মতিলাল দেব রায়

  ১১ জুন, ২০১৯

বিশ্লেষণ

বৈরী হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ

পৃথিবীর সব রাষ্ট্রসহ জাতিসংঘ যখন বলছে জলবায়ুর পরিবর্তন রোধে সবার যৌথভাবে উদ্যোগ নেওয়া খুবই জরুরি। তা না হলে মানবজাতি প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপন্ন হতে পারে। সেই লক্ষ্যে আমাদের দেশের সরকার জলবায়ুর পরিবর্তন রোধে বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নিয়েছেন; যা বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। কিন্তু সিলেট বনবিভাগের কমলগঞ্জ উপজেলার রাজকান্দি রেঞ্জের আদমপুর ফরেস্ট বিট এবং ওই রেঞ্জের কুরমাঘাট ফরেস্ট বিট থেকে রাতের আঁধারে বাঁশ পাচার হচ্ছে। অভিযোগ উঠছে, যাদের মূল কাজ হচ্ছে বন পাহারা দেওয়া, নতুন বনায়ন সৃষ্টি করা, বাস্তবে তাদের সহায়তায় বনের মূল্যবান বাঁশ পাচার হচ্ছে। এ রাজকান্দি ফরেস্ট বৃহত্তর সিলেটের একমাত্র ফরেস্ট এখনো বিভিন্ন প্রজাতির বনজ সম্পদে ভরপুর কিন্তু সংঘবদ্ধ গাছ চোরেরা বনবিভাগের কিছু কর্মকর্তার সহযোগিতায় এ পাহাড়কে বৃক্ষশূন্য করছে। বলা হচ্ছে, এসবের বেশির ভাগই প্রাথমিকভাবে আশপাশের করাতকলগুলোতে নেওয়া হয়। এর আশপাশের উপজেলাগুলোতে অনেক করাতকল আছে, যেগুলোর অধিকাংশ লাউয়াছড়া, রাজকান্দি ফরেস্টের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে। ফরেস্ট আইনে আছে সরকার অনুমোদিত ফরেস্টের ২০ কিলোমিটারের মধ্যে করাতকল বসানো সম্পূর্ণ বে-আইনি। কিন্তু বন আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অবৈধ করাতকল স্থাপন করে গাছ চোরদের কাছ থেকে কম দামে গাছ ক্রয় করে বেশি দামে দেশের বিভিন্ন জেলাতে সরবরাহ করে থাকে। কথিত আছে, চা বাগান থেকে ছায়া বৃক্ষ চুরি করে এসব করাতকলে বিক্রি করে।

জানা যায়, বনবিভাগে দুটি শাখা আছে, একটি হলো বনবিভাগ টেরিটরি আর আরেকটি হলো বনবিভাগ বন্যপ্রাণী ও প্রাকৃতিক সংরক্ষণ। তাদের ঢাকা থেকে মাঠপর্যায়ে জনবলের সংখ্যা ও মূল বিভাগের মতো। তাছাড়া বন কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ বিদ্যালয়, যা চট্টগ্রামে অবস্থিত। সেখানেও অনেক কর্মকর্তা কর্মরত। লাউয়াছড়া ফরেস্ট বাংলার কাছে একটি ছোট অসমাপ্ত ঘর আছে, যার সামনে একটি সাইনবোর্ডে লেখা আছে ‘বন গবেষণা কার্যালয়’। এ অফিসে কোনো কর্মকর্তা বন গবেষণা করতে এলাকাবাসীর নজরে আসেনি। লাউয়াছড়া ফরেস্ট এলাকায় কয়েক বছর আগে আগরগাছ লাগানো প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল, অনেক গাছ লাগানো হয়েছিল, কিন্তু কেউ জানে না এ গাছগুলো পাহাড়ে আছে কি না। বিগত ২০০৫-০৭ সালে যৌথ অংশীদারত্বের মাধ্যমে বন সৃষ্টির জন্য জনগণকে কিছু বনভূমি বরাদ্দ দেওয়া হয়, যার সব তথ্য ব্যবস্থাপনা কমিটির অফিসে সংরক্ষিত আছে। এ কাজের অগ্রগতি মূল্যায়নের সময় এসেছে, কি পরিমাণ গাছ বেঁচে আছে এবং সর্বশেষ অবস্থা জানা দরকার। ভাবার বিষয়, এ কর্মসূচি চলমান অবস্থায় লাউয়াছড়া পাহাড়ে দিন দিন গাছের সংখ্যা কমছে। একটি পাহাড়ে বন রক্ষণাবেক্ষণের যত কিছু প্রয়োজন সব কিছু বিদ্যমান আছে, কিন্তু যে পরিমাণ গাছ থাকার কথা, তা নেই। বনবিভাগের সব বনাঞ্চলে বনের পাশে অনেক পতিত উঁচু জমি আছে; যা বনের বাফার জোন হিসেবে পরিচিত। এই বাফার জোনের পতিত জমি একশ্রেণির স্থানীয় প্রভাবশালী বনবিভাগের অসাধু কর্মকর্তার সহযোগিতায় বনবিভাগের আওতাভুক্ত ও পতিত জমি বনবিভাগের মূল ম্যাপ থেকে কেটে বনবিভাগের জমি নয় বলে সার্টিফিকেট দিয়ে প্রভাবশালীদের এই ভূমি তাদের নামে রেকর্ড করার জন্য সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের আটটি জাতীয় উদ্যানসংলগ্ন সব বনাঞ্চলের অবস্থা একই রকম। বিষয়টি কোনো মূল্যায়নকারী দিয়ে মূল্যায়ন করলে আসল সত্য বেরিয়ে আসবে। সাতগাঁও, রঘুনন্দন, লাউয়াছড়া ফরেস্টের চতুর্দিকের টিলা ভূমি ও সমতল ভূমি এবং সংলগ্ন হিড বাংলাদেশের দখলে থাকা ৩০০ একর সরকারি ভূমি বেদখল হচ্ছে দিন দিন, কিছুদিন পর এ ভূমিতে ঘরবাড়ি তৈরি হলে স্থানীয় বনের ওপর নির্ভরশীল গ্রামের জনসাধারণ এর সঙ্গে জড়িয়ে এই ইস্যুকে জটিল করে তুলবে। এখনি এদের বাধা দিতে হবে। ইউএসআইডির আর্থিক সহায়তায় নিসর্গ সহায়তা প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত বনের উন্নয়নে এ আটটি জাতীয় উদ্যানের আশপাশে বসবাসরত বনের ওপর নির্ভরশীল দরিদ্র গোষ্ঠীর উন্নতি ও আত্মনির্ভরশীল করার লক্ষ্যে লাউয়াছড়া এলাকার জনসাধারণকে গরু মোটাতাজাকরণ প্রকল্প নামে প্রায় ৪০ জন গরিব জনগণকে জনপ্রতি ২০ হাজার টাকা করে অনুদান দেওয়া হয়। লাউয়াছড়া বনে বসবাসরত টিপরা জনগোষ্ঠীর গ্রামের প্রবেশমুখে প্রায় সাত লাখ টাকা দিয়ে একটি পাকা পুল (ব্রিজ) তৈরি করে দেওয়া হয়। লাউয়াছড়ায় ইকো ট্যুরিজমকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য অত্র বন এবং আশপাশের অনেক যুবকের ইকোট্যুরিজমের ওপর এক সপ্তাহ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বনের ওপর নির্ভরশীল কমানোর জন্য মহিলা দল গঠন করে আয় সৃষ্টিকারী প্রকল্প শুরুর জন্য লাখ লাখ টাকা লোন দেওয়া হয়। বন পাহারা দেওয়ার জন্য ১৪ জনের একটি বন পাহাড় দল গঠন করে ৩ বছর এদের মাসে ২৫০০ টাকা করে বেতন দেওয়া হয়। দেশি-বিদেশি ট্যুরিস্ট আকৃষ্ট করার জন্য লাউয়াছড়া বনের পাশে রাধানগর গ্রামে এ প্রকল্প থেকে একটি কুটির এবং বালিগাঁও আরেকটি কুটির তৈরি করে দেওয়া হয়; যাতে করে ভ্রমণপিপাসু বন এলাকা থেকে বন্যপ্রাণী ও বনের প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করতে পারেন। তাছাড়া প্রতিটি জাতীয় উদ্যানে একটি করে কম্পিউটার দেওয়া হয়, যাতে করে বন এলাকার যুবক-যুবতীরা দেশি-বিদেশি তথ্য পেতে পারে। তাছাড়া লাউয়াছড়ায় বনের চতুর্দিকে সবুজবেষ্টনী তৈরি এবং বননির্ভর জনগণের অস্থায়ী কর্মসংস্থানের জন্য কয়েক মাইল এলাকায় ছোট গ্রামীণ রাস্তায় স্ট্রিপ প্ল্যানটেশন পদ্ধতিতে গাছ লাগানো হয়। লাউয়াছড়া, সাতছড়ি, রেমা কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, টেকনাফ, চুনতি, বাহারছড়া জাতীয় উদ্যান, বাঁশখালী ইত্যাদি এলাকায় নিসর্গ সহায়তা প্রকল্পের মাধ্যমে অনেক কাজ করা হয়েছে; যা সব ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যরা বলতে পারবেন। তাছাড়া বিদেশি ট্যুরিস্ট আকৃষ্ট করার জন্য লাউয়াছড়াতে একটি তথ্যকেন্দ্র্র প্রায় ৩০ লাখ টাকা খরচ করে তৈরি করা হয়। এই লাউয়াছড়া প্রকল্পের সঙ্গে আমি একজন পরামর্শক হিসেবে জড়িত ছিলাম কয়েক বছর। বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান কমিটির সভাপতি হিসেবে দুই টার্ম দায়িত্ব পালন করেন। এত আয়োজন, এত কাজ করার পরও আজ পর্যন্ত গাছ চুরি বন্ধ করা যায়নি। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, এই বনাঞ্চলের আশপাশের গ্রামের বনজ সম্পদের ওপর নির্ভরশীল মানুষের একসময় পেশা ছিল এই পাহাড় থেকে গাছ চুরি করে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করা। তাই আশপাশের গ্রামের অনেকের নামে গাছ চুরির মামলা এখনো বন আদালতে বিচারাধীন। বছরের পর বছর ধরে মামলা চলে, কিন্তু এই মামলার কোনো শেষ হয় না। এই মামলায় অনেককে জেল খাটতে হয়েছে, কোর্টে হাজিরা দিতে হয়, উকিলের মাধ্যমে জামিন নিতে হয়। এই মামলা তাদের জীবনকে তিলে তিলে ধ্বংস করে দিচ্ছে। একটি মামলায় হাজিরা দিতে গিয়ে অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়; যা তাদের ঘাটতির মধ্যে ফেলে দেয়। তাই তারা ওই ঘাটতি পূরণ করতে আবার গাছ চুরি করে এবং আবার মামলায় পরে এতে করে কোনো মামলা থেকে বের হতে পারছে না, তাদের যদি এই বন মামলা থকে অব্যাহতি দেওয়া হতো এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা হতো, তা হলে তাদের বিকল্প পেশায় নিয়োজিত করলে এলাকায় গাছ চুরি অনেকাংশে বন্ধ হয়ে যাবে। আলোচনা করে কীভাবে এই

বিষয়টি সমাধান করা যায়, তার পথ খুঁজে বের করে গ্রামবাসীদের মামলার বেড়াজাল থেকে মুক্ত করে আনলে একটা অধ্যায়ের শেষ হতো। এতে একটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠী স্বাভাবিক সুস্থ জীবনে ফিরতে পারবে এবং পাহাড়ও আগের মতো সবুজ বনে ভরে উঠবে।

বাংলাদেশের বনাঞ্চলকে পুনরুজ্জীবিত করা এখন সময়ের দাবি। যেসব বন ঘিরে জাতীয় উদ্যান গড়ে উঠেছে, সেদিকে বিশেষভাবে নজর দেওয়া দরকার। কীভাবে সবাইকে সক্রিয় করে বন ব্যবস্থাপনায় আরো গতি আনা যায় এবং গাছ চুরি বন্ধ করা যায়, তা ভাবার সময় এখনই।

লেখক : আমেরিকা প্রবাসী

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close