মুহাম্মদ ইয়াকুব

  ১০ জুন, ২০১৯

স্মরণ

সাংবাদিকতার পথিকৃৎ মওলানা আকরম খাঁ

বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম সংবাদপত্র ‘দৈনিক আজাদ’-এর প্রতিষ্ঠাতা মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ এ দেশে সাংবাদিকতার পথপ্রদর্শক হিসেবে সর্বজন শ্রদ্ধেয়। সংগত কারণেই বরেণ্য গীতিকবি কে জি মোস্তফা মওলানাকে ‘মুসলিম সাংবাদিকতার জনক’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে সাংবাদিকতাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানকারী তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া মওলানার জীবনকে সবার জন্য ‘অনুপ্রেরণার স্থল’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। সংবাদপত্রের মাধ্যমে আধিপাত্যবাদ ও দখলদারবিরোধী একটি নতুন সভ্যতা বিনির্মাণের লক্ষ্যে এ দেশে সর্বপ্রথম সংগ্রাম শুরু করেন মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ।

মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ ৭ জুন ১৮৬৮ সালে পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশপরগনা জেলার হাকিমপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। শতবছরব্যাপী বর্ণাঢ্য জীবন শেষে ১৯৬৮ সালের ১৮ আগস্ট রাজধানী ঢাকার বংশালের আহলে হাদিস মসজিদে প্রার্থনারত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। মওলানার দীর্ঘ ১০০ বছরের সংগ্রামী জীবনকে ড. এনামুল হক ‘এক শতাব্দীর জীবন্ত প্রতীক’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি অনুরাগবশত মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ ১৮৯৬ সালে কলকাতা আলিয়া মাদরাসায় ভর্তি হন এবং ১৯০০ সালে ফাজিল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পড়াশোনা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি জাতীয় জাগরণে মনোনিবেশ করেন। লেখালেখি এবং সাংবাদিকতায় পিছিয়ে থাকা বাঙালি মুসলমানদের স্বার্থে তিনি এই ক্ষেত্রসমূহে কাজ করার দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। মওলানা আকরম খাঁ এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট সফল। তার আলোয় আলোকিত হয়েছে বাঙালি মুসলমানের সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং সাংবাদিকতা। আজকের শক্তিশালী গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠিত হওয়ার নেপথ্যে মওলানার অবদান অনস্বীকার্য। মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ মাদরাসা শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও প্রগতিশীল চিন্তাচেতনার অধিকারী ছিলেন। খেলাধুলার প্রতিও তিনি অনুরাগী ছিলেন এবং মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য ছিলেন।

মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ সাংবাদিকতা এবং সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করে একের পর এক ঝাঁপি খুলে বসলেন। ১৯০৩ সালে মওলানার সম্পাদনায় বাঙালির সহস্র ইতিহাসের সাক্ষী মাসিক ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকার প্রকাশ শুরু হয়। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ১৯১০ সালে দৈনিক ‘খাদেম’ পত্রিকা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯১৩ সালে তার প্রচেষ্টায় ‘আনজুমানে ওলামা’ গঠিত হয় এবং এর মুখপত্র হিসেবে ১৯১৫ সাল হতে প্রকাশিত হয় মাসিক ‘আল এসলাম’। ১৯২০ সালে তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় উর্দু দৈনিক ‘জামানা’ এবং ১৯২১ সালে প্রকাশ শুরু করেন বাংলা দৈনিক ‘সেবক’ পত্রিকা। ১৯২৭ সালে পুনরায় মাসিক ‘মোহাম্মদী’ প্রকাশ শুরু করেন, যা ১৯৭০ সাল পর্যন্ত চালু ছিল। বাংলা একাডেমি, ঢাবি কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়ামসহ প্রাচীন গ্রন্থাগারগুলোতে এখনো সংরক্ষিত আছে মওলানার ‘মোহাম্মদী’ এবং ‘আজাদ’ পত্রিকা।

মওলানা আকরম খাঁ রাজনৈতিক জীবনের প্রথমে কংগ্রেসের সক্রিয় কর্মী ও নেতা ছিলেন। অন্য অনেকেই যখন ইংরেজদের তোষামোদের মাধ্যমে নিজেদের গতি ও গদি ঠিক রাখায় ব্যস্ত ছিলেন, মওলানা তখন ইংরেজ দখলদারদের বিরুদ্ধে সংবাদপত্রে অগ্নিলাল। কংগ্রেসের অসহযোগ আন্দোলনের সমর্থনে জোরালো সম্পাদকীয় লেখার অপরাধে এক বছর কারাদন্ডও ভোগ করেন মওলানা আকরম খাঁ । ১৮১৯ হতে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত তিনি খেলাফত আন্দোলন ও কংগ্রেসের অসহযোগ আন্দোলনে জড়িত ছিলেন। ১৮২০ সালে ঢাকার আহসান মঞ্জিলে অনুষ্ঠিত খেলাফতের সম্মেলনে মওলানা আকরম খাঁ নিখিল ভারত খেলাফত আন্দোলনের সভাপতি নির্বাচিত হন। এ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন মওলানা আবুল কালাম আজাদ, মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, মওলানা মজিবুর রহমানসহ উপমহাদেশের বিশিষ্টজনরা। ১৯২০ হতে ১৯২৩ সাল পর্যন্ত তিনি উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে সভা-সমাবেশ এবং সাংবাদিকতার মাধ্যমে খেলাফত আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলন গতিশীল করার চেষ্টা করেন। অসাম্প্রদায়িক চেতনার মওলানা আকরম খাঁ ১৯২২ সালে চিত্তরঞ্জন দাশের নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গে সংগঠিত হিন্দু-মুসলমান ঐক্য আন্দোলন ‘স্বরাজ’ পার্টির পক্ষ নেন। যদিও বিবিধ কারণে পূর্ববঙ্গের মুসলমানরা স্বরাজের বিপক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছিল। ১৯২৬-১৯২৭ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং সমসাময়িক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে তিনি ভারতীয় রাজনীতির ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন। ১৯২৯ সালে নেহরু রিপোর্টের প্রতিবাদে তিনি কংগ্রেস ত্যাগ করেন। ১৯৩৫ সালে তিনি বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন। বাংলার অবহেলিত মুসলিম সমাজের সার্বিক উন্নতির লক্ষ্যে ১৯৩৬ সালের অক্টোবর মাসে তিনি বাংলা ভাষায় প্রকাশ করা শুরু করেন পূর্ণাঙ্গ জাতীয় দৈনিক ‘আজাদ’। সেসময় এটি ছিল যুগান্তকারী পদক্ষেপ। মওলানা পূর্ববঙ্গে মুসলিম লীগের পক্ষে জনমত সংগ্রহ এবং ‘আজাদ’ পত্রিকার মাধ্যমে জনমত গড়ে পাকিস্তান সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। দৈনিক আজাদের প্রকাশ বাঙালির সাংবাদিকতার ইতিহাসে অবিস্মরণীয় ঘটনা। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর তিনি পূর্ববাংলায় চলে আসেন এবং স্থায়ীভাবে ঢাকায় বসবাস করা শুরু করেন। ১৯৪৭ সালে তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। মওলানার এ ভূমিকাকে স্বাধীন বাংলাদেশে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের মতে, ‘সেদিন পাকিস্তান হয়েছিল বলেই পরে বাংলাদেশ হয়েছে’। ঐতিহাসিক তথ্য ও বর্তমান বাস্তবতার বিচারে পাকিস্তান আন্দোলন ভুল ছিল না। নবাব সলিমুল্লাহ, মওলানা ভাসানী, একে ফজলুল হক, শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সচেতন রাজনৈতিক নেতৃত্ব পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে পাকিস্তান আন্দোলনের একনিষ্ঠ নেতাকর্মী ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে মওলানা আকরম খাঁ সম্পর্কে মূল্যায়ন করেছেন, ‘আমরা তাকে সকলেই শ্রদ্ধা ও ভক্তি করতাম। তার বিরুদ্ধে আমাদের কিছুই বলার ছিল না।’

মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁর জন্ম এমন এক অন্ধকার সময়ে, যখন বিদেশি শাসন-শোষণে বন্দি পুরো উপমহাদেশ। ১৭৫৭ সালে স্বাধীনতা হারানোর পর ১৮৫৭ সালের প্রথম আযাদি আন্দোলনও (সিপাহি বিপ্লব) ব্যর্থ হলে পুরো উপমহাদেশের মানুষ হতাশায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। আন্দোলনে জড়িতদের একে একে দৃশ্যপটের অন্তরালে নিয়ে যায় আধিপত্যবাদী ইংরেজরা। এই বিদ্রোহে নেতৃত্বদানের অভিযোগে শেষ মোগল স¤্রাট কবি বাহাদুর শাহ জাফরকে মিয়ানমারের রেঙ্গুনে (বর্তমান ইয়াঙ্গুন) নির্বাসিত করা হয়। পরিস্থিতি তখন এমন ছিল, মৌলিক অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকাটাও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বিশেষ করে বাঙালি মুসলমানের অবস্থা ছিল খুবই ভয়াবহ ও মানবেতর। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে এর কিঞ্চিত আভাস পাওয়া যায়।

একজন খাঁটি ইংরেজ উইলিয়াম হান্টার তখনকার পরিবেশ সম্পর্কে বলেন, ‘উচ্চস্তরের বা নিম্নস্তরের সব চাকরি ক্রমান্বয়ে মুসলমানদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যে বিশেষ করে হিন্দুদের মধ্যে বিতরণ করা হচ্ছে। সরকার সব শ্রেণির প্রজাকে সমান দৃষ্টিতে দেখতে বাধ্য, তথাপি এমন সময় এসেছে যখন মুসলমানদের নাম আর সরকারি চাকুরেদের তালিকায় প্রকাশিত হচ্ছে না, কেবল তারাই চাকরির জায়গায় অপাঙ্ক্তেয় সাব্যস্ত হয়েছে। সম্প্রতি সুন্দরবন কমিশনারের অফিসে চাকরিতে কতিপয় লোক নিয়োগের দরকারিতা দেখা দেয়, কিন্তু অফিসারটি সরকারি গেজেটে কর্মখালীর যে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন, তাতে বলা হয় যে, এই শূন্য পদগুলোতে কেবল হিন্দুদের নিয়োগ করা হবে। মোটকথা হলো, মুসলমানদের এতটা নিচে ঠেলে দেওয়া হয়েছে যে, সরকারি চাকরির জন্য দরকারি যোগ্যতা অর্জন করা সত্ত্বেও সরকারি বিজ্ঞপ্তি মারফত জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে, তাদের জন্য কোনো চাকরি খালি নেই। তাদের অসহায় অবস্থার প্রতি কারো দৃষ্টি নেই এবং এমনকি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তাদের অস্তিত্ব স্বীকার করতেও রাজি নয়।’ (দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস, পৃষ্ঠা নং ১৫৩-১৫৪)।

এমন অন্ধকারাচ্ছন্ন একটি সময়ে বাঙালি মুসলমানের পথপ্রদর্শক হিসেবে মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁর ভূমিকা নিঃসন্দেহে অবিস্মরণীয়। তিনি এই বিপ্রতীপ পাহাড় দীর্ণবিদীর্ণ করে ধ্বংসস্তূপের ওপর বুক ফুলিয়ে হেঁটেছিলেন। সংবাদপত্র এবং মাঠে-ময়দানে রাজনৈতিক জাগরণের মাধ্যমে তিনি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন অবহেলিত জনপদের অধিকারসমূহ। সানাউল্লাহ নূরীর ভাষায় ‘ভলতেয়ারের তুল্য’ মওলানা আকরম খাঁ তার কর্মময় জীবনে জীবনবোধ ও সুচিন্তার বিস্তর উপাদান রেখে গেছেন। একজন সাহিত্যসাধক এবং সাংবাদিক কীভাবে সমাজ সংস্কার হতে শুরু করে রাজনৈতিক মাঠে তোলপাড় সৃষ্টি করতে পারেন, তার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ। তিনি মুসলিম লীগের নেতা হলেও বাঙালির নিজস্ব রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক অধিকারের ব্যাপারে আপসহীন ছিলেন। সাংবাদিকতা পেশাকে তিনি সত্য উচ্চারণ এবং অধিকার আদায়ের হাতিয়ার করে নেন। ‘বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য পত্রিকা’র মাঘ (১৩২৫) সংখ্যায় রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে মওলানা লেখেন, ‘দুনিয়ায় অনেক রকম অদ্ভুত প্রশ্ন আছে, বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা কী? উর্দু না বাংলা? এই প্রশ্নটা তাহার মধ্যে সর্বাপেক্ষা অদ্ভুত। নারিকেল গাছে নারিকেল ফলিবে, না বেল? ... বঙ্গে মুসলিম ইতিহাসের সূচনা হতে আজ পর্যন্ত বাংলা ভাষাই তাদের লেখ্য, কথ্য ও মাতৃভাষারূপে ব্যবহৃত হইয়া আসিতেছে এবং ভবিষ্যতেও মাতৃভাষারূপে ব্যবহৃত হইবে।’

আব্দুল গাফফার চৌধুরীর ভাষ্যে ‘কিংবদন্তির রাজা’ মওলানা আকরম খাঁ ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর পাকিস্তানি পুলিশের গুলিবর্ষণ এবং সালাম, জব্বার, রফিক, বরকতসহ কয়েকজন বাঙালি ছাত্রকে হত্যার প্রতিবাদে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যপদ হতে পদত্যাগ করেন।

বাঙালির চিন্তার জগতের দিকপাল মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং বঙ্গীয় মানুষের গভীরে প্রোথিত একজন প্রোজ্জ্বল কর্মবীর। আওয়ামী মুসলিম লীগের বিরোধিতা, রবীন্দ্রনাথবিরোধী কিছু কাজ, বঙ্গভঙ্গ ইস্যুতে মওলানা খাঁর ভূমিকা বিতর্কিত ও অগ্রহণীয় হলেও এতদাঞ্চলের কিংবদন্তি সাংবাদিক, কৃতী পুরুষের তালিকা ও চিন্তকসভা হতে সংগত কারণেই তাকে বাদ দেওয়া সম্ভব হবে না। তিনি নিজ কর্মগুণেই বাংলার তারকাকাশে সমুজ্জ্বল।

লেখক : কবি ও কথাশিল্পী

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close