নিতাই চন্দ্র রায়

  ২৬ মে, ২০১৯

পর্যালোচনা

চিনিশিল্প সংকট উত্তরণের পথ

সময়মতো আখ বিক্রির টাকা না পেয়ে ক্ষোভে-দুঃখে জমি থেকে আখ উপড়ে ফেলেছেন জয়পুরহাট চিনিকলের কৃষক। আখের বদলে আবাদ করেছেন অন্য ফসল। চাষিদের কথাÑ তিন মাস আগে তারা আখ বিক্রি করেছেন। কিন্তু এখনো টাকা পাননি। তাহলে তাদের সংসার চলে কীভাবে? ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচই আসে কোত্থেতে? যে ফসল বিক্রি করে দিনের পর দিন পাওনা টাকার জন্য ধরনা দিতে হয়, সেই ফসল আবাদ না করাই ভালো। জয়পুরহাট চিনিকলের ইবনে আল মাসুদ এ বছর নিজের ছয় বিঘা জমিতে আখ চাষ করেছিলেন এবং মামার সঙ্গে যৌথভাবে করেছিলেন আরো ১৬ বিঘা জমিতে। চিনিকল কর্তৃপক্ষের কাছে তার পাওনা ছিল ৬ লাখ টাকা। সেই টাকা সময়মতো না পাওয়াতে অভিমানে তিনি ১৬ বিঘা জমির আখ উপড়ে ফেলেন। তার মতো জয়পুরহাট সদর উপজেলার গাড়িয়াকান্ত গ্রামের আর একজন চাষি হাফিজার রহমান আখ বিক্রি করে সময়মতো আখের মূল্য আড়াই লাখ টাকা না পেয়ে দুই একর জমির আখ তুলে ফেলে ওই জমিতে কলার চাষ করেন। এভাবে জয়পুরহাট চিনিকলের বিভিন্ন সাবজোন থেকে ৩০০ থেকে ৩৫০ একর জমির আখ তুলে ফেলেছেন কৃষকেরা। এটা শুধু জয়পুরহাট চিনিকলে নয়; অন্যান্য চিনিকলেও এ ধরনের দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে।

আখ একটি দীর্ঘমেয়াদি ফসল। রোপণ থেকে কাটা পর্যন্ত ১২ থেকে ১৪ মাস সময়ের প্রয়োজন হয়। এই সময়ে আমন ধান, আলু ও ভুট্টার মতো তিনটি ফসলের চাষ করে আখের চেয়ে অনেক বেশি অর্থ আয় করা যায়। তারপরও সেই আখ বিক্রি করে যদি সময়মতো মূল্য না পাওয়া যায়, তাহলে আখের আবাদ করবে কেন কৃষক! আজ থেকে প্রায় তিন মাস আগে দেশের ১৫টি রাষ্ট্রায়াত্ত চিনিকলে আখ সরবরাহ করেন কৃষক।চিনি বিক্রি না হওয়ার কারণে আখ বিক্রির টাকা না পেয়ে মহা বিপদে পড়েছেন কৃষক। সরকারি ১৫টি চিনিকলের কাছে আখচাষিদের পাওনা রয়েছে ১৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে আখের মূল্য ১১৯ কোটি টাকা এবং বীজের মূল্য ৩১ কোটি টাকা। আখচাষিদের পাওনা ১৫০ কোটি টাকা আসন্ন ঈদের আগে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনকে পরিশোধের পরামর্শ দিয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। কমিটির এই উদ্যোগকে আমার অভিনন্দন জানাই।

এরকম তো ছিল না দেশের কৃষিভিত্তিক একমাত্র ভারী প্রতিষ্ঠান চিনিশিল্প। আখ বিক্রির সঙ্গে সঙ্গেই কৃষক আখের মূল্য পেতেন। মনের আনন্দে নতুন আখ রোপণ করতেন। মুড়ি আখের যতœœ নিতেন। সময়মতো সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করে আখের ফলন বাড়নোর চেষ্টা করতেন। বেশি দিনের কথা নয়, ১৯৮৯-৯০ মাড়াই মৌসুমে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন ২০ লাখ ৯৬ হাজার ২০৩ মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে ১ লাখ ৮৩ হাজার ৮৬২ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদন করে। সে সময় চিনি আহরণের হার ছিল ৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ। পরবর্তী সময়ে ২০০০-২০০১ মাড়াই মৌসুমে ১৩ লাখ ৬৯ হাজার ২৬ মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে ৯৮ হাজার ৩৫৫ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদন করে বিএসএফআইসি। ওই মাড়াই মৌসুমে চিনি আহরণ হার ছিল ৭ দশমিক ১১ শতাংশ। এরপর জলবায়ু পরিবর্তন, তুলনামূলক কম সূর্যালোক ঘণ্টা, আগাম আখ চাষের জমির পরিমাণ হ্রাস, নিচু জমিতে আখ চাষ, উচ্চ চিনি আহরণযুক্ত ইক্ষু জাতের অভাব, অপরিপক্ব আখ মাড়াই, পুরাতন যন্ত্রপাতি ও মিলের যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে কমতে থাকে চিনি আহরণ হার ও মোট চিনি উৎপাদন।

বাংলাদেশে আখই একমাত্র ফসল, যা কৃষক সরকার নির্ধারিত দামে সরাসরি মিলে সরবরাহ করতে পারেন। আখের মূল্য মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে কৃষককে প্রদান করা হয়। আখকে বলা হয় বিমাকৃত ফসল। কারণ খরা, অতিবৃষ্টি, ঝড়, বন্যা এবং রোগও পোকা মাকড়ের আক্রমণেও আখ ফসল একেবারে নষ্ট হয় না। বঞ্চিত করে না কৃষককে। অর্থ সংকটের কারণে চিনিকলগুলো এখনো আখের জমিতে উপরি প্রয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় সার ও কীটনাশক সংগ্রহ করতে পারেননি। উপরি সার ও কীটনাশক প্রয়োগের সময় দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে। সময়মতো উপরি সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করতে না পারলে আখের ফলন শতকরা ২৫ থেকে ৩০ ভাগ হ্রাস পাবেÑ এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। গত ২০১৮-১৯ মাড়াই মৌসুমে ১৫টি চিনিকলের আখ মাড়াই ও চিনি উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল যথাক্রমে ১৬ লাখ ৮২ হাজার ও ১ লাখ ২৫ হাজার মেট্রিক টন। ওই লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ১১ লাখ ৮২ হাজার মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে ৬৮ হাজার ৯৫২ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদন করা হয়। জুন মাসের পর বর্ষা শুরু হলে আখের জমিতে আর উপরি সার ও কীটাশক প্রয়োগ করা সম্ভব হবে না। এ কারণে আগামী মাড়াই মৌসুমে আখের স্বল্পতার কারণে চিনিকলগুলোতে চিনি উৎপাদনের পরিমাণ আরো হ্রাস পাবে এবং লোকসানের পরিমাণও বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। তাই সার ও কীটনাশক ক্রয়ের জন্য মিলগুলোকে যত শিগগির সম্ভব প্রয়োজনীয় অর্থ সররাহ করতে হবে।

তথ্যমতে, ২০১২-১৩ অর্থবছরে চিনিকলগুলো লোকসান ছিল ৩১৪ কোটি টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সেটি বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৬৪১ কোটি টাকায়। আর গত অর্থবছরে ১৪টি চিনিকলের লোকসান হয় ৮৩৪ কোটি টাকা। বাংলাদেশ চিনি ও শিল্প করপোরেশনের (বিএসএফআইসি) অধীনে থাকা ১৬টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানে মধ্য লাভ করেছে শুধু দুটি প্রতিষ্ঠান। দর্শনার কেরু অ্যান্ড কোম্পানি ও কুষ্টিয়ার রেনউইক যজ্ঞেশ্বর অ্যান্ড কোম্পানি। লাভে থাকা কেরুর চিনি কারখানা ছাড়াও আছে ডিস্টিলারি ইউনিট, বাণিজ্যিক খামার পরীক্ষামূলক খামার ও জৈবসার কারখানা। সব মিলিয়ে কেরু গত অর্থবছরে লাভ করেছে ৫ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। অবশ্য ২০১৪-১৫ অর্থবছরের কেরুর লাভ ছিল ৯ কোটির টাকার বেশি। কুষ্টিয়ার রেনউইক অ্যান্ড যজ্ঞেশ্বর কোম্পানি গত বছর লাভ করেছে ৬ কোটি টাকা।

১৫টি চিনিকলের বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ২ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন হলেও বর্তমানে বছরে চিনি উৎপাদন হচ্ছে মাত্র ৭০ লাখ টনের মতো অর্থাৎ উৎপাদন ক্ষমতার মাত্র তিন ভাগের এক ভাগ। আখের স্বল্পতাই উৎপাদন ক্ষমতা অনুযায়ী চিনি উৎপাদন না হওয়ার অন্যতম কারণ। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর আখ চাষিদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তিনবার আখের দাম বৃদ্ধির পরও মিল এলাকায় লক্ষ্যমাত্রা মোতাবেক হচ্ছে না আখ চাষ । বর্তমানে মিল গেটে প্রতি মণ আখের দাম ১৪০ টাকা। সে হিসাবে ১০০ কেজি আখের দাম ৩৫০ টাকা। সদ্যসমাপ্ত মাড়াই মৌসুমে করপোরেশনের গড় চিনি আহরণ হার ছিল ৫ দশমিক ৮৩ শতাংশ। সে অনুযায়ী ১০০ কেজি আখ থেকে চিনি পাওয়া যায় ৫ কেজি ৮৩০ গ্রাম। ৫০ টাকা কেজি হিসেবে যার বর্তমান বাজার মূল্য ২৯১ দশমিক ৫০ টাকা। অর্থাৎ ১০০ কেজি আখ থেকে যে চিনি পাওয়া যায় তা বিক্রি করে আখের দামই উঠে না। তারপরতো রয়েছে উৎপাদন উপকরণÑ চুন, সালফারের দাম, জ্বালানি খরচ, শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতনÑভাতা, আখ পরিবহন খরচ এবং যন্ত্রপাতি মেরামতসহ অন্যান্য ব্যয়। এ অবস্থাতে চিনিকলগুলো লাভ করবে কীভাবে? দেখা গেছে, সরকারিভাবে চিনির দাম ৬০ টাকা নির্ধারণ করলে বেসরকারি পরিশোধন কারখানগুলো তাদের পরিশোধিত চিনি ৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করে। আবার চিনির দাম কমিয়ে সরকার প্রতি কেজির দাম ৫০ টাকা নির্ধারণ করলে পরিশোধন কোম্পানিগুলো বিক্রি করে ৪৮ টাকা কেজিতে। অন্যদিকে পরিশোধন কারখানাগুলোর উৎপাদিত চিনির রং ধবধবে সাদা। এসব কারণে সরকারি চিনিকলে উৎপাদিত চিনি বিক্রি হয় না। দেশে বর্তমানে ছয়টি চিনি পরিশোধন কারখানা রয়েছে। এসব কারখানাগুলো ব্রাজিল ও থাইল্যান্ড থেকে র-সুগার আমদানি করে পরিশোধন করে বাজারজাত করছে। এসব পরিশোধন কারখানাগুলোর বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ৩২ লাখ মেট্রিক টন। আর দেশের বার্ষিক চিনির চাহিদা ১৪ লাখ টন। শর্ত ছিল পরিশোধন কারখানাগুলো তাদের উৎপাদিত চিনির ৫০ শতাংশ বিদেশে রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করবে। কিন্তু তারা সে শর্ত ভঙ্গ করে বিদেশে রফতানি না করে উৎপাদিত সমুদয় চিনিই দেশে বাজারজাত করছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের কৃষিভিত্তিক চিনিশিল্প ও চাষিরা।

আখচাষিদের উৎপাদিত সমুদয় আখ সরকার নির্ধারিত দামে ক্রয় করে। আখের মূল্য হিসাবে চিনিকলগুলো চাষিদের মধ্যে কোটি টাকা বিতরণ করে, যা গ্রামীণ অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে এবং এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত প্রায় অর্ধকোটি মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখে। চিনিকল এলাকায় অনেক কৃষক আছেন যাদের পাকা বাড়ি নির্মাণ হয়েছে আখের টাকায়। যাদের মেধাবী ছেলেমেয়েরা মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছেন আখ বিক্রির অর্থে। চিনিকলগুলো চিনি উৎপাদনের সঙ্গে অনেক সামাজিক দায়িত্ব পালন করে, তাতে লাভবান হচ্ছেন দেশের ক্ষুদ্র প্রান্তিক কৃষক ও ভোক্তা সাধারণ। সে হিসেবে চিনি পরিশোধন কারখানাগুলোর দ্বারা এ দেশের কৃষকের কোনো উপকারই হচ্ছে না। উপকার হচ্ছে ব্রাজিল ও থাইল্যান্ডের কৃষকের। আমরা সবাই বলি, কৃষক বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে। সেটা যদি সত্য হয়, তা হলে আর দেরি না করে অনতিবিলম্বে চাষিদের পাওনা আখের মূল্য পরিশোধে সরকারকে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। সেই সঙ্গে চিনিকলগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার ব্যাপারেও সঠিক ও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে সরকারকেই। অন্যথায় সরকারি চিনিকলগুলো বন্ধ হলে বেসরকারি পরিশোধন কারখানাগুলোর একচেটিয়া ব্যবসার কারণে দেশবাসীকে বর্তমানের দ্বিগুণ দামে চিনির স্বাদ ভোগ করতে হবে একথা নিশ্চিত করে বলা যায়।

লেখক : সাবেক মহাব্যস্থাপক (কৃষি)

নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস লিমিটেড, নাটোর

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close