রায়হান আহমেদ তপাদার

  ২৩ মে, ২০১৯

বিশ্লেষণ

ভাটির টানে বিশ্ব গণতন্ত্র

বিশ্বে যখন গণতন্ত্রে ভাটার টান চলছে, তখন স্বৈরতান্ত্রিক শাসকরা তাদের ক্ষমতাকে সংহত করছেন হয় শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে, সাজানো নির্বাচনের মাধ্যমে, বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে কার্যত ধ্বংস করে দিয়ে কিংবা সিভিল সোসাইটিকে পর্যুদস্ত করে। এ সময় কোথাও গণতন্ত্রায়ণের সামান্য সম্ভাবনা দেখলেই গণতন্ত্রকামীদের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়, গণতন্ত্রমুখী প্রথম পদক্ষেপকে মনে হয় আলোকবর্তিকা। আলজেরিয়ার প্রায় ছয় সপ্তাহের গণ-আন্দোলনের মুখে প্রেসিডেন্ট আবদেলাজিজ বুতাফ্লিকার পশ্চাৎপসরণ, ঘোষিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচন বাতিল, তার প্রার্থী না হওয়ার ঘোষণা এবং শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ সেই কারণেই আমাদের সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে, আমাদের আশাবাদী করে। দীর্ঘ সময় ধরে আলজেরিয়ার রাজনীতির কেন্দ্রীয় ব্যক্তি বুতাফ্লিকা ২০১৩ সালে স্ট্রোক করার পর থেকে অদৃশ্য হয়ে যান। মূলত তাকে একটি মূর্তি হিসেবে রেখে স্বীয় অনুসারীরা ‘ডিপ স্টেটের’ সহায়তায় দেশ পরিচালনা করছিল। একটা লম্বা সময় ধরে একদলীয় শাসনের ফলে আলজেরিয়ায় গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশ ধ্বংস হয়ে গেছে, রাজনৈতিক ব্যক্তি ও ক্ষমতাসীনদের মধ্যে ব্যাপক হারে দুর্নীতি বেড়েছে। ফলে দেশে অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হয় এবং প্রকট আকার ধারণ করেছে বেকার সমস্যা। আলজেরিয়ার ৭০ শতাংশ মানুষের বয়স অনূর্ধ্ব ৩০। তেল ও গ্যাস-সমৃদ্ধ দেশটির এ বিশালসংখ্যক তরুণের প্রতি চারজনের একজন বেকার। আর এ যুবা-তরুণরাই বুতাফ্লিকার বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলন গড়ে তুলেছে।

উল্লেখ্য, বুতাফ্লিকা স্বীয় দীর্ঘ শাসনকালে বেকার সমস্যার কোনো সুরাহা করতে পারেননি, অর্থনৈতিক মন্দা এবং দুর্নীতি রোধ করতে পারেননি। বরং রাষ্ট্রযন্ত্রকে ক্রমে ডিপ স্টেটের কাছে জিম্মি করেছে ফেলেছেন। তিনি বিরাজমান এ পরিস্থিতিতে ১৮ এপ্রিল সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা দেন এবং পঞ্চমবারের মতো রাষ্ট্রপতি পদে লড়বেন বলে জানান। দীর্ঘ সময় ধরে জমাটবদ্ধ জনরোষ এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ও বুতাফ্লিকার স্বৈরশাসন থেকে দেশ ও গণতন্ত্রকে মুক্ত করার জন্য মানুষ রাস্তায় নেমে আসে; শুরু হয় ব্যাপক গণ-আন্দোলন। উত্তাল জনতার প্রতিবাদের মুখে বুতাফ্লিকার পদত্যাগের জন্য স্বীয় প্রশাসনের ভেতর থেকেও চাপ শুরু হয়। গণরোষের গতি দেখে দেশটির সেনাপ্রধান ও উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী আহমেদ গায়দা সালেহ বুতাফ্লিকাকে পদত্যাগ করতে চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন। প্রাথমিক অবস্থা

অবলোকন করে কিছুটা আন্দাজ করা যায়, আলজেরিয়ানরা শুধুই বুতাফ্লিকার পতন নয়, তারা গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থার

সংস্কারের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, দীর্ঘ সময় ‘ডিপ স্টেটের’ অধীন একটা দেশ থেকে এত সহজেই কি গণতান্ত্রিক উত্তরণ সম্ভব! আরব স্প্রিং-এর ৮ বছর পর উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকার ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী রাষ্ট্র আলজেরিয়ায় টানা ছয় সপ্তাহের গণ-আন্দোলনের তোড়ে ২ এপ্রিল ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন দুই দশকের স্বৈরশাসক আবদেল আজিজ বুতাফ্লিকা। বিশ্বের তাবৎ গণতন্ত্রকামী মানুষের কাছে আলজেরিয়ার এ গণ-অভ্যুত্থান আগ্রহের কারণ হয়ে উঠেছে।

২০১৩ সালের পর থেকে বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রে ভাটা চলছে। আর ঠিক এ সময়েই আফ্রিকার দুটি দেশেÑ সুদান ও আলজেরিয়া জনগণের মধ্যে গণতান্ত্রিক জাগরণ বিশেষ আগ্রহের কারণ হয়েছে। আলজেরিয়ায় চলমান বিক্ষোভে অংশ নেওয়া অধিকাংশ বয়সে তরুণ-যুবা। যারা একটা লম্বা সময় ‘নিয়ন্ত্রিত গণতান্ত্রিক’ দেশে বাস করে আসছিল। ফলে দীর্ঘদিনের জমানো ক্ষোভ ও মুক্তির আকাক্সক্ষা তাদের স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে সংগঠিত হতে জজবা এনে দিয়েছে। বৈশ্বিক রাজনীতির পরিস্থিতি বিবেচনায় আলজেরিয়ায় চলমান বিক্ষোভ বেশ দৃষ্টিকাড়া, আশা ও সংশয়ের। কারণ সারা বিশ্বে এখন গণতন্ত্রের ভাটা চলছে। গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে স্বৈরশাসকরা স্বীয় ক্ষমতা দৃঢ় করছে শক্তি খাটিয়ে। আর সে শক্তিকে বৈধতা দান করছে পাতানো নির্বাচনের মাধ্যমে এবং নির্বাচনের জয় ও ক্ষমতাকে সুসংহত করার জন্য বিরোধী মত দমন করছে, বিরোধী রাজনৈতিক দলের অবস্থান ধ্বংস করছে, সংবাদমাধ্যম এবং নাগরিক সমাজকে কোণঠাসা করে রাখছে। বৈশ্বিক গণতন্ত্রের এমন পতনপর অবস্থায় আলজেরিয়ায় চলমান গণতান্ত্রিক অধিকার আদায় ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন একদিকে যেমন আশাজাগানিয়া, অন্যদিকে আরব বসন্তের পর বর্তমান আরব বিশ্বের রাজনৈতিক অস্থিরাবস্থা অবলোকন করে এবং আলজেরিয়ার প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর রাজনৈতিক দুরবস্থা দৃষ্টে সংশয় ও ভয়ের উদ্বেগ করছে। ক্ষমতাচ্যুত বুতাফ্লিকা প্রায় দুই দশক আগে আলজেরিয়ার রাজনৈতিক সংকট মুহূর্তে ক্ষমতা হাতে নেন।

কিন্তু রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণের পর আলজেরিয়ার রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলা করে দেশে শান্তি স্থাপনের জন্য প্রথম দুই মেয়াদে তিনি জনগণের প্রিয়ভাজনে পরিণত হয়েছিলেন। তার এ জনপ্রিয়তায় ধস নামতে শুরু করে ২০০৯ সালে ও ২০১৪ সালে নির্বাচনে কারচুপির করে জয়লাভ করার পর থেকে। ১৯৬২ সালে আলজেরিয়া ফ্রান্সের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করার পর থেকে অনেক চড়াই-উতরাই পার করে এসেছে। ১৯৯০ সালে আলজেরিয়ার স্থানীয় নির্বাচনে ইসলামপন্থি দল এফআইএসের জয়লাভের পর দেশটির ওপর পশ্চিমাদের কুনজর পড়ে। ১৯৯২ সালের সংসদ নির্বাচনে ইসলামপন্থি দলের নিশ্চিত জয় লক্ষ্য করে পশ্চিমা দেশগুলো ও আমেরিকা ইসলামপন্থিদের ঠেকাতে নির্বাচন বাতিল করে সেনাবাহিনীকে ক্ষমতা দখল করতে প্ররোচিত ও সহায়তা করেছিল। মূলত তখন থেকে আলজেরিয়ার রাজনৈতিক সংকটের শুরু হয়। ১৯৯৯ সালে বুতাফ্লিকা ক্ষমতায় আসার পর দেশটিতে শান্তি ফিরে এলেও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশ নষ্ট হয়ে যায়। সেনাবাহিনী কর্তৃক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণের পর ইসলামপন্থিদের একাংশের সঙ্গে সেনাবাহিনীর যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। সেই গৃহযুদ্ধে দুই লাখ মানুষ মারা যায়, দেশের শাসনব্যবস্থা সেনাবাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা ও তাদের পছন্দের লোকদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়ে; আলজেরিয়ার রাজনীতিতে এদের ব্যাপক অবস্থান তৈরি হয় এবং সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে ওঠে ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতা, স্থানীয় করপোরেট শ্রেণি ও সম্পদশালীদের সঙ্গে।

প্রশ্ন হচ্ছে, এক বুতাফ্লিকার পদত্যাগের মাধ্যমেই কি তা সম্ভব হবে? না, কারণ প্রশাসনের প্রতি পদে বুতাফ্লিকার নিজস্ব ব্যক্তি আসীন রয়েছেন। আলজেরিয়ার বর্তমান পটপরিবর্তনের পেছনে লেগেছে সেনাবাহিনী। ইতিহাসে বিরল ঘটনা হচ্ছে, কোনো দেশে সেনাবাহিনী যদি একবার ক্ষমতার স্বাদ পায়, তা হলে সে দেশের গণতন্ত্রকে তাদের হাত থেকে মুক্ত করা বেশ কঠিন। এটা আলজেরিয়ার ক্ষেত্রেও সত্য। আমরা চাই, পুরো শাসনব্যবস্থা বদলে যাক, এটা আন্দোলনে অংশ নেওয়া এক নারীর বক্তব্য, যা বিবিসি তুলে ধরেছে। এটা আন্দোলনে অংশ নেওয়া প্রতিটি ব্যক্তির মনের কথা। তারা পুরো শাসনব্যবস্থা ও বিদ্যমান সরকারের সব কর্তাব্যক্তির পদত্যাগ চাচ্ছে। তারা বোধহয় এ শিক্ষা গ্রহণ করেছে যে, আবর বসন্তের সময় শুধু প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের পর স্বীয় ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের প্রশাসনে অবস্থান করার ফলে তাদের বিপ্লব যেভাবে নাকানি-চুবানি খেয়েছে ও লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে তা থেকে। তাই আন্দোলনকারীরা একমাত্র বুতাফ্লিকার পদত্যাগে খুশি হতে পারছেন না। তারা আরো দাবি করছেন, তাদের সবাইকে ক্ষমতা ছাড়তে হবে, যারা এত দিন বুতাফ্লিকার সহযোগী ছিলেন। পুরো প্রশাসন ব্যবস্থার সংস্কারের জন্য এবং গণতন্ত্রকে সুদৃঢ় করতে এটা অপরিহার্য। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তারা পারবে? কারণ একটা লম্বা সময়। এহেন পরিস্থিতিতে আলজেরিয়ায় আন্দোলনরত জনতার সামনে তাদেরই পার্শ্ববর্তী আরব দেশ থেকেও শেখার রয়েছে।

অন্যদিকে মিসরে বিরোধী দল মুসলিম ব্রাদারহুড ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এলেও টিকে থাকতে পারেনি। কারণ ব্রাদারহুডের ব্যাপক জনসমর্থন থাকলেও রাষ্ট্র পরিচালনায় দক্ষতা নেই। ক্ষমতা গ্রহণের পর দেশটিতে কাক্সিক্ষত সফলতা তারা দেখাতে পারেনি এবং অল্প দিনের মধ্যে ক্ষমতালোভী সেনাবাহিনীর হাতে গোটা বিপ্লব বেহাত হয়ে যায়। আলজেরিয়ার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, বুতাফ্লিকা যদি আবারও নির্বাচন করেন, তা হলে তারা সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। তাদের কথা হলো, আলজেরিয়ার জনগণ তাদের দাবির পক্ষে সুস্পষ্ট এবং দ্ব্যর্থহীন সাড়া আশা করছে। কিন্তু তাদের শোনানো হচ্ছে অপ্রতিপালিত পুরোনো প্রতিশ্রুতি। অবশ্য বুতাফ্লিকা সমর্থক রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বুতাফ্লিকার প্রতিশ্রুতিটি হবে একটি ন্যায্য চুক্তি। কারণ এর ফলে বিরোধী দলগুলো এবং সিভিল সোসাইটির সংগঠনগুলো একটি বড় ধরনের রাজনৈতিক ট্রানজিশনের জন্য সময় ও সুযোগ পাবে। অথচ সাধারণ মানুষ বলছে, বুতাফ্লিকা আসলে রাজনৈতিক ট্রানজিশন চাচ্ছেন না। যা কিছু তার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে তার পুরোটাই ধাপ্পাবাজি ছাড়া আর কিছু নয় গণতন্ত্রায়ণের প্রক্রিয়ায় যেকোনো ধরনের তাড়াহুড়া, সহজ পথের সন্ধান বিরাজমান কাঠামোর সুবিধাভোগীদেরই লাভবান করে অথবা তৈরি করেÑ এমন এক প্রাণঘাতী সংঘাতের, যার সঙ্গে যুক্ত হয় বিদেশি শক্তি, মাশুল গুনতে হয় সাধারণ নাগরিকদের।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close