সৈয়দ আসাদুজ্জামান সুহান

  ২৯ মে, ২০১৯

পর্যালোচনা

কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় জাকাত অপরিহার্য

ইসলামের পাঁচটি মূলস্তম্ভের মধ্যে তৃতীয় পর্যায়ে হচ্ছে জাকাত। আল্লাহ্ ও তার প্রদত্ত রাসুলের ওপর ইমান আনা, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা যেমন ফরজ, তেমনিভাবে জাকাত প্রদান করাও ফরজ। অনেকেই জাকাত প্রদান করাটা দয়া করে দান-খয়রাত করার মতোই মনে করেন। তবে এটা সাংঘাতিক রকমের একটি ভুল ধারণা। কেননা, জাকাত অসহায়, দুস্থ লোকদের ওপর ধনীদের করুণা নয়, বরং ধনীদের জাকাতের মালের ওপর অসহায়, দুস্থ লোকদের আল্লাহ প্রদত্ত ন্যায্য অধিকার। ইসলামে যাদের ওপর জাকাত আদায় করা ফরজ, তাদের জাকাত আদায় করতেই হবে। অন্যথায় ধর্মীয় বিধান লঙ্ঘন হবে এবং তার জন্য পরকালে রয়েছে কঠিন শাস্তি। প্রত্যেক মুসলমানকে যেমন জাকাত ফরজ হওয়ার বিষয় সম্পর্কে বিশ্বাস করতে হবে, ঠিক তেমনিভাবে যার ওপর জাকাত ফরজ তাকে তা নিয়মিত পরিশোধও করতে হবে। জাকাত ব্যবস্থা ইসলামের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য। সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে জাকাত ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত অত্যন্ত কার্যকর একটি ব্যবস্থা। ইসলামী শরিয়তে জাকাত প্রদান না করা একদিকে যেমন চরম অপরাধ, ঠিক তেমনি জাকাত সম্পদশালীদের সম্পদে অভাবীদের একটি প্রাপ্য অধিকার হওয়ার কারণে জাকাত পরিশোধ না করলে সমাজের বিরাট একটি অংশ তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় এবং আর্থসামাজিক অবস্থা ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। ইসলাম আল্লাহ প্রদত্ত একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। এ জীবন ব্যবস্থায় সালাতের গুরুত্ব যেমন অপরিহার্য; তেমনি জাকাতের গুরুত্বও অনস্বীকার্য। জাকাতভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সুখী-সমৃদ্ধশালী প্রগতিশীল কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব।

জাকাত শব্দের অর্থ শুচিতা ও পবিত্রতা, শুদ্ধি ও বৃদ্ধি। ইসলামের পরিভাষায় আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে শরিয়ত নির্ধারিত পরিমাণ সম্পদের নির্দিষ্ট অংশ আল-কোরআনে বর্ণিত আট প্রকারের কোনো এক প্রকার লোক অথবা প্রত্যেককে দান করে, ওই দানের মালিক বানিয়ে দেওয়াকে জাকাত বলে। মহান আল্লাহপাক পবিত্র কোরআনে ৮২ বার নামাজের ব্যাপারে তাগিদ প্রদান করার পাশাপাশি ২৮ বার জাকাতের কথা উল্লেখ করেন। আল্লাহপাক ওই ব্যক্তির নামাজ কবুল করেন না, যে সঠিক এবং ইসলাম নির্দেশিত পন্থায় জাকাত আদায় করে না। কেননা আল্লাহতায়ালা নামাজ এবং জাকাতকে একত্র করেছেন। সুতরাং উভয় ইবাদতের মধ্য পার্থক্যকরণ আল্লাহপাক পছন্দ করেন না। কেননা ফরজ আমল হিসেবে নামাজ এবং জাকাত একে অন্যের পরিপূরক। পরিপূর্ণভাবে জাকাত আদায় করার মধ্য দিয়েই সমাজ এবং রাষ্ট্র সংশোধিত হয়ে কালজয়ী এক ইসলামী অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। পবিত্র আল কোরআনের জাকাত দেওয়ার প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘তোমরা নামাজ কায়েম করো, জাকাত প্রদান করো এবং রুকুকারীদের সঙ্গে রুকু করো’ (সুরা বাকারা, আয়াত- ৪৩)। আবার অপর একটি আয়াতে বলেছেন, ‘ঈমানদার লোকদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে, তারা সালাত কায়েম করে, জাকাত পরিশোধ করে এবং আল্লাহর সম্মুখে মাথা নতকারী হয়ে থাকে।’ (সুরা আল-মায়েদা : ৫৫)। জাকাত আদায় না করা শাস্তির প্রসঙ্গে আল্লাহ্তায়ালা বলেছেন, ‘আর যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য পুঞ্জীভূত করে এবং উহা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদেরকে মর্মন্তুদ শাস্তির সংবাদ দাও। যেদিন স্বর্ণ ও রৌপ্য জাহান্নামের অগ্নিতে উহা উত্তপ্ত করা হবে এবং উহা দ্বারা তাদের ললাট, পার্শ্বদেশ ও পৃষ্ঠদেশে দাগ দেওয়া হবে। সেদিন বলা হবে, ইহাই উহা যাহা তোমরা নিজেদের জন্য পুঞ্জীভূত করতে। সুতরাং তোমরা যাহা পুঞ্জীভূত করেছিলে তাহা আস্বাদন করো’ (সুরা তওবা, আয়াত ৩৪-৩৫)। এভাবে আল কোরআনের বিভিন্ন স্থানে জাকাত আদায়ে সুস্পষ্টভাবে বলে দেওয়া হয়েছে। ইসলামী শরিয়াহর সব উৎস অনুযায়ী জাকাত হচ্ছে ফরজে আইন।

ইসলাম সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ধর্ম। একজনের হাতে বিপুল অর্থ-সম্পদ জমা হওয়াকে ইসলাম পছন্দ করে না। ইসলাম চায় ধনী-গরিব সবাই স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করুক। তাই দরিদ্রের প্রতি লক্ষ করে জাকাতের বিধান প্রবর্তন করা হয়েছে। হাদিসের ভান্ডারে সংরক্ষিত হয়েছে জাকাতের বিশেষ গুরুত্বসংবলিত অনেক হাদিস। আবদুল্লাহ বিন উমর (রা.) হতে বর্ণিত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আমাকে মানুষের সাথে যুদ্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যতক্ষণ না তারা সাক্ষ্য দেয়, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসুল আর নামাজ কায়েম করে এবং জাকাত আদায় করে’ (বুখারি, মুসলিম)। জারির ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমরা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে বাইয়াত গ্রহণ করি নামাজ কায়েম করা, জাকাত আদায় করা এবং প্রত্যেক মুসলমানের কল্যাণ কামনার ওপর’ (বুখারি, মুসলিম)। আবু সায়ীদ (রা.) বর্ণনা করেন, একদা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে নসিহত করছিলেন। তিনবার শপথ করে তিনি বললেন, “যে ব্যক্তি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়বে, রমজানের রোজা রাখবে, জাকাত প্রদান করবে এবং সব ধরনের কবিরা গুনাহ থেকে বিরত থাকবে, আল্লাহতায়ালা তার জন্য অবশ্যই বেহেশতের দরজা খুলে দিয়ে বলবেন, ‘তোমরা নিরাপদে তাতে প্রবেশ করো’।” (নাসাঈ : ২৩৯৫)।

ইসলাম চায় দারিদ্র্যমুক্ত পৃথিবী, দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ। আর এ দারিদ্র্যমুক্ত পৃথিবী, সমাজ গঠনে জাকাত অনবদ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। জাকাতের মাধ্যমে সম্পদের প্রবাহ গতিশীল হয়। সম্পদের পরিশুদ্ধি অর্জিত হয়, রাষ্ট্রের অর্থনীতি সচল হয় এবং উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। সমাজে এবং রাষ্ট্রে দারিদ্র্যতা এবং বেকারত্ব হ্রাস পায়। অধ্যাপক বেনহাম বলেন, একবিংশ শতকে কল্যাণ রাষ্ট্র বলতে আর্থসামাজিক নিরাপত্তা উন্নয়নকেই বোঝায়। তার মতে, যে রাষ্ট্র ব্যাপকভাবে জনগণের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে, তাই কল্যাণ রাষ্ট্র। আর সামাজিক নিরাপত্তা বলতে রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের ন্যূনতম অর্থনৈতিক প্রয়োজন পূরণের নিশ্চয়তাকেই বোঝায়। কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ইসলামের জাকাত ব্যবস্থা অতুলনীয় ও অপরিহার্য। যে সমাজের বা রাষ্ট্রের ধনীরা সঠিকভাবে জাকাত আদায় করবে, সেই সমাজে বা রাষ্ট্রের দরিদ্র লোকদের আর্থসামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। পুঁজিবাদী ও সমাজতন্ত্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সমাজের বা রাষ্ট্রের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর লোকদের ধনীদের করুণার দিকে তাকিয়ে থাকা লাগে। পক্ষান্তরে ইসলামে বিধান করে ধনীর নির্দিষ্ট সম্পদের ওপরে গরিবের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে। তাই জাকাত ফরজ হওয়া প্রত্যেক ধনী মুসলিম গরিবের হক আদায় করতে জাকাত প্রদানে বাধ্য। এ কারণে আবু বকর (রা.) বলেছেন, ‘যারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে একটি উটের রশিও জাকাত হিসেবে আদায় করত আর এখন তারা যদি জাকাত দিতে অস্বীকার করে, আমি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলাম’ (বুখারি : ১৩১২)। তার এ ভাষণের মর্মার্থই ছিল মানুষের অধিকার নিশ্চিত করা, যাতে কেউ কাউকে তার অধিকার হতে বঞ্চিত করতে না পারে। ইসলামের শেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ৬২২ সালে মদিনায় গিয়ে ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা চালু করেন, তখন থেকে সে রাষ্ট্রে জাকাত ব্যবস্থা চালু হয়। সেখানে তিনি সব ধর্মাবলম্বী লোকদের নিয়ে সুন্দর একটি সামাজিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। যেখানে রাষ্ট্রের প্রত্যেক মানুষের আর্থসামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। উনার প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা সারা পৃথিবীতে একটি রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃতি।

ইসলামী চিন্তাবিদরা বলেছেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জাকাতদাতারা জাকাত প্রদানে দাম্ভিকতা প্রকাশ করেন। তাদের মানসিকতা এমন, তারা বিশাল দানবীর, গরিবের মাঝে দান-খয়রাত করছেন। এভাবে জাকাত প্রদান করলে জাকাত হিসেবে নয়, বরং সেটা দান হিসেবে গণ্য হবে। সেই দান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন কবুল করবেন কি না, তাতে সন্দেহ আছে। জাকাত প্রদানের সময় মনে রাখতে হবে, তার সম্পদের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের ওপর গরিবের হক আছে। তিনি সেই হক আদায় করছেন। বিষয়টি এমন, জাকাতদাতা হচ্ছেন দেনাদার ও জাকাতগ্রহীতা হচ্ছেন পাওনাদার। পাওনাদারকে যেভাবে অর্থ পরিশোধ করতে হয়, ঠিক তেমনিভাবেই জাকাত প্রদান করতে হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশের অধিকাংশ ধনী লোক জাকাত প্রদান করেন না। যারাও জাকাত প্রদান করছেন, তারাও সঠিকভাবে দিচ্ছেন না। ইসলাম ধর্মের দর্শন অনুযায়ী রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জাকাত আদায় এবং সেটির ব্যবস্থাপনা করার কথা। কিন্তু কোনো রাষ্ট্র যদি ইসলামিক রাষ্ট্র না হয়, তা হলে সেখানকার নাগরিকরা নিজ উদ্যোগে তার উদ্বৃত্ত সম্পদ হিসাব করে জাকাত দিতে হবে। কর্মঠ গরিবদের আত্মকর্মসংস্থানে সহায়তা করে স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য জাকাতের অর্থ ব্যয় করা যায়। দ্বীনের প্রসারে ও দ্বীনি শিক্ষার বিস্তারে জাকাতের অর্থ ব্যয় করা যায়। যথার্থ কারণে ঋণগ্রস্ত এবং ঋণ পরিশোধে অক্ষম হয়ে পড়লে তাদের ঋণমুক্তির জন্য জাকাতের অর্থ দিয়ে সাহায্য করা যায়। সফরকারী যদি আর্থিক অসুবিধায় পতিত হন, তবে তাকে জাকাতের অর্থ দিয়ে সাহায্য করা যায়, যদিও তার বাড়ির অবস্থা ভালো।

জাকাত আর্থসামাজিক উন্নয়নের চালিকাশক্তি। আর্থসামাজিক উন্নয়নের অর্থ ক্ষুধা-দারিদ্র্য, সন্ত্রাস-নৈরাজ্য, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, হতাশা, শ্রেণিবৈষম্য, অসহনশীলতা, অনৈক্য, দুশ্চিন্তামুক্ত, পারস্পরিক সহযোগিতা-সহমর্মিতা এবং কল্যাণ কামনার বুনিয়াদে সব সামাজিক শ্রেণিবৈষম্য দূর হয়ে সাম্য মৈত্রী ভ্রাতৃত্ব কল্যাণময়তা বিরাজ করে। পরস্পর এগিয়ে আসে একে অপরের দুঃখ-দুর্দশা মোচন করতে। ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দূর করে ভ্রাতৃত্ব ও ভারসাম্যমূলক এ সামাজিক ব্যবস্থার নাম আর্থসামাজিক উন্নয়ন। যে সমাজ আমাদের কাছে স্বপ্নের সোনার হরিণ, আজকের আধুনিক ধনতান্ত্রিক বিশ্ব যে সমাজের কথা কল্পনাও করতে পারে না, সে সমাজ উপহার দিয়েছে ইসলাম এখন থেকে আরো প্রায় ১৫০০ বছর আগে। খুন, রাহাজানি, হত্যা-কলহ, সুদ, ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অন্যায়-অবিচার, অনৈতিকতা, শ্রেণিবৈষম্য, জিনা ব্যভিচার, হত্যা ধর্ষণসহ সব অন্যায় অসামাজিক কাজ ছিল যে সমাজের অলংকার, সে শতধাবিভক্ত সমাজকে বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.) স্বপ্নের সোনালি সমাজে পরিণত করেছিলেন ইসলাম নামক শান্তির নির্ঝরণীয় মাধ্যমে। জাকাত ছিল যে সমাজের সব আর্থসামাজিক উন্নয়নের রূপকার। ইসলামী সোনালি শাসনকালের ইতিহাসে এমন একসময় ছিল যখন জাকাত নেওয়ার মতো লোক ছিল না। তখন মুসলিম, খ্রিস্টান, ইহুদি সব নাগরিক তার অভাব মোচনে সক্ষম ছিল। শাসকবর্গ জাকাতের অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা রাখত। এখনো সে পরিবেশ আসতে পারে, যদি জাকাতভিত্তিক অর্থনীতি এবং সুষম বণ্টননীতি নিশ্চিত করা যায়।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close