রায়হান আহমেদ তপাদার

  ২৪ মে, ২০১৯

মুক্তমত

আদর্শনির্ভর রাজনীতি আজ নির্বাসিত

ইউরোপে গণতন্ত্র ফ্যাসিবাদের কাছে বারবার মার খেয়ে শিক্ষা নিয়েছে। ফলে গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখার স্বার্থে জার্মানিসহ কোনো কোনো দেশে এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, যাকে আপাতদৃষ্টিতে গণতন্ত্রবিরোধী মনে হতে পারে। জার্মানিতে ফ্যাসিবাদের পতনের সত্তর বছর পরও নাৎসি দল এবং তাদের নেতার নামোচ্চারণ নিষিদ্ধ। হাই হিটলার স্লোগান দেওয়া আইনত অপরাধ।

গণতন্ত্রে যা খুশি তা করার অধিকার নেই। গণতন্ত্র এখন নানা সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত। গ্রিক সিটি স্টেটের গণতন্ত্র আর ওয়েস্ট মিনিস্টার গণতন্ত্রের চেহারা এক নয়। কিন্তু গণতন্ত্রের কোনো সংজ্ঞায় তার এক গালে চড় মারলে আরেক গাল পেতে দেওয়ার কথা বলা হয়নি। গণতন্ত্রবিরোধী শক্তির সঙ্গে আপস করে, যুদ্ধ এড়িয়ে গণতন্ত্র নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছে এমন দৃষ্টান্ত বিরল। ভারতের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীকে হত্যার দায়ে হিন্দু মহাসভার মতো বিরাট দলকে নেহেরু সরকার বেআইনি ঘোষণা করেছিলেন। সেই হিন্দু মহাসভার পুনরুজ্জীবন ঘটানো আর সম্ভব হয়নি। হিন্দু মহাসভাপন্থিরা অন্য সেক্যুলার নাম গ্রহণ করে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেছে, ক্ষমতায় গেছে। কিন্তু ‘হিন্দু মহাসভা’ নামে আর রাজনীতি করতে পারেনি। গণতন্ত্র বলতে বলতে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে। গণতন্ত্র মানুষের ভোটাধিকারের দাবি তুলতে তুলতে স্বাধীন বাংলাদেশের দুই যুগ কেটে গেছে। গণতন্ত্রকে শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক রূপ, সৎ মানুষের রাজনীতি, দলীয়করণ মুক্ত প্রশাসন স্বাধীন ও শক্তিশালী সকল সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে দাবি উঠেছে বিরামহীন।

অপরদিকে হরতাল, অবরোধ ও প্রতিহিংসা ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে বিরামহীন কথাবার্তা চলছে। দুর্বৃৃৃত্তায়নের কবল থেকে, লুটেরা সংস্কৃতি আগ্রাসন থেকে রাজনীতিকে মুক্ত করার কথাবার্তাও ঢের হয়েছে। কাজের কাজ কিছুই হয়নি। দিনে দিনে জনগণের হৃদয় নিঃসৃত এসব চাওয়া কার্যত নির্বাসিত হয়েছে। দেশজুড়ে উন্নয়ন হচ্ছে কিন্তু তাই বলে থেমে নেই দুর্নীতি। ব্যাংকের সংখ্যা অনেক বেড়েছে, থামানো যায়নি ব্যাংক কেলেঙ্কারি। অর্থনৈতিক অগ্রগতি হলেও দেশের বাইরে টাকা পাচার থামছে না। রাজনীতি হয়ে উঠেছে জীবিকা নির্বাহের মাধ্যমই নয় রাতারাতি বিত্ত-বৈভব ও ক্ষমতার মালিক হওয়ার পরম আশ্রয়। সম্পদ পাহারার ছায়াই নয় অন্যের জায়গা সম্পত্তি দখলের শক্তি। আত্মত্যাগের পথে মানব সেবার রাস্তা থেকে ব্যক্তি, গোষ্ঠী স্বার্থের ভোগ বিলাসের পথ নিয়েছে রাজনীতি। গণসম্পৃক্ত বড় দলগুলোর মধ্যে ক্ষমতা নির্ভর রাজনীতির বিপরীতে আদর্শনির্ভর রাজনীতি নির্বাসিত। এই অসুস্থ প্রতিযোগিতার সড়ক দ্বীপে দাঁড়িয়ে কোনো দলই দাবি করতে পারছে না, সংবিধান, আইন, বিধিবিধান অনুযায়ী গণতান্ত্রিক, নির্লোভ, আদর্শিক রাজনীতির উত্তরাধিকারিত্ব বহন করছে। যারা রাজনীতিবিদ ও রাজনীতিকে সংস্কার করতে এসেছিলেন সেসব গণবিচ্ছিন্ন সুশীলেরা আরও বেশি ভুলের স্বাক্ষর রেখে ব্যর্থতার কলঙ্ক মাথায় নিয়ে বিদায় নিয়েছেন।

ইতিবাচক রাজনীতির নামে সরকার বন্দনায় সরকারি দলের এমপিদের চেয়ে সংসদের বিরোধীরা বেশি এগিয়ে। তার চেয়ে বেশি এগিয়ে আওয়ামী লীগ জোটের সেকালের বিপ্লবীরা। হঠকারী, সহিংস, গণবিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচি নিতে গিয়ে শক্তিশালী বিরোধী দল বিএনপির কোমর খানিকটা ভাঙা। মামলা-মোকদ্দমা ও নির্বাসনের জালে বন্দি নেতাকর্মীরা। একটি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় বা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যে রাজনীতির চিত্রপট সামনে থাকার কথা সেটি দৃশ্যমান নয়। রাজনীতির গতিপ্রকৃতি যখন নিস্তরঙ্গ হয়ে যায় তখন গণতান্ত্রিক চিন্তা চেতনায় বেড়ে ওঠা মানুষেরাও প্রাণহীন হয়ে পড়ে। গণতন্ত্রের চিরচেনা পথগুলো যখন হারিয়ে যায় তখন শাসক দলের নেতাকর্মীরা উন্নাসিক, বেপরোয়া ও অতিকথনে ডুব দেয়।

সরকারের দুইজন মন্ত্রী অতিকথনের কারণে উচ্চ আদালতের দ- ভোগ করছেন। পূর্ণাঙ্গ রায় বের হলেই তাদের ভাগ্য নির্ধারণ হবে। কিন্তু জাতীয় নির্বাচন থেকে ইউপি নির্বাচন পর্যন্ত গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় মানুষের অবাধ ভোটাধিকারের দৃশ্যপট হোঁচট খেয়েছে। কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সৎ, গণমুখী, আদর্শবান রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা নির্বাচনের যোগ্যতা হারাচ্ছেন। অর্থ ও পেশীশক্তির প্রবল দাপট নিয়ে যারা রাজনীতিতে আসছেন তাদের জন্য আদর্শবান, সৎ নেতাকর্মীরা কোণঠাসা হতে হতে সরে দাঁড়াচ্ছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভোটের ময়দানে কেন্দ্র দখল, ভোট ডাকাতি, মিডিয়া ক্যু, পেশিশক্তি ও কালো টাকা নির্ভর ভোটযুদ্ধে অসহায়ের মতো পরাজয় দেখেছেন সবচেয়ে বেশি আওয়ামী লীগের গণমুখী নেতাকর্মীরা।

সময়ের বাঁকে বাঁকে ব্যবসা বাণিজ্য, সামাজিক প্রভাব-প্রতিপত্তি ও আধিপত্য বিস্তারের রুগ্ন রাজনীতির ধারায় যুক্ত হয়েছেন সামরিক বেসামরিক আমলাদের পাশাপাশি ব্যবসায়ী, ঠিকাদার এক কথায় অর্থ ও পেশিশক্তি নির্ভর ব্যক্তিরা। সেদিনের আওয়ামী লীগে ছাত্রজীবন থেকে দলীয় রাজনীতিতে পথ হাঁটা আদর্শবান নেতাকর্মী, আইনজীবী, শিক্ষকরা মনোনয়ন পেতেন। একালে দৃশ্যপট এতোটাই বদলে গেছে যে, সংগঠন পরিচালনার ধ্যান-ধারণায় যেমন পরিবর্তনের হাওয়া দেখা দিয়েছে, সামরিক শাসকদের প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর মতো গণতান্ত্রিক ফরমানে উপর থেকে যেমন তৃণমূল নেতা বসিয়ে দিচ্ছেন তেমনি একজন পেশাদার আইনজীবী বা শিক্ষকের মনোনয়ন লাভ অলৌকিক স্বপ্নের মতো হয়ে উঠেছে। আজকের রাজনীতির ধারায় তৃণমূল আওয়ামী লীগ নেতাদের মুখেই উচ্চারিত হয়েছে আদর্শবানদের বদলে হাইব্রিড সুবিধাবাদীরা দলকে গ্রাস করেছে। মনোনয়ন বাণিজ্য ও কমিটি বাণিজ্যের কলুষতা থেকে ভোগবাদী লোভের রাজনীতির দুষ্টচক্রের হাত থেকে আওয়ামী লীগকে বের করার মহান উদ্যোগটি মুজিব কন্যা শেখ হাসিনাকেই নিতে হবে।

পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, আমাদের সুমহান মুক্তিযুদ্ধ ও দীর্ঘ গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ভেতর দিয়ে মানুষের হূদয় নিঃসৃত যে গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, আদর্শিক রাজনীতি চেয়েছেন তা রাজনৈতিক শক্তিকেই হতে হবে। রাজনীতিবিদরাই রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন। রাজনীতিবিদরাই গণরায় নিয়ে সংসদে এসে জাতীয় স্বার্থে আলাপ, আলোচনা, বিতর্কের মধ্য দিয়ে জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করবেন। এদেশে মানুষের আকাঙ্খা থেকে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ ছিটকেই পড়েনি মানুষের অবাধ ভোটাধিকারের ক্ষমতাও হারিয়ে যাচ্ছে। এই দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ৬৭ বছরের গৌরবময় রাজনীতির মুকুট পরা দলটির নাম আওয়ামী লীগ। পাকিস্তান সৃষ্টির দুই বছরের মাথায় প্রতিষ্ঠিত এই দলটি বহু উত্থানপতন, বহু নেতাকর্মীর আত্মবলিদানের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতিকে আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এই মোহনায় স্বাধীনতার মন্ত্রে জাগ্রত করে। স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানের অহংকারেই অভিষিক্ত নয়, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর মুজিব কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ভোট ও গণতন্ত্রের দীর্ঘ সংগ্রামে পোড় খাওয়া এক রাজনৈতিক ঐশ্বর্যম-িত দল।

যেকোন দেশে যেকোন দল যদি ক্ষমতায় থাকে, তাহলে তার একটি শক্তিশালী বিরোধী দল সংসদে ও সাংসদের বাইরে থাকা প্রয়োজন। তারা অবশ্যই রাষ্ট্রের কতিপয় মীমাংসিত বিষয় মেনে নিয়ে বিকল্প রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় সরকারের বিরোধিতা করবেন। সরকার তাদের কাজে বাধা দিলে তা হবে চরম অগণতান্ত্রিক কাজ। কিন্তু কোনো গণতান্ত্রিক সরকারই রাষ্ট্রের বা রাষ্ট্রীয় মূলনীতির শত্রুতা করাকে শত্রুদের গণতান্ত্রিক অধিকার বলে মেনে নিতে পারবেন না। ষড়যন্ত্রের রাজনীতির সঙ্গে গণতন্ত্রের রাজনীতির সহাবস্থানও সম্ভব নয়। অন্যান্য দেশের দিকে তাকালে দেখা যায়, আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যে-তালেবান, আল কায়েদা ও সাম্প্রতিক সময়ে দুর্ধষ্য সন্ত্রাসী বাহিনী আইএসের জন্ম দিয়েছে। এদের দিয়ে যুদ্ধ বাঁধিয়ে রেখে তার ওয়ার ইন্ডাস্ট্রির প্রসার ও মুনাফা বাড়াচ্ছে। আমেরিকার এই কাজকে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং গণতন্ত্রের পক্ষে লড়াই বলে সাধারণ মানুষকে বোঝানোর জন্য দেশে দেশে ওয়াশিংটন বুদ্ধিজীবীদের একটি শীর্ষ অংশকে পোষেন। মিডিয়াকে পোষেন। আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীদের একটি

বড় অংশও এই পোষা বুদ্ধিজীবীদের অন্তর্ভূক্ত। তাদের কাজ ‘গণতন্ত্র গণতন্ত্র’ বলে চিৎকার করে গণতন্ত্রের আসল শত্রুদের আড়াল করে রাখা। অথবা গণতন্ত্রের শত্রু ও মিত্রদের এক পাল্লায় তুলে এই শত্রু-মিত্র চেনার ব্যাপারে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করা।এদের হাত থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করা না গেলে গণতন্ত্রও কখনো সুরক্ষিত হবে না বলেই মানুষের বিশ্বাস।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close