অলোক আচার্য

  ২৪ মে, ২০১৯

ইয়ামেন

মানবিক অধ্যায়ের বিপরীতে

আরব বিশে^র সবচেয়ে দরিদ্র রাষ্ট্র ইয়েমেন। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা গৃহযুদ্ধের কারণে আজ পুরোপুরি বিপর্যস্ত। ক্ষমতার লড়াই কোনো দেশের জন্য কতটা নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে আধুনিক সমাজে ইয়েমেন তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। গৃহযুদ্ধে ইয়েমেন এখন পুরোপুরি ধ্বংস হওয়ার পথে। মানব ইতিহাসের অন্যতম প্রাচীন বসতির সাক্ষ্য বহনকারী এ দেশের প্রত্যেক মানুষ বর্তমান অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য ব্যাকুল। জাতিসংঘের মতে, বর্তমান বিশে^র সবচেয়ে ভয়াবহ মানবসৃষ্ট মানবিক বিপর্যয় ঘটেছে ইয়েমেনে। দীর্ঘদিন ধরে দেশটিতে যুদ্ধাবস্তা চলায় এ অবস্থার সৃষ্টি। সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন জোটের হামলায় সেখানে এ পর্যন্ত নিহত হয়েছে বহু বেসামরিক মানুষ। ধ্বংস হয়েছে দেশটির স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্র, পানি শোধন কেন্দ্রসহ সব ধরনের সেবামূলক স্থাপনা। গত তিন বছরে সেখানে ২ লাখ ৩৩ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে; যার মাঝে ১ লাখ ৪০ হাজার শিশু। যার অধিকাংশই বেসামরিক নাগরিক এবং প্রতি ১২ মিনিটে মারা যাচ্ছে এক শিশু। সে হিসাবে ১২০ শিশু মারা যাচ্ছে প্রতিদিন। এ ছাড়াও পাঁচ বছরের নিচের ৪ লাখ শিশু চরম অপুষ্টিতে ভুগছে। সেখানকার শিশুরা জানে না তারা পরবর্তীতে কী খাবে।

তিন বছর আগে হুতি বিদ্রোহীরা রাজধানী সানাসহ ইয়েমেনের অনেক এলাকা দখল করে নিলে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স সমর্থিত সৌদি আরব আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত দেশটির সরকারের পক্ষ নিয়ে হুতিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। তবে ইয়েমেনের এ সংকটকে সৌদি আরব আর ইরানের মধ্যে আঞ্চলিক ক্ষমতার লড়াই হিসেবেও দেখা হচ্ছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান সম্পর্ক উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। কৌশলগতভাবে ইয়েমেনের নিয়ন্ত্রণ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ দেশটি বাব আল-মানডারের ওপর বসে আছে, যা রেড সি আর গালফ অব এডেনের সংযোগস্থল। এখান থেকেই বিশে^র সবচেয়ে বেশি তেলের সরবরাহ হয়ে থাকে। ক্রমাগত যুদ্ধের ফলে গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ধ্বংসের পাশাপাশি দেশটিতে ভয়াবহ অর্থ তারল্যের সৃষ্টি হয়েছে। জিনিসপত্রের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। যা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে সাধারণত ঘটতে পারে, ইয়েমেনে সেটাই ঘটছে। এ পরিস্থিতি তৈরির জন্য সৌদি আরবের রণনীতিকেই দায়ী করা হচ্ছে। জাতিসংঘ কর্মকর্তারা বলেছেন, ইয়েমেনে সৌদি আরব নিকৃষ্টতম কৌশল ব্যবহার করছে; যা বোমা মেরে বা স্থাপনা উড়িয়ে দেওয়ার চেয়েও ভয়াবহ। সেটা হলো সৌদি আরবের অর্থনৈতিক অবরোধ। যার পরিণতিতে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। ধ্বংসের অনুপাতে এর ব্যাপকতা ও স্থায়িত্ব অনেক বেশি। বলা চলে যুদ্ধ আর অবরোধে পুরোপুরি বিধ্বস্ত ইয়েমেনের সমাজ। এখনো আশপাশের বাজারগুলোতে খাবার জিনিস পাওয়া যায়। তবে সেগুলোর দাম এত বেশি যে, অধিকাংশ বাবারই তার ক্ষুধার্ত সন্তানের জন্য খাবার কেনার সামর্থ্য নেই। বেশ কয়েক মাস আগে আমাল হোসেন নামের ছোট একটি শিশুর ক্ষুধায় কাতর হয়ে মারা যাওয়ার ছবি বিশ^ দেখেছিল। আমালের মতো বহু শিশু দুর্ভিক্ষের কবলে রয়েছে ইয়েমেনে। ইয়েমেনের এ অবস্থাকে ভয়াবহ বলা হচ্ছে। মানুষের তৈরি করা লোভ আর ক্ষমতার দ্বন্দ্বের জেরে চলা যুদ্ধ দীর্ঘদিন ধরে চললে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। শতাব্দীর ভয়াবহতম সেই দুর্ভিক্ষের মুখে আজকের ইয়েমেন। ইয়েমেনের পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপ হচ্ছে। একদিকে বিশে^র বড় বড় ধনী দেশগুলো যখন প্রতিদিন খাবারের একটি অংশ নষ্ট করে তখন ইয়েমেন দুর্ভিক্ষে। বিশ^ বিবেক আজ বড় নিশ্চুপ মনে হয়। ইয়েমেনে বর্তমানে ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ অনাহারের শিকার বলে সতর্কতা জানানো হয়েছে জাতিসংঘ থেকে। এ ছাড়াও ইয়েমেনে অন্তত ১৮ লাখ শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে বলে জানা গেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী অবস্থা সম্পর্কে জানলেই দেখা যায়, ফেলে যাওয়া কিছু ধ্বংসাত্মক অবস্থা ছাড়া আর কিছুই নেই। সে অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়াতে সময় লেগেছে বহু বছর। কোটি কোটি মানুষের ক্ষুধার চিৎকার আধুনিক অস্ত্রের শব্দের কাছে বড়ই মøান মনে হয়। এটাই বুঝি বাস্তবতা। ইয়েমেনে বর্তমানে ২০ মিলিয়নের বেশি মানুষ না খেয়ে বসবাস করছে। কোনো ধরনের মানবিক সহায়তা ছাড়াই তারা বসবাস করছে। এরাও বাস্তবিকপক্ষে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে। ইউনিসেফের আঞ্চলিক পরিচালক জিয়র্ট কাপপেলারি এ অবস্থাকে ’জীবন্ত নরক’ বলে অভিহিত করেছেন। ইয়েমেনে নিয়োজিত জাতিসংঘের মানবিক সহায়তার সমন্বয়কারী লিস গ্রান্ডে বলেছেন, ইথিওপিয়ার মতোই ইয়েমেনে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে। প্রসঙ্গত, ইথিওপিয়াতেও একসময় দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। যুদ্ধ কেবল ধ্বংস করতে পারে। পৃথিবীতে যত যুদ্ধ হয়েছে সব জায়গাতেই রয়েছে মানুষের আর্তনাদ। ইয়েমেনের এ সংকট আঞ্চলিক ক্ষমতা এবং আধিপত্যের দ্বন্দ্ব। তবে সবার আগে ইয়েমেনের জনগণের স্বার্থ এবং সে দেশের বর্তমান ভয়াবহতম পরিস্থিতির দিকেই মনোনিবেশ করা দরকার।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close