিয়ে অবহেলিত অবস্থায় রেখে দিলে বড় ধরনের ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি। এ খাতের নীতিনির্ধারকদের পুরোনো মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে বাস্তবতার নিরিখে। সাইবার ঝুঁকির বিপদ থেকে মুক্ত হয়ে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত নিরাপদে-নির্বিঘেœ এগিয়ে যাবে, আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক : ব্যাংকার ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close