রায়হান আহমেদ তপাদার

  ১৫ জুন, ২০১৯

আন্তর্জাতিক

রাজনীতির ভিন্ন মাত্রায় ইইউ নির্বাচন

প্রতি পাঁচ বছর পর পর অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনে ভোটার সংখ্যা ৪০ কোটির বেশি। এদের ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট করতে রাজনৈতিক দলগুলোকে রীতিমতো যুদ্ধে নামতে হয়। অতীতের নির্বাচনগুলোতে মূল ইস্যু ছিল অভ্যন্তরীণ। পুরো ইউরোপের স্বার্থ মাথায় রেখে ভোটাররা কেন্দ্রে যাননি। অনেক সময় সরকার ফেলে দেওয়ার কাজেও এ নির্বাচনকে ব্যবহার করেছেন ভোটাররা এবং প্রতি দফায়ই ভোটের হার কমেছে। ২০১৪ সালে এই হার ছিল ৪৩ শতাংশ। সেই প্রবণতা আগামী সপ্তাহেও যেন অব্যাহত না থাকে, তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। জনরঞ্জনবাদের উত্থানের পর থেকে এবারই প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। অতীতের তুলনায় এখনকার ইউরোপে ঝুঁকি অনেক বেশি। মহাদেশজুড়েই জাতীয়তাবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। একই সঙ্গে বাড়ছে চীনের শক্তি, রাশিয়ার আগ্রাসী মনোভাব, যুক্তরাষ্ট্রের বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব এবং ইসলামপন্থি সন্ত্রাস। প্রতিটি দেশেরই নিজ নিজ সংকট রয়েছে। এগুলোও তাদের পেছন দিকে টেনে রাখে। অভিন্ন হুমকিগুলোর বিরুদ্ধে ইউরোপীয় সহযোগিতার ঢাল হিসেবে দেখা হচ্ছে এবারের ইউরোপীয় নির্বাচনকে। এই হুমকিগুলোর মধ্যে একচেটিয়া ব্যবসা করে যাওয়া প্রযুক্তি কোম্পানি থেকে শুরু করে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টিও রয়েছে। এ হুমকিগুলোর বিরুদ্ধে এককভাবে যেকোনো রাষ্ট্রের চেয়ে ইইউ সমন্বিতভাবে অনেক বেশি শক্তিশালী। এবারের নির্বাচনে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছিল ইউরোপের সমালোচক পপুলিস্ট ও মুসলিম অভিবাসী বিরোধী দলগুলোর উত্থান নিয়ে। ইউরোপে শান্তির বার্তা বয়ে এনেছে তাদের উত্থান না হওয়ায়। যদিও ইউরোপের সমালোচক ব্রিটেনের নাইজেল ফারাজের ইএফডি ৫৬টি আসন পেয়েছে; যা গত নির্বাচনের তুলনায় ৮টি আসন বেশি। এ ছাড়া ইউরোপের সমালোচক হিসেবে পরিচিত ইসিআর পার্টিও ৬০টি আসন পেয়েছে।

অন্যদিকে ইতালির আলোচিত জাতীয়তাবাদী নেতা সালভিনি ও ফ্রান্সের জাতীয়তাবাদী নেত্রী মারিন ল্য পেনের নেতৃত্বাধীন ইএনফ ৫৭টি আসন পেয়েছে। ফ্রান্সের জাতীয়তাবাদী নেত্রীর উত্থান ফ্রান্সে নতুন রাজনৈতিক মেরূকরণ সৃষ্টি করবে। যার প্রভাব ব্রাসেলসেও পড়তে পারে। তবে অভিবাসীদের মধ্যে তাদের উত্থান নিয়ে এখনো আতঙ্ক রয়ে গেছে। আর নর্ডিক অঞ্চলের বাম ও গ্রিনদের সংগঠন এনজিএল ৪১ আসন পেয়েছে। ইউরোপের নির্বাচন নিয়ে জার্মানির ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটিতে ইউরোপিয়ান স্টাডিজে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী সাগর আনোয়ার জানান, এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে বড় চমক হচ্ছে গ্রিন পার্টি। ২০০৪ সালে ইতালিতে জন্ম নেওয়া এই পার্টি এখন জার্মানিসহ পুরো ইউরোপের তরুণ প্রজন্মের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। মাত্র ছয় সপ্তাহ আগে যে দলটির জন্ম, সেই ব্রেক্সিট পার্টি যেভাবে ব্রিটেনে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নির্বাচনে বিপুল বিজয় পেয়েছে, তাকে কেবল সুনামির সঙ্গেই তুলনা করা যায়। ব্রিটেনে ইউরোপীয় নির্বাচনে একক দল হিসেবে সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়েছে নাইজেল ফারাজের ব্রেক্সিট পার্টি। মোট প্রদত্ত ভোটের ৩১ শতাংশ পেয়েছে তার দল। নাইজেল ফারাজ ব্রিটিশ রাজনীতিতে সুপরিচিত তার ইউরোপীয় ইউনিয়নবিরোধী কট্টর অবস্থানের জন্য। এর আগে তিনি ছিলেন ইউকে ইনডিপেনডেন্ট পার্টি বা ইউকিপের নেতা। এ দলটি বহু বছর ধরে আন্দোলন করেছে ব্রিটেনকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের করে আনার জন্য। ব্রিটেন যে শেষ পর্যন্ত গণভোটে ব্রেক্সিট অর্থাৎ ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসার পক্ষে রায় দেয়, তার জন্য নাইজেল ফারাজ এবং তার সাবেক দল ইউকিপ কৃতিত্ব দাবি করে।

তবে মিস্টার ফারাজ শেষ পর্যন্ত আর ইউকিপে থাকেননি। মাত্র ছয় সপ্তাহ আগে তিনি ব্রেক্সিট পার্টি বলে নতুন দল গঠন করে ইউরোপীয় নির্বাচনে অংশ নেবেন বলে ঘোষণা দেন। সেই নির্বাচনে তার দলের চমকপ্রদ সাফল্য হতবাক করে দিয়েছে সবাইকে। অন্যদিকে প্রধান দুই দলের শোচনীয় পরাজয়ের পর এই দুই দলেই শুরু হয়েছে মারাত্মক অন্তর্কলহ। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য ২৮ দেশের জন্য আইন তৈরি করে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট। এটি ছিল সেই ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নির্বাচন। প্রত্যেকটি সদস্য দেশ থেকে জনসংখ্যার অনুপাতে এই পার্লামেন্টে সদস্য পাঠানো হয়। পার্লামেন্টের মোট সদস্য সংখ্যা ৭৫১। ব্রিটেন গণভোটে ব্রেক্সিটের পক্ষে রায় দেওয়ার তিন বছর পরও ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। তাই বাধ্য হয়ে তাদের ২৩ মে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নির্বাচনে অংশ নিতে হয়।

ইউরোপের বাকি সব দেশেও একই সঙ্গে এই নির্বাচন হয়েছে এবং আরো অনেক দেশেই কট্টর ডানপন্থি দলগুলোর উত্থান দেখা গেছে। ইউরোপের পক্ষে রায় দিল ২৮ দেশের জনগণ (ব্রাসেলস, বেলজিয়াম) ভারতের পর সর্ববৃহৎ নির্বাচন দেখল বিশ্ববাসী। ২৩ মে থেকে শুরু হওয়া তিন দিনব্যাপী নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে ২৬ মে ইউরোপ সময় রাত ১০টায়। নির্বাচনে প্রধান দলগুলোর আসন কিছুটা কমলেও শক্তিশালী ইউরোপের পক্ষেই রায় দিয়েছে ইউরোপের ২৮ দেশের জনগণ। ফলাফল পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, ইউরোপের প্রধান রাজনৈতিক দল ইউরোপিয়ান পিপলস পার্টি (ইপিপি) এবারও সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। তারা পেয়েছে ১৭৮টি আসন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ইপিপি পেয়েছিল ২২১ আসন।

অন্যদিকে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ইউরোপের সোশ্যালিস্ট ও ডেমোক্র্যাটদের জোট এসঅ্যান্ডডি। জোটটি পেয়েছে ১৪৭ আসন। তাদের আসনও কমেছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে এসঅ্যান্ডডি জোট পেয়েছিল ১৯১ আসন। তবে এবার ইউরোপের চমক হচ্ছে লিবারেল ডেমোক্র্যাট, গ্রিন পার্টি ও জাতীয়তাবাদী দলগুলোর উত্থান। সারা ইউরোপের লিবারেল ডেমোক্র্যাটদের এই জোট এবার ঈর্ষণীয়ভাবে ১০১টি আসন পেয়েছে; যা গত নির্বাচনের চেয়ে ৩৪টি আসন বেশি। ২০১৪ সালে তারা পেয়েছিল ৬৭টি আসন। আর গত নির্বাচনের ষষ্ঠ অবস্থান থেকে চতুর্থ অবস্থানে এসেছে জার্মানসিহ ইউরোপের আলোচিত পরিবশেবাদীদের রাজনৈতিক দল গ্রিন পার্টি। তারা এবার ৭০টি আসন পেয়েছে। গত নির্বাচনে তারা পেয়েছিল ৫০টি আসন। এ ছাড়া ইউরোপে আরব দেশগুলো থেকে আসা উদ্বাস্তু ও অভিবাসীবিরোধী এবং জাতীয়তাবাদী দলগুলোর চরম উত্থানের যে আশঙ্কা ছিল, তা তেমনভাবে ঘটেনি। এটা কিছুটা হলেও আশ্বস্ত করেছে অভিবাসীদের। তবে মেইনস্ট্রিম পার্টিগুলোর আসন কমাতে ইউরোপের নতুন শক্তির উত্থানকে জানান দিচ্ছে। ইউরোপীয় পার্লামেন্টে মোট আসন ৭৫১টি। আর ইউরোপীয় ইউনিয়নের তিনটি প্রধান ইনস্টিটিউটের মধ্যে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট অন্যতম। এ ছাড়া বাকি দুটি হলো ইউরোপীয় কমিশন এবং ইউরোপীয় কাউন্সিল। ইউরোপীয় পার্লামেন্ট বা পার্লামেন্টের সদস্যরা মূলত জোটভুক্ত দেশগুলোর জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে। ইউরোপীয় পার্লামেন্ট জোটের বিভিন্ন বিষয়ে আইনপ্রণেতা হিসেবে কাজ করে। জোটের বাজেটের ক্ষেত্রেও ইইউ পার্লামেন্টে সম্মতির প্রয়োজন হয়। ইউরোপীয় কমিশন জোটের প্রশাসনিক বিষয়াদি এবং ইউরোপীয় কাউন্সিল সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সরকারগুলোর প্রতিনিধি-সংবলিত কমিটি।

এ ছাড়া ইইউ পার্লামেন্টের সদস্যরাই তাদের পছন্দমতো ভোট দিয়ে পাঁচ বছরের জন্য ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেন। শুধু ব্রিটেনে নয়, ইউরোপের আরো অনেক দেশেই ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নির্বাচনে মূলধারার দলগুলো খারাপ করেছে। আর এর বিপরীতে নতুন শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে কট্টর ডানপন্থি দলগুলো। ফ্রান্সে প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর দলকে পেছনে ফেলে সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়েছে কট্টর ডানপন্থি মারিন ল পেনের দল ন্যাশনাল ফ্রন্ট। জার্মানিতে প্রধান দুটি মধ্যপন্থি দলই ভোট হারিয়েছে। অ্যাঙ্গেলা মেরকেলের ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টি এবং মধ্য-বামপন্থি সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি উভয়েই খারাপ ফল করেছে আগের তুলনায়। অন্যদিকে কট্টর ডানপন্থি দল এএফডি ১০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছে।

হাঙ্গেরিতে ভিক্টর ওরবানের ইমিগ্রেশন বিরোধী দল ৫২ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছে। ইউরোপীয় পার্লামেন্টে বিগত কয়েক দশক ধরে মধ্য-বাম এবং মধ্য-ডানপন্থি দলগুলোর যে প্রাধান্য ছিল, এখন তা খর্ব হতে চলেছে বলে মনে করা হচ্ছে। এই প্রথম ইউরোপীয় পার্লামেন্টে এ ধরনের দলগুলোর জোট তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে। বিবিসির ইউরোপবিষয়ক সম্পাদক ক্যাটিয়া অ্যাডলার বলছেন, সারা ইউরোপেই জাতীয় রাজনীতিতে যে ধরনের প্রবণতা, এবারের ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নির্বাচনে তারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। মানুষ বিদ্যমান ব্যবস্থাকে প্রত্যাখ্যান করছে। এমন সব দলকে তারা সমর্থন করছে, যেসব দল তাদের মূল্যবোধ এবং স্বার্থকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বলে তাদের মনে হচ্ছে। যেমন ইমিগ্রেশনবিরোধী কট্টর ডানপন্থি দলগুলো। নির্ধারিত সূচি মেনে চললে এত দিনে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কথা ব্রিটেনের।

কিন্তু ব্রিটিশ এমপিরা কিছুতেই চূড়ান্ত ব্রেক্সিট চুক্তি তৈরি করে উঠতে পারছেন না। ২৯ মার্চ পার হয়ে যাওয়ার প্রায় দুই মাস পরেও কবে ব্রেক্সিট হবে, আদৌ হবে কি না, একদমই স্পষ্ট নয়। ১৯৯৩ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠিত হওয়ার বহু আগে ইউরোপের কয়েকটি দেশ মিলে ‘ইউরোপীয় ইকোনমিক কমিউনিটি’ (ইইসি) নামে একটি অর্থনৈতিক জোট গঠন করেছিল। সেই জোটের আমলে ১৯৭৯ সালে প্রথম ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নির্বাচন হয়। তারপর থেকে মোটামুটি পাঁচ বছর অন্তর এই নির্বাচন হয়। এ নিয়ে নবমবার। এখন পার্লামেন্টের প্রেসিডেন্ট জঁ ক্লদ ইউঙ্কার। তবে এবার আর ভোটে লড়ছেন না তিনি। পার্লামেন্টে মোট আসন সংখ্যা ৭৫১। ইউরোপীয় ইউনিয়নের নীতিনির্ধারণ করাই পার্লামেন্ট সদস্যদের কাজ। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঠিক হয়েছিল আগামী নির্বাচনের আগেই ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিযে যাবে। তাই আসন সংখ্যা কমিয়ে ৭০১ করে দেওয়া হোক। শেষ পর্যন্ত ব্রেক্সিট না হওয়ায় এবারও ৭৫১টি আসনেই ভোট হবে। ভোট দেবেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিটি সদস্য দেশের ভোটদাতারা। তবে ঘরোয়া রাজনীতির মতো এ ভোটাভুটিতে অতটা সাড়া মেলে না। সাধারণত ৩৫ থেকে ৫০ শতাংশ ইইউ ভোটার ভোট দিতে আসেন।

ব্রিটেনের জন্য এ নির্বাচন ইউরোপে নিজ অবস্থান নির্ধারণ করে দেবে। এটি শুধুই একটি সাধারণ নির্বাচন নয়। একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বে ব্রিটেন ভূমিকা পালন করতে পারবে কি না, তার নির্ধারণী ভোট এটি। আর তাই ব্রিটেন এই নির্বাচনে অংশ নিতে বাধ্য হচ্ছে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close